যেভাবে হত্যারহস্য উন্মোচন করলো বরগুনার ‘তিন গোয়েন্দা’
মহিউদ্দিন অপু, বরগুনা
প্রকাশিত: ০৩:৩২ পিএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বৃহস্পতিবার আপডেট: ০৪:২৫ পিএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বৃহস্পতিবার
বাঁ থেকে রাজু, ইয়াকুব ও নাজমুল
গত বছরের ২৩ মে রাতে বরগুনার নিজ বাড়িতে মারা যান গোলবুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নাসির (৪৬)। স্ত্রী ফাতেমা মিতুর জানানো তথ্যে প্রাথমিকভাবে পরিবার ও স্বজনরা ধরে নেয় স্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছে তার। ঘটনার নয় মাস পর রাজু (২৫), ইয়াকুব (২০) ও নাজমুল (২৫) নামের তিন তরুণের চেষ্টায় উদঘাটন হয় এটি স্ট্রোক নয় হত্যা। অপরাজেয় বাংলার কাছে হত্যারহস্য উন্মোচনের রোমাঞ্চকর সে গল্পও শোনান এ তিন জন।
ঘটনার শুরু রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া এক মোবাইল দিয়ে। গত বছরের আগস্টে নিজের দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরছিলেন রাজু। এসময় রাস্তায় একটি মোবাইল পড়ে থাকতে দেখে তুলে নেন তিনি। ফোন পাওয়ার পরের ঘটনা তুলে ধরে রাজু জানান, ফোনটি বন্ধ থাকায় কার ফোন বলে ডাকাডাকি করি। কারও সাড়া না পেয়ে ফোনটি বাসায় নিয়ে ড্রয়ারে রেখে দেই। প্রায় মাস দেড়েক বন্ধ অবস্থাতেই ফোনটি ড্রয়ারে পড়ে ছিল। ভুলেই গিয়েছিলাম ফোনটির কথা।
“তবে একদিন রাতে মশার কয়েল খুঁজতে গিয়ে ড্রয়ারে রাখা ফোনটি আবার চোখে পড়লে চার্জে দিয়ে রাখি। সকালে ফোন অন করে দোকানে আসতেই একটি কল আসে। কল রিসিভ করার পর এক তরুণ ওই ফোনের মালিকানা দাবি করে ফোনটি ফেরত চান। আমি তাকে দোকানে এসে পরিচয় দিয়ে ফোনটি ফেরত নিতে বলি। কিন্ত তিনি পরিচয় না দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা অফার করে বলেন, ফোনটা একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিতে। যেখান থেকে তিনি ফোনটি নিয়ে নেবেন।”
এ ঘটনায় সন্দেহ জাগে তার মনে। তখনই মোবাইলে কী আছে দেখার চেষ্টা করেন রাজু। ঘাঁটাঘাঁটির এক পর্যায়ে পেয়ে যান কিছু ফোনালাপ। রাজু জানান, রেকর্ডগুলো শোনার পর আমি নিশ্চিত হই যে, নাসির নামে কোনো এক স্কুলশিক্ষককে হত্যা করেছে তারই স্ত্রী ও সেই স্ত্রীর পরিচিত রাজু নামের এক ব্যক্তি। হতবাক হয়ে যাই। কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। হত্যাকারীর নামও রাজু, আমার নামও রাজু। আবার ফোনটাও আমার কাছে। আমি ভয় পেয়ে যাই। এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ কেটে যায়।
রাজু আরও বলেন, ভয় পেয়ে বিষয়টি চেপে যেতে চাইলেও মনের মধ্যে কৌতুহল দানা বাঁধতে শুরু করে। একদিন ইয়াকুব দোকানে এলে গল্পচ্ছলে ঘটনা খুলে বলি তাকে। সেইসঙ্গে শোনাই রেকর্ডগুলোও। দুজন মিলেও ঠিক করতে পারছিলাম না কী করা যায়। পরে আমরা নাজমুলের কাছেও সবকিছু বলি। আমি দোকানে ব্যস্ত থাকি তাই নাজমুল ও ইয়াকু্ব বিষয়টি নিয়ে ঘাটতে শুরু করে।
বাকি গল্প এগিয়ে নিয়ে যান ঋণদান সংস্থায় চাকরি করা ইয়াকুব ও নাজমুল। ইয়াকুব জানায়, দোকানদার রাজু আমাদের ঋণগ্রহিতা। বিষয়টি আমার সঙ্গে আলাপ করার পর রেকর্ডগুলো আমি শুনি। আমরা তিনজন মিলে সিদ্ধান্ত নেই ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাই হত্যাকারিদের অনুসন্ধানে নামি আমরা।
নাজমুল বলেন, আমরা ফোনের মালিক রাজুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। অনেক কৌশলের আশ্রয় নিয়ে রাজুর কাছে পৌঁছাই আমরা। জানতে পারি, ২০ বছর বয়সী রাজু মিয়া ঢলুয়া ইউনিয়নের গুলবুনিয়া এলাকার বারেক মিয়ার ছেলে। রাজু মিয়ার কাছে গিয়ে রেকর্ডগুলো শোনাই। রেকর্ডগুলো শোনানোর পর নাসিরের স্ত্রী মিতুর ষড়যন্ত্রে তিনি এ হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে স্বীকার করেন। কৌশলে আমরা রাজুর স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও ধারন করে রাখি। রাজু যাতে পালিয়ে না যায় এ জন্য আমরা তাকে সমঝোতার আশ্বাস দিয়ে নজরে রাখি।
এরপর খুঁজে বের করি নিহত নাসিরের বাড়ি। নাসিরের ভাই জলিলের সঙ্গে কথা বলি আমরা। রেকর্ডগুলো তাকে শোনাই। শোনার পরও আইনের আশ্রয় নিতে কিছুটা অনিহা দেখান জলিল। হতাশ হয়ে পড়ি আমরা। কিন্তু থেমে যাইনি।
এরপর নিহত নাসিরের স্ত্রী মিতুর সন্ধানে বের হই আমরা। জানতে পারি, বরগুনা শহরের থানাপাড়া এলাকায় বাবার বাসায় থাকেন মিতু। স্বামীর মৃত্যুর পর বাসার আসবাবপত্র সরিয়ে বাবার বাড়িতে উঠে গেছেন তিনি। আমরা মিতুর বিয়ের প্রস্তাবের জন্য খোঁজ নিচ্ছি এমন কৌশল অবলম্বন করে তার ব্যাপারে খোঁজ নিতে থাকি। পরে মিতুর বাবা মোক্তার মাহতাব হোসেনের সঙ্গে দেখা করে রেকর্ডগুলো তাকেও শোনাই। এসব শোনার পর তিনি বলেন, আমার মেয়ে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আপনারা পুলিশে ধরিয়ে দেন ওরে।
নাজমুল আরও বলেন, কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না আমরা। তাই ওইদিন সন্ধার পর একজন গণমাধ্যমকর্মীর শরণাপন্ন হয়ে তার মাধ্যমে আমরা রেকর্ডগুলো নিয়ে থানায় যাই। রাজুর স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও, কল রেকর্ড ও সমস্ত তথ্য থানা পুলিশের কর্মকর্তার হাতে তুলে দেই। ওই রাতেই মিতু ও রাজুকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে রাজু ও মিতু উভয়েই পুলিশের কাছে নাসিরকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করে।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি মিতু ও রাজুকে গ্রেফতার করার পর বরগুনার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর মল্লিক সাংবাদিকদের জানান, গত বছর ২৩ মে ঈদুল ফিতরের আগের দিন রাতে নাসিরের মৃত্যুর খবর পান স্বজনরা। পরবর্তীতে স্বাভাবিক মৃত্যু জেনে তাকে স্বাভাবিক নিয়মেই দাফন করা হয়। ঘটনার আট মাস ১৯ দিন পর স্বজনরা জানতে পারেন নাসিরের স্ত্রী মিতু ও রাজু নাসিরকে পরিকল্পিতভাবে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে কম্বল চেপে শ্বাসরােধ করে হত্যা করেন। এ ঘটনায় নাসিরের বড় ভাই জলিল হাওলাদার বরগুনা সদর থানায় অভিযাগ করলে তদন্তে নামে পুলিশ। পরে তদন্তকালে ঘটনার প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়ায় নাসিরের স্ত্রী ফাতেমা মিতু ও রাজুকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ সুপার বলেন, মিতু ও রাজুর কথোপকথনের ১৩টি অডিও রেকর্ড হতে হত্যা সম্পর্কে জানা যায়, বেপরোয়া চলাফেরা ও টিকটক-লাইকির ভিডিও তৈরিতে বাধা দেয়ায় স্বামী নাসিরের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন মিতু। তাই স্বামীকে মারতে লোক ভাড়া করেছিলেন তিনি।
রাজু, ইয়াকুব ও নাজমুলের দাবি, এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হোক এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক অপরাধীদের। তবে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও কিছুটা শঙ্কিত জানিয়ে তিনজনই বলেন, আসামিরা ছাড়া পেলে আমাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে। তাই আমরা প্রশাসনের কাছে সুরক্ষা চাই।