অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

মার্চ শব্দে আগুন ঝরে

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০১:২৯ এএম, ১ মার্চ ২০২১ সোমবার   আপডেট: ১২:০২ পিএম, ১ মার্চ ২০২১ সোমবার

মার্চ এমন এক শব্দ, এমন এক মাসের নাম যার উচ্চারণে বাঙালির সতেচন হৃদয়মাত্র শিহরিত হয়। মনে এক শক্তির সঞ্চার করে। যে দেখেছে তার, কিংবা যে দেখেনি তারও চোখের সামনে ভেসে ওঠে আগুন ঝরা দিন, রক্তাত্ব রাজপথ, রিকয়েললেস রাইফেল, বুলেট, বেওনেট। তবে সব ছাপিয়ে মনে আসে উত্তাল মিছিল, স্লোগান- তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা। আর কানের গহীনে বাজতে শুরু করে সেই জ্বালাময়ী ভাষণ- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই মার্চের শুরু কিংবা বলা চলে এই মার্চেই ঘটে গেছে যা কিছু ঘটার। বজ্রকণ্ঠের সেই ঘোষণার পর আর কীই বাকি থাকতে পারে। বাকি নয়টি মাস যুদ্ধ হয়েছে বটে, কিন্তু বাঙালি মার্চেই দেখিয়ে দিয়েছে তার শক্তির প্রকাশ। ৭ই মার্চের সেই সমাগম ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে সেতো ছিলোই এক অসীম সাহসের আর শক্তির প্রকাশ। বাঙালি জাতির স্বপ্নসাধ যৌক্তিক পরিণতি পেতে শুরু করে এই মার্চে।  


প্রতিবাদে যার শুরু সেই মার্চে শেষভাগেই আসে স্বাধীনতার ঘোষণা। বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় এক লাল-সবুজের দেশ। কেমন ছিলো মার্চের দিনগুলো?

ইতিহাস বলছে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার প্রেক্ষাপট শুরু হয় মার্চের প্রথম দিন থেকে। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনটি ছিলো আজকের মতোই সোমবার। ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে আজকের এই দিনে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। দুপুর ১টা ৫মিনিটে রেডিও পাকিস্তানের সকল কেন্দ্রে একযোগে প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণা প্রচার করা হয়। পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় হওয়ার কথা ছিল। যা ১ মার্চেই স্থগিত করেন ইয়াহিয়া। 

তবে সে ঘোষণা কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ছিলো না। ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে যায় দেশ কঠোর সামরিক ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে। আর এই ভেতো বাঙালি এও বুঝে নেয় সামরিক আইন কঠোর করে ভেতরে ভেতরে কোন গভীর প্রস্তুতি চালাচ্ছে ইয়াহিয়া সরকার। তবে ষড়যন্ত্রের জবাব সেদিন অন্যভাবেই পেয়েছিলো সামরিক জান্তা। ইতিহাস বলছে, দুপুরে রেডিওতে যখন জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার সংবাদটি প্রচারিত হলো, তখন ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানরত পাকিস্তান ও বিশ্ব একাদশের মধ্যে এক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট প্রতিযোগিতার ধারা বিবরণী চলছিল। সেই ধারাবিবরণীর মাঝেই ঘোষণা এলো। রেডিওতে খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরে প্রথম সংঘটিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে স্টেডিয়ামের হাজার হাজার ক্রিকেট দর্শক। তারা সমস্বরে ‘জয় বাংলা’ বলে স্লোগান ধরে। ধাওয়া করে পশ্চিম পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের এবং স্লোগানে উত্তাল হয়ে জঙ্গি মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে পড়ে। ওদিকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের খবর শুনে পিআইএ’র বাঙালি কর্মচারীরাও জনসাধারণের সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়েন। জগন্নাথ কলেজ ও পার্শ্ববর্তী কায়েদে আযম কলেজের ছাত্ররাও লাঠিসোটা হাতে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে। আদমজী মিলের শ্রমিকরা চাকা বন্ধ করে শোভাযাত্রা সহকারে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। এভাবে মার্চের প্রথম দিনেই ঢাকা উত্তাল হয়ে ওঠে। 

মিছিলকারীরা এ সময় বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন এ খবর জানতে চায়। অবশেষ তারা জানতে পারেন বঙ্গবন্ধু তখন হোটেল পূর্বাণীতে অবস্থান করছিলেন। এখানে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক দেওয়া ছিলো। মিছিলের পর মিছিল এগিয়ে যায় সেই হোটেলের দিকে। লাখ লাখ মানুষের স্লোগানে স্লোগানে হোটেল পূর্বাণীর চত্বর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সকলেই বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী নির্দেশ শোনার জন্য উৎকণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করতে থাকে। ততক্ষণে সাংবাদিকরাও সেখানে হাজির। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, তিনি তক্ষুণি চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে তিনি মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, আতাউর রহমান খানসহ অন্যান্য নেতার সঙ্গে আলোচনা করবেন। তবে বঙ্গবন্ধু সেই মূহূর্তে এই ঘোষণাও দিয়েছিলেন, অধিবেশন স্থগিত হওয়ার বিষয়টি তিনি বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেবেন না। 

সেখান থেকেই ২ মার্চ মঙ্গলবার ঢাকায় এবং ৩ মার্চ বুধবার সারাদেশে হরতাল পালনের ঘোষণা দিলেন। আর জানিয়ে দিলেন ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। 

সেদিন বঙ্গবন্ধুকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, জনগণ তো রাস্তায় নেমে পড়েছে, তিনি তাদেরকে কি বলবেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে এবং যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে বলবো।’

সেই ত্যাগ স্বীকারের চূড়ান্ত আহ্বান তিনি জানালেন ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে। আর সেদিন তো বাঙালির স্বাধীনতার মন্ত্র উচ্চারিত হলো লাখো মানুষের উপস্থিতিতে। 

তখন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূ্র্য্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”

এরপর বলা চলে যুদ্ধই শুরু হয়ে গেলো। যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল। ক্ষোভের অগ্নিতে কয়লা পড়লো ২৫ মার্চ কালো রাতে। ২৬ মার্চ ঘোষিত হলো স্বাধীনতা। এরপর শুধুই যুদ্ধ। দীর্ঘ নয় মাস।