অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

ওমর, দ্য টেন্টমেকার ।। অনুবাদ: কবির চান্দ ।। মূল: নাথান হাসকেল [কিস্তি ৩]

কবির চান্দ, লেখক ও অনুবাদক

প্রকাশিত: ০৫:১৯ পিএম, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বুধবার   আপডেট: ০৬:৪১ পিএম, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বুধবার

ওমর, দ্য টেন্টমেকার

ওমর, দ্য টেন্টমেকার

[কিস্তি-১: সুলায়মান পয়গম্বরের যাদুর গালিচা] [কিস্তি-২: গিরিপথ]

পাহাড়ি উদ্যান

প্রথমে আরবি জাতের সাদা ঘোড়ায় সুসজ্জিত বল্লম হাতে পাহারাদাররা চলল। তারপর উচ্চস্বরে সঞ্জীবনী বাদ্য বাজাতে বাজাতে এগিয়ে চলল বাদক দল, যাদেরকে ইব্রাহিম নিয়াল সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এরপর বোখারার উৎকৃষ্ট চামড়ার আচ্ছাদন আর একই রকম দেখতে চমৎকার পোষাক পরিহিত সমান উচ্চতার ঘোড়সওয়ার সৈনিক দল, একেক সারিতে ছয়জন করে। তরতাজা ঘোড়াগুলো বাগ মানতে চায় না, কিন্তু তাদের ওপর সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণ নিখুঁত ছিল যে তারা পায়ে পা মিলিয়ে চলছিল। একটু পিছনে মালিকশাহ আর তার পরিচরবর্গ। তিনি সওয়ার হয়েছেন প্রাচ্যে পাওয়া যায় এরকম সবচেয়ে ভালো, কয়লার মত কুচকুচে চকচকে কালো রঙের ঘোড়ায়। নিয়মিত পরিচর্যার ফলে এর গা অত্যন্ত মসৃণ, আর ঝলমলে দামী পাথরে সাজানো। কিন্তু এ পাথরগুলোর চেয়েও দামী বুঝি এর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, শরীরের প্রতিটি অঙ্গের নিখুঁত অনুপাত, প্রত্যঙ্গে প্রত্যঙ্গে ছড়ানো উঁচু জাতের গঠন সুষমা আর প্রতি পদক্ষেপে আত্মবিশ্বাসের ছাপ। পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসীরা হয়তো বলবেন যে, অতীতের কোনো বীর যোদ্ধার আত্মা বুঝি এতে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্চর্যের কিছু নেই যে এমন একটি ঘোড়া রেখে মালিকশাহ পালকিতে আবদ্ধ হয়ে চলতে চাইবেন না।

তাঁর এবং তাঁর সহচরবর্গের ঠিক পিছনেই আরেকদল সেনা, আর তার পর উজ্জ্বল রঙ ও সাজে সজ্জিত রাজকীয় নারীগণের দল। মুখ বাড়িয়ে তারা নিচে সমতলের সৌন্দর্য আর সুমহান শহর দেখতে উদগ্রিব। কেউ তাঁদের মুখমণ্ডল দেখে ফেললো কিনা তার যেমন পরোয়া নেই, তেমনি খাড়া বাঁক আর অত উঁচু থেকে নিচু এলাকা দেখলে সচরাচর যা হয় সেরকম ভয়ের কোনো চিহ্নও তাদের চোখে নেই। এরপর বেঢপ আকারের লালচে রঙের উটের কাফেলা, সেই নুহের প্লাবনের সময় থেকে যাদের হেলেদুলে চলার ভঙ্গীতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তাদের দুষ্টু চোখগুলো চালকদের দিকে নিবদ্ধ, যেন কামড়ে ধরার বা বকা দেয়ার সুযোগ খুঁজছে। হেন মূল্যবান জিনিস নেই যা তারা বহন করছে না - শিকার বা ক্যাম্পিংয়ের জন্য যে ধরনের গালিচা প্রয়োজন পড়বে, কারও বিশ^স্ততার পুরস্কার হিসেবে যে ধরনের পুরস্কার লাগবে, এমনকি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হলে যা দেয়া যেতে পারে এমন সবকিছুই তাদের পিঠে রয়েছে। ধর্মপ্রচারক থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিভাগের মন্ত্রীগণ, কর্মকর্তা-কর্মচারী, অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়ে সবাই চলেছেন এই রাজকীয় কাফেলায়। যেন একটা ভ্রাম্যমান শহর এগিয়ে চলেছে। আর যেহেতু এটা একটা আনন্দ সফর, সবখানেই উৎসব-উৎসব ভাব। এটা দেখে কারও মনে ঈর্ষা জেগে থাকলেও তা আপাতত দৃশ্যমান নয়, আর আগে থেকেই সাবধান বাণী পাঠিয়ে রাখা পাহাড়ী গোত্রগুলো থেকেও কোনো আক্রমণের আশঙ্কা নেই। সূর্য তখনও স্বমহিমায় জ¦লছে, আর কাফেলা যতই এগিয়ে চলেছে গাছপালার রাশি ততই বর্ণ ও বৈচিত্রে বিভা ছড়াচ্ছে।
 
