ভালোবাসা
মোঃ জিয়াউল হক
প্রকাশিত: ০৪:৪৭ পিএম, ৭ মার্চ ২০২১ রোববার
ল্যাপটপের স্ক্রিণ থেকে চোখ তুলে দেখল একজন ভদ্রমহিলা ব্যাংকে ঢোকা মাত্রই সিকিউরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে স্যালুট করছে। সবার সাথে কুশল বিনিময় করছেন তিনি। আতিক বুঝলো বিশেষ কোনো ক্লায়েন্ট এসেছেন। স্বচ্ছ কাঁচে ঘেরা সুন্দর পরিপাটি ভাবে গোছানো রুমটাতে বসে আতিক তার পুরো অফিসটা দেখতে পায়। দিন কয়েক আগে ধানমন্ডির এই শাখায় বদলি হয়ে এসছে সে। এখনো সব কাজ গোছানো হয়নি, এমনকি সব ক্লায়েন্টের সাথেও সক্ষতা গড়ে উঠেনি তার। কলিংবেল চেপে পিয়নকে ডেকে জানতে চাইলো, কে উনি?
পিয়ন বলল, ‘স্যার, ম্যাডাম হচ্ছেন ইউনিক শিপিং এর মালিক ইমতিয়াজ স্যারের স্ত্রী, মুনা ম্যাডাম।
আচ্ছা, কাজ সেরে উনাকে আমার এখানে নিয়ে এসো। বলল আতিক।
ভেতরে আসতে পারি বলে যা দেখল, তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না মুনা। প্রস্তুত ছিল না আতিকও। দুজনই হতবিহ্বল। কেউই বুঝতে পারছে না কি বলবে!
ইতস্তত ভাব কাটিয়ে আতিকই প্রথম কথা বলল। আরো মুনা! তুমি এখানে! এসো, ভেতরে এসো।
ধন্যবাদ বলে বসল মুনা। কেমন আছ তুমি, এ শাখায় কবে এলে?
এইতো কয়েকদিন আগে। এখানে কি তোমার নিয়মিত আসা হয়? মানে তোমার কি আমাদের এ শাখায় লেনদেন আছে?
হ্যাঁ, আমার হাজব্যান্ডের ছোট একটা ব্যবসা আছে। আমাকেও মাঝে মাঝে সময় দিতে হয়। ওর একাউন্ট তোমাদের এখানে, তাই আসতে হয়। একটা লোনের এডজাস্টমেন্ট আছে তাই আসতে হলো আজ।
ইন্টারকমে আসিফ সাহেবকে ডেকে, মুনার কাগজপত্রগুলো রেডি করে নিয়ে আসতে বলল আতিক।
কি খাবে, চা নাকি কফি? জানতে চাইল আতিক।
যে কোনো একটা হলেই চলবে।
এখনো কি আগের মত ঠান্ডা চা খাও তুমি?
এখন অভ্যেস হয়ে গেছে, মৃদু হাসে মুনা। শুধু গরম চা কেন, অনেক কিছুই করতে পারি এখন। বিয়ে কোথায় করেছ? ছেলেমেয়ে ক’জন?
না, বিয়েটা আর করা হয়ে ওঠেনি। এই তো বেশ কেটে যাচ্ছে।
পিয়ন চা দিয়ে গেলে আতিক মুনাকে চা খাওয়ার অনুরোধ করে কাপটা একটু এগিয়ে দেয়।
দুজনই নীরবে চায়ে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। যেন ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়া বইছে চারদিকে।
দরজায় টোকা দিয়ে আসিফ সাহেব ঢুকলেন এমন সময়। বেশকিছু কাগজ পত্রে স্বাক্ষর করিয়ে বললেন, হয়ে গেছে ম্যাডাম। আগামী সপ্তাহে আমাদের অফিস থেকে আপনাকে একটা লেটার দেয়া হবে। আমাদের এখান থেকে কেউ গিয়ে আপনার অফিসে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
ধন্যবাদ, আপনাদের বেশ বিরক্ত করেছি।
না না ঠিক আছে ম্যাডাম, আর কিছু লাগলে বলবেন। বললেন আসিফ সাহেব।
আজ চলি, একটু ব্যস্ততা আছে। বাসায় বেড়াতে এসো একদিন, বলে উঠে দাঁড়ালো মুনা।
চল তোমাকে এগিয়ে দেই বলে আতিকও উঠে দাঁড়াল।
নিচে নেমে গাড়িতে উঠতে উঠতে মুনা বলল ভাল থেকো। গাড়ি চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে দুরত্ব বাড়তে থাকলো দুজনের, যেমনটি বেড়েছিল আজ থেকে ১৫ বছর আগে। মুনার গাড়ি নিমিষেই দৃষ্টি সীমার অগোচরে মিলিয়ে গেলো।
আতিক ঠায় দাঁড়িয়ে। সিগারেটে টান দিতে দিতে অন্যমনস্ক হয়ে ফিরে গেল ১৫ বছর আগের সেই দিনে, যেদিন মুনা ছিল তার সব। ভাবতে থাকলো পুরোনো সেই সব দিনের স্মৃতি কথা।
মুনা ছিল আতিকের সহপাঠী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচবছর একসাথে পড়েছে তারা। দুজন একে অপরের খুব কাছের বন্ধু ছিল। মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। ঢাকায় মুনার আর থাকার সুযোগ নেই। ফিরে যেতে হচ্ছে খুলনায় বাবা মায়ের কাছে।
আতিক এসেছে মুনাকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে। কমলাপুরের প্লাটফর্মে পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। ট্রেনে ওঠার আগ মূহুর্তে হাতে থাকা পার্টস থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে আতিকের হাতে দিল মুনা। চিঠিটি দেওয়ার সময় শর্ত দিয়েছিল ‘স্টেশন ছেড়ে আমার ট্রেন যখন চলে যাবে অনেক দূর, তখন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তুমি পড়বে এটি, তারর আগে নয়’।
আতিক মনে মনে বলল, ‘কতক্ষণ ছিল, কত মুহূর্ত ছিল, কত আনন্দময় সময় ছিল, কত আকাঙ্খা ছিল এমন একটি সময়ের- এতদিন কিছু বলনি। আজ শেষ বেলায় এসে কেন এত মায়া দেখাচ্ছ? এমন সময় দিচ্ছ যেদিন থেকে আর আমাদের আগের মত দেখা করার সুয়োগ ধাকবে না! আমরা দুজন যখন থাকব শত মাইল দূরে..!’
ঠিক আছে, তুমি যাবার পরেই পড়ব।'
ট্রেন হুইসেল বাঁজিয়ে ঝিকঝিক করে প্লাটফর্ম ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কী সুন্দর হাসিখুশি ভাবে চলে গেল মুনা। চোখে মুখে কোনো বিষাদের চিহ্ন নেই। চোখের কোনে জমলো না কোনো নোনা জল। জানালার কাছে বসে আকাশ দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে সে। পিছন ফিরে একবারও তাকাল না। ট্রেন আড়াল হয়ে যতদূর পর্যন্ত মিলিয়ে গেল, ততদূর পর্যন্ত তাকিয়ে রইল আতিক ।
পথে যেতে যেতে ওর চোখ থেকে একটুও কী কান্না ঝরে পড়েনি আমার জন্য? ও কী এতই পাষাণ হৃদয়ের? নাকি পাষাণ আমি নিজেই? কারোর চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও ঝরে পড়ল না! তবে কী মিছে ছিল সব অব্যক্ত ভাললাগা ! প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ভাবে আতিক।
মুনা চলে যাবার পর প্লাটফর্মের কোলাহল মুহূর্তেই যেন নিরব হয়ে যায়। কিছুক্ষণ এমনি দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে হেঁটে একটা খালি কংক্রিটের বেঞ্চের উপর বসে আতিক। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমোর যুগে হাতে লেখা চিঠি পেয়ে ভীষণ আপ্লুত সে।
স্যার চা খাইবেন, একা বসে থাকতে দেখে এক কিশোর চা বিক্রেতা জানতে চাইল?
দে
লাল চা কিন্তু স্যার!
লাল কালো যা হয় একটা দে।
চায়ে চুমুক দিয়ে বেঞ্চে গা এলিয়ে দেয় আতিক। পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজটা বের করে চোখের সামনে মেলে ধরলো।
প্রিয় বন্ধু,
চলে যাচ্ছি। আবার কবে আসব জানি না। আমাদের আর কোনদিন দেখা হবে কিনা তাও জানি না। তুমি এমন কেন বলো তো আতিক? ছেলেদের আরেকটু বেশি সাহসি হতে হয়। কত দিন মাস বছর আমরা এক সাথে থেকেছি! কতক্ষণ আমরা পাশাপাশি বসেছি! কত কথা বলেছি! কত স্বপ্ন দেখেছি! নিজেদের অজান্তে কতশত বার হাতের স্পর্শ অনুভব করেছি! কার শরীরের কেমন গন্ধ, তাও জানা ছিল আমাদের! এ ক’বছরে কী একবারের জন্যও আমাকে বন্ধুর চাইতে একটু বেশি করে ভাবার সুযোগ হয়নি তোমার? আমাকে কী তোমার ভালো লাগেনি কখনো? তুমি এমন কেন বল তো? কেন এত দ্বিধা ছিল তোমার?
জানো, গত দুবছর ধরে আমি প্রতিদিনই চাইতাম তোমর মুখে ভালবাসার কথা শুনতে! ভাবতাম এই বুঝি বলবে! কেন তুমি বলতে পারোনি- মুনা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে আমি বন্ধুর চাইতে আরো কিছুটা বেশি করে পেতে চাই।
কী আশ্চর্য! এই একই কথা আমারও বলতে বলতে এতটা সময় লেগে গেল। যখন এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি ঠিক তখন। হঠাৎ করেই চারপাশ শুন্য মনে হচ্ছে! মনে হচ্ছে- তুমি ছাড়া আমি খুব একা! তোমাকে ছাড়া আমার বাকি জীবন কি অর্থহীন হয়ে যাবে?
এই শহর আমাদের কত চেনা! কত হেঁটেছি এ শহরের পথে পথে, কত বৃক্ষের সবুজে, কত ইউক্যালিপটাসের ছায়াতলে! কত সময় পার করেছি অহেতুক কোনো কথা না বলে, পাশাপাশি হেঁটে। শুধু আসল কথাটাই কোনদিন বলা বলা হয়নি- 'আমি তোমাকে ভালোবাসি আতিক।'
হ্যাঁ, আতিক, আমি তোমাকে সত্যিই ভীষন ভালোবাসি। ভালো থেকো।
ইতি
তোমার মুনা
চিঠিটি বুকের মাঝে চেঁপে ধরে চিৎকার করে বলে উঠল, মুনা আমি তোমাকে ভালোবাসি।
কিছু কথা কিংবা অনুভূতি প্রকাশ করা যায়না, এসব মনের মধ্যেই পুষতে হয়, ভীষন যত্ন করে। দিন শেষে মনের ভেতর লুকানো এসব অপ্রকাশিত কথা আর অনুভূতিগুলোই বেঁচে থাকার অক্সিজেন জোগায়। এখনও আকাশের চাঁদের আলোয় তোমায় খুঁজি, তাই রাত হলে চাঁদটাকেই বড় আপন মনে হয়।
হঠাৎ এক পশলা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল চারপাশ। অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েও মুনা একবারও পিছন ফিরে তাকাল না। তখনও রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে মুনার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আতিক। সিগারেটের শেষ টানটা দিয়ে ফিরে এলো নিজের মত করে সাজানো কাঁচের ঘরটাতে।