দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা
মাহমুদ মেনন, সম্পাদক, অপরাজেয় বাংলা
প্রকাশিত: ১১:৫৬ পিএম, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শনিবার আপডেট: ০১:০৪ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রোববার
ছবি: আঁকা ও মডেল: আনুশি আরাফাত
দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা। এই বাংলা আমাদের বাংলা নামের দেশ। এই বাংলা আমাদের মুখের বাংলা বুলি। যা আমাদের মায়ের ভাষা। যে ভাষাকে নিজের করে পেতে আমরা দাম শোধ করেছি রক্তে। তাজা লাল রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করে।
কিন্তু এ এমন এক অনন্য অর্জন যা হারানোর বেদনাকে ঢেকে দেয়; বড় করে তোলে পাওয়ার আনন্দকে। একুশ আমাদের যতটা কাঁদায় তার চেয়ে হাসায় বেশি। আর তাইতো আমরা উদযাপন করি দিনটিকে।
উদযাপন তো করতেই হবে। বাংলা ভাষাকে নিজের ভাষা, দাপ্তরিক ভাষা, সবখানে, সবক্ষণে বলার ভাষা হিসেবে পেতে আমাদের বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা ১৯৫২ সালে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে রাজপথে। যা তাদের শহীদের উপাধি দিয়েছে, আর নিজের দেশকে দিয়েছ নিজের ভাষা। বাঙলা মায়ের সকল সন্তান সেই সব সূর্যসন্তানদের স্মরণ করে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে আসলেও ধীরে ধীরে এই অর্জনের গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
ভাষা আন্দোলন অনেক বেশি মহিমান্বিত হয় সে ঘটনারও প্রায় তিন দশক পরে যখন এই বাঙালি জাতি নিজের স্বাধীকারের লড়াই করতে করতে এক পর্যায়ে অস্ত্র ধরে, স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বিজয় আনে আর বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় নতুন দেশ- বাংলাদেশ। বায়ান্নোয় যে জাতি নিজের ভাষার জন্য বুক পেতে গুলি খেয়ে রাস্তায় গড়ায়, তখনই তার যে দেশের জন্য ভাষার জন্য রক্ত দেয়ার ধাত তৈরি হয়, তারই ধারাবাহিকতা ত্রিশ লাখ প্রাণ এই বাংলায় অকাতরে বিলিয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন করে। আর বায়ন্নো তকমা পায় একাত্তরের সোপান হিসেবে।
ভাষার জন্য পৃথিবীর আর কোনো জাতি কোনো কালে দিয়েছে প্রাণ? বীর বাঙালির মতো এমন অকুতোভয় আর কোন জাতিই আছে? ভাষাই যে গর্বের প্রতীক তাও বাঙালির ছাড়া আর আছে কার?
তবে বিষয়টি বিশ্বের দরবারে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আরও পরে। সেটি ১৯৭৪ সাল। দিনটি ২৫ সেপ্টেম্বর। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাঙালি জাতির জনক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছিলেন এই ভাষাকে। ভাষার জন্য লড়াইয়ে রাজপথে থাকা সেই অকুতোভয় বাঙালি সেদিন বিশ্বকে শুনিয়ে দিয়েছিলেন এই বাংলাভাষাটি শুনতে কেমন। ভাষার জোরই যে সবচেয়ে বড় শক্তি সেটাই সেদিন প্রমাণিত হলো।
আর শুধুই কী জোর বা শক্তি! এই বাংলাতো মধুর এক বুলি। কবি লিখলেন, বাজে কী মধুর সুরে বাজে বাংলাদেশর বাঁশি। বাঁশি বলে আর কিছু নয় শুধু বাংলা ভালোবাসি। সেই যে মধুর এক ভাষা বিশ্বের দরবারে নিয়ে যাওয়া সেই ভাষা একপর্যায়ে বিশ্বের স্বীকৃতি পেলো বিশ্বের মধুরতম ভাষা হিসেবেও। আর তারও চেয়ে বড় যে অর্জন হয়ে ধরা দিলো তা হচ্ছে- আমাদের ভাষা আন্দোলনের সেই দিনটি স্বীকৃতি পেলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
বিশ্বের ১৮৮টি দেশ আজ দিবসটি মায়ের ভাষার আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে উদযাপন করে। বিশ্বের কাছে আজ একুশে ফেব্রুয়ারি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। যে দিনটিকে এবং যে বাংলাকে আমাদের কিনতে হয়েছে রক্তের দামে। যে দিনটিকে আমরা ভুলিনি, ভুলবো না। একুশের প্রত্যুষে প্রভাতফেরিতে আমরা গাইবো আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।
ভাষার এই মহিমান্বিত দিকটি আমাদের এগিয়ে নিতে হবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এর মহিমা, এর গুরুত্ব আর এর গভীরতাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। দিনটির যথাযথ উদযাপনে সে দায়িত্ব হয়তো কিছুটা পালন করা যাবে। তবে তার চেয়ে বড় কথা, প্রতিনিয়ত শিক্ষায় নতুন প্রজন্মকে শেখাতে হবে বাংলার গুরুত্ব, বাংলাভাষার মহিমা। কোনও পর্যাযে যেনো এই ভাষার মাধুর্য এই ভাষা নিজের ভাষা হিসেবে পাওয়ার গৌরবগাঁথা ফিকে হয়ে না যায়, সেটাও লক্ষ্য রাখতে হবে। আর তাতেই স্বার্থক হবে দাম দিয়ে কেনা বাংলা, যা কারো দানে পাওয়া নয়।
এই যে ছোট্ট শিশুটি। আনুশি আরাফাত। বয়স মোটে সাড়ে ৫ বছর। সে তার ছোট্ট কোমল দুটি হাতে অনেক গৌরবের শহীদ মিনারকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ছবিটি সে নিজেই এঁকেছে। কী গৌরবের তার এই আঁকা। কী গৌরবের এই শহীদ মিনার। তার পেছনে লাল সূর্য। কী গৌরবের সব বর্ণমালা। যা দাম দিয়ে কেনা হয়েছিলো। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আনুশিদের হাতে গৌরবগাঁথা তার সমহিমায় থাকবে। তাদের হাত ধরেই যাবে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে একই উজ্জ্বলতায়, একই মহিমান্বিত রূপে। আর সেভাবে স্বার্থক হবে রক্তের দামে কেনা বর্ণমালা।