তাড়াতাড়ি পা চালালে সামনের অশ্বারোহীর দল হয়তো সন্ধ্যার আগেই নিশাপুর পৌঁছে যেতে পারত। কিন্তুতাড়াহুড়ার কোনো কারণ ছিল না। নিচের দিকে আরেকটু এগিয়ে গেলেই, পাহাড়ের পাদদেশে বেশ বড় একটা উদ্যান। ইব্রাহিম নিয়াল এমন ব্যবস্থা করেছেন যেন রাজকীয় বহর সেখানে ঘাঁটি ফেলতে পারে। সবার জন্যই তিনি থাকার ব্যবস্থা করেছেন। আর বানিয়েছেন শিকার উপযোগী সরাই বা রাজকীয় গৃহ যেখানে সুলতান মালিক শাহ, যাকে সম্বোধন করা হয় কিবলায়ে আলম বা জগতের কেন্দ্র বলে, এবং তার ঘনিষ্ঠজনদের আপ্যায়িত করা যেতে পারে।

আগেই মালিকশাহের অনুমতি নেয়া ছিল। দুপুরের পরপরই রাজকীয় বহর উদ্যানে ঢুকল। এবং যাদুর মতই, বাগানের সমতল জায়গায় বিভিন্ন ধরনের তাবুঁ খাটানো হয়ে গেল যেন একটা ছোটোখাটো শহর গড়ে উঠেছে। যেন আলাদিনের প্রদীপের আশ্চর্য দৈত্যের মত কেউ শূন্য থেকে এটি তৈরি করেছে এবং এর প্রাণ দান করেছে। হাতুড়ির শব্দে বোঝা যাচ্ছিল ঘোড়াগুলোর খুর মেরামতি চলছে। অস্ত্রধারীরাও শীঘ্রই অস্ত্রে শান দিতে শুরু করল কেননা তারা খবর পেয়েছে যে পরদিন সকালেই বড় ধরনের শিকার অভিযান হবে। বহরের খানাপিনার ব্যবস্থা করাও কম বড় কাজ নয়, এবং শীঘ্রই রান্নার তাঁবু থেকে ক্ষুধা উদ্রেককারী ঘ্রাণ ভেসে আসতে লাগল। সবকিছুর ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে অত্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যেন আরাম-আয়েশের কোনো উপকরণই বাদ না পড়ে।

সরাইটির আকার প্রকাণ্ড বড়, যদিও একটু নিচু। রোদে-শুকানো ইট দিয়ে এটা বানানো হয়েছে, আর এর দেয়াল আচ্ছাদিত করা হয়েছে মনোহারী টাইলস দিয়ে। এর সামনের দিকে খাঁজযুক্ত পিলারের ওপর একটি বিরাট হল ঘর তৈরি করা হয়েছে যেখানে সুলতানের নিজস্ব বহরের সবাইকে অভ্যর্থনা জানানো হল। হলটি এতই বড় যে সুলতান চাইলে এখানে একহাজার লোককে সাক্ষাৎ দিতে পারবেন। সমস্ত আয়োজন আগে থেকেই এমন দক্ষতার সঙ্গে পরিকল্পনা ও সম্পন্ন করা হয়েছে যে একদল চাকর যখন অতিথিদের নিজ নিজ কক্ষ দেখিয়ে দিল তখন কোনরূপ বিশৃঙ্খলা, বিলম্ব বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হল না। যারা অজু করতে চান, বা ভ্রমণের সময় গায়ে লাগা ধুলোবালি ধুয়ে ফেলতে চান, তাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করা হল। আর ভোজন আয়োজনের তো কথাই নেই। প্রধান খাবার ছিল পেস্তাবাদাম এবং আলম- দিয়ে ঠাসা আস্ত একটা পাহাড়ি খাসি। কিসমিস, অ্যাপ্রিকট, খোর্মা আলু, আর ডালিমদানা মিশ্রিত ভাত দিয়ে ঢেকে ওটা পরিবেশন করা হল। জ¦লন্ত উনুনে ভাজা ঘি-মাখানো বুনোপাখি, ঝর্ণা থেকে ধরে আনা মাছ আর হরেক রকমের তাজা ফল সে খাবারকে আরও সুস্বাদু করে তুলল। রাজধানী থেকে এত দূরে এত অল্প সময়ে এত বৈচিত্রপূর্ণ ও উপাদেয় খাবারের আয়োজন দেখে অতিথিরা অবাক হয়ে গেল।

সুলতান তাঁর প্রধানমন্ত্রী নিজাম-উল-মুলক, ভাস্তে ইব্রাহিম নিয়াল এবং ওমরকে তাঁর সঙ্গে খেতে বললেন। ওমর মালিকশাহের সঙ্গে বসে খাচ্ছেন এটা অনেকের চোখে পড়লো, এবং নিশাপুর থেকে আসা গণ্যমান্যদের মধ্যে দ্রুতই খবরটা ছড়িয়ে গেল। তাঁর সৌভাগ্যে কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হলো। তারা ঘটনাটাকে ওমরের সমালোচনার হাতিয়ার বানাল, যদিও অন্য অনেকে নিশাপুরের সন্তানের সমাদরে গর্বও অনুভব করল। 

সন্ধ্যাটা কাটল গল্পগুজব আর গান শুনে। হিমেল বাতাসে প্রজ্জ্বলিত শিখাগুলোর ঝলকানো লালাভ আলো আর ভুতুড়ে ছায়ায় ভারত থেকে আসা নর্তকীরা কখনো শান্ত কখনোবা আদিরসাত্মক ভঙ্গীতে নাচছিল। তাদেরকে পুরস্কার দিয়ে বিদায় করে সুলতান তাঁর গল্প বলিয়েদের ডাকলেন। ইব্রাহিম নিয়ালও নিশাপুরের সেরা গল্পবলিয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। সেসময় প্রাচ্যের লোকজন গল্প শুনতে পছন্দ করত। অনেকটা বাচ্চাদের মত, একই গল্প বারবার শুনতেও তাদের আপত্তি ছিল না। দুদলের পাল্লা দেয়া গল্পের পালা শেষ হলে তুমুল হাততালি চলল। ওমরও অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে গল্প শুনছিলেন এবং মজা পাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে সুলতান হঠাৎ তাঁকে বললেন, 

“আমাদের ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়েছে। ছন্দ ও তালের নাচ আমাদের চোখ ভরিয়েছে, মজার মজার গল্প আমাদের কানে মধু বর্ষণ করেছে। এবারে আপনার পালা, হে কাব্যের রাজপুত্র। দয়া করে আবৃত্তি করুন আপনার বিখ্যাত রুবাই, যেগুলোর খ্যাতি পাহাড়মালা পেরিয়ে সুদূর মার্ভেও পৌঁছেছে। পাহলভি সঙ্গীতের সুরে দুয়েকটা রুবাই নিঃসন্দেহে এই সন্ধ্যার আনন্দ বাড়িয়ে দেবে।”

ওমর অত আত্মসচেতন ছিলেন না, বরং ছিলেন সরল ও প্রশান্ত। তিনি পীড়াপীড়ির অপেক্ষা করলেন না। বুকে হাত রেখে তিনি নিচু হয়ে অভিবাদন করলেন, তারপর প্রথামাফিক প্রশস্তি দিয়ে শুরু করলেন।

“স্রষ্টার প্রশংসা করি, যিনি কতই না মহান! আজ সত্যিই এক পরম দিন যা মালিকশাহকে নিরাপদে আমাদের সুন্দর উপত্যকায় নিয়ে এসেছে। এই ভৃত্যের তো তেমন ভাষা নেই যে তাঁর যথাযোগ্য প্রশংসাগীত গাইব। কিন্তু যেহেতু আদিষ্ট হয়েছি তা পালন তো করতেই হবে। উপস্থিত রচনা করছি বলে অত ভালো নাও হতে পারে, সেজন্য আগেই ক্ষমা প্রার্থনা করছি।” 

তারপর, সকলকে অবাক করে, পরিষ্কার সুরেলা কণ্ঠে বিশুদ্ধ ফার্সি ভাষায় তিনি এমন একটা চতুষ্পদী আবৃত্তি করলেন যা আজও এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরনো পাণ্ডুলিপিতে* সংরক্ষিত আছে:

কাহা ফালাকাত বেখুসরাভি তাইন কারদ,
অজ বাহরে তো আসবে পাদশাহী,
তা দার হারিকাত সামানদে জাররিন সোমে তো
বার গুল নানাহাত পাই জামিন সিমিন কারদ।**

ভাগ্য তোমাকে বানাল আলামপনা,
শাসন-অশ্বে সমারুঢ় জাঁহাপনা,
যেখানেই সে ফেলেছে তাহার খুর
সে মাটি হয়েছে স্বর্ণের দামী কণা***

তিনি এমন সুন্দর করে আবৃত্তি করলেন, এমন মার্জিত ও যথার্থভাবে এটা রচনা করলেন যে, নিজামউলমুলক আগে থেকেই বন্ধুর প্রতিভার কথা জানলেও আজ যেন আরও বেশি গর্বিত হলেন। আর সুলতান ওমরকে অনুরোধ করলেন চতুষ্পদীটি বাঁধাই করে এই সুন্দর সন্ধ্যার স্মারক হিসেবে তাঁকে উপহার দিতে। তাঁর ইঙ্গিতে সান্ধ্য-উৎসবের সমাপ্তি ঘটল। 
-----------------
* অক্সফোর্ডের বডলিয়ান পাঠাগারে সংরক্ষিত পাণ্ডুলিপিটি এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত খৈয়ামের রুবাইয়াতের সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি হিসেবে স্বীকৃত। খৈয়ামের মৃত্যুর প্রায় সাড়ে তিনশত বছর পর ইরানের বিখ্যাত সিরাজ নগরীতে জনৈক মাহমুদ ইয়ারবুদাকি হিজরী ৮৬৫ তথা ১৪৬০ খ্রিষ্টাব্দে এটি সঙ্কলন করেন। এতে মোট ১৫৮টি রুবাই স্থান পেয়েছে। আলোচ্য রুবাইটি এর ৭০ নং ক্রমিকে অন্তর্ভূক্ত। বিখ্যাত আর কোনো পাণ্ডুলিপিতেই এ রূবাইটি দেখা যায় না। ঘটনাক্রমে মালিকশাহের প্রশস্তি গেয়ে রচিত বলে হয়ত পাণ্ডুলিপি সঙ্কলকগণ খৈয়ামের রবাইয়াতে এটি অন্তর্ভূক্ত করেননি। কিন্তু প্রাচীনতম পাণ্ডুলিপিটি অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য পাণ্ডুলিপি হিসেবে পরিগণিত। অধ্যাপক ