ভাষা আন্দোলনে গুলি ও নূরুল আমিনের সেই অদ্ভুত সাফাই!
রাহাত মিনহাজ, শিক্ষক ও গবেষক
প্রকাশিত: ০১:৩৪ এএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রোববার আপডেট: ১১:৩৯ এএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রোববার
বাঙালী জাতিসত্ত্বার অধিকারী এবং মুখের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও যে কয়জন কুলাঙ্গার মনেপ্রাণে বাংলা ভাষার বিরোধীতা করেছেন তাদের অন্যতম নূরুল আমিন। মুসলিম লীগ নেতা নূরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী হন ১৯৪৮ সালে। এরপর দীর্ঘ ৫ বছর জনগণকে তার কুশাসন মেনে নিয়ে হয়। বাঙালী বিদ্বেষী বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে নূরুল আমীন কুখ্যাত হয়ে আছেন তার ভাষা আন্দোলন বিরোধী ন্যাক্কারজনক ভূমিকার জন্য। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুারির আগে-পরে নূরুল আমিন এই ভূমিকা রাখেন। তার বাঙালি জাতিসত্ত্বা ও বাংলা ভাষা বিরোধী অবস্থান ছিল অনেক আগে থেকেই। ভাষার প্রশ্নে তিনি ছিলেন জিন্নাহ্ আর নাজিমুদ্দিনের সহযোদ্ধা। বাংলাকে অবদমন আর উর্দুকে প্রতিষ্ঠার জন্য হেন কাজ নেই করেননি বাঙলি নূরুল আমিন।
২১ ফেব্রুয়ারিতে গুলি, ছাত্র হত্যা, ২২ ফেব্রুয়ারিতে আবার গুলি, আরও রক্ত, যাতে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ঢাকা। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামগঞ্জে। তৈরি হয় পাকিস্তান বিরোধী তীব্র ক্ষোভ। এই গণ আন্দোলন প্রতিরোধে মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন বেছে নেন সাম্প্রদায়িকতার পথ। তিনি এতে পাকিস্তান ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র দেখেন, দেখেন কমিউনিস্টদের চক্রান্ত। অস্বীকারের চেষ্টা করেন ছাত্র হত্যার ঘটনা। আইন সভার বাজেট অধিবেশনে মওলানা তর্কবাগীশ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ অন্যান্যরা ভাষার প্রশ্নে প্রাণ দান ও পুলিশের গুলির প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও কোন কথা বলতে চাননি মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন। তবে পরে তিনি বিবৃতি দিতে বাধ্য হন। কেন পুলিশ গুলি চালালো তা বারবার জানতে চাইলেও তিনি সরাসরি কোন উত্তর দেননি। ঐ দিন পরিষদে নূরুল আমিন বলেন,
‘সকাল দশটা থেকে ছাত্ররা অন্যান্য তরুণদের সহযোগিতায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশ কর্ডন ভেদ করে শহরে শোভাযাত্রা বের করার চেষ্টা করে। পুলিশ তাদের প্রাঙ্গনে ঘেরাও করে রেখেছিল। যাতে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করতে না পারে। পুলিশ প্রাঙ্গনে ঢোকেনি। আমি যতদূর খবর পেয়েছি পথচারীদের উপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। তাদের গাড়ি ভাঙ্গা হয়। কয়েকজন পুলিশ আহত হয়, তবুও হস্তক্ষেপ করা হয়নি। প্রথমে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাদানো গ্যাস প্রয়োগ করা হয়।’ (পৃষ্ঠা; ৩০, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন)
সেদিন পরিষদের অন্য সদস্যরা নূরুল আমিনের ঐ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। অধিবেশনে অলি আহমদ খান বলেন,
‘গতকাল ঢাকা শহরে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে দেশবাসী সকলেই মর্মাহত হয়েছে। আজকের সরকার পক্ষ একটা স্পেশাল মোশান এনেছেন প্রকৃত কথা ধামাচাপা দিয়ে লোককে বুঝাবার জন্য যে ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করেছিলেন।’ (পৃষ্ঠা; ৩৪, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন)
এছাড়া মিসেস আনোয়ারা হোসেন, শামসুদ্দীন আহমদ মাসুম, মনোরঞ্জন ধর, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও মওলানা তর্কবাগীশ ভাষা আন্দোলনের পক্ষে পুলিশের গুলি চালানোর প্রতিবাদ করেন। কিন্তু মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি বারবার এই আন্দোলনকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন,
‘সান্ধ্য আইন জারি করার সিন্ধান্ত হয়েছে, কারণ আমি নাগরিকদের দুষ্কৃতিকারীদের শিকার হতে দিতে পারি না । যখন অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটেছে তখন আমাকে সেনাবাহিনী ডাকতে হয়েছে। ’ (পৃষ্ঠা; ৩৫, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন)
এদিকে ভাষার প্রশ্নে যখন পরিষদ উত্তপ্ত তখন হঠাৎই ২৪ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করে। তবে ৩ মার্চ এক বেতার ভাষণে নূরুল আমিন ভাষা আন্দোলনের প্রতি চরম বিষোদগার করেন। গুলি চালানোর পেছনে দেন অদ্ভূত সাফাই। বেতার ভাষণে নূরুল আমিন বলেন,
‘যদি দৃঢ়তার সঙ্গে এই অরাজকতা দমনে আমি ও আমার সহকর্মীগণ অগ্রসর হইতে না পরিতাম, তাহা হইলে জনগণ ও ইসলামের প্রতি কর্তব্য সম্পাদনে আমরা সামনে ও আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের সামনে নিশ্চয় অপরাধী সাব্যস্ত হইতাম।’ (পৃষ্ঠা;৬৮, বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র)
কী অদ্ভূত যুক্তি! গুলি চালানোর নির্দেশ না দিলে অপরাধী হতেন নূরুল আমিন! শুধু বেতারেই নয়, এ রকম বিবৃতি সরকারী প্রভাববলয়ে থাকা পত্র-পত্রিকায় একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে। নূরুল আমিন সব ধরণের চেষ্টাই করেন ভাষা আন্দোলন ও এর চেতনাকে নসাৎ করতে। তবে তার সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। মুসলিম লীগের এই নেতাকে জনগণ প্রত্যাখান করেন অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত নূরুল আমিন। ১৯৫৪ সালে পরাজিত নূরুল আমিন ১৯৭১ সালে হাজির হয়েছিলেন আরও সাম্প্রদায়িক এবং খুনে চরিত্র নিয়ে। ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন নূরুল আমিন। তখন তিনি পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টিÑপিডিপি’র নেতা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানেই রয়ে যান কুখ্যাত এই বাঙালি নেতা। এরপর পকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে মারা যান নূরুল আমিন, যিনি ভাষা আন্দোলনে ন্যাক্কারজনক ভূমিকার জন্য আজও ধিকৃত।
[email protected] (লেখক, সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ)
সহায়ক তথ্যসূত্র:
১. ভাষা আন্দোলন (২০০৯), আহমদ রফিক, প্রথমা ।
২. বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন(২০০৬) রফিকুল ইসলাম, সোসাইটি ফর এনভায়রমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলোপমেন্ট সেড।
৩. একুশের পটভূমি একুশের স্মৃতি (২০০৩), সংকলন, প্রথমা।
৪. বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র (১৯৯৯) হুমায়ূন আজাদ, আগামী প্রকাশন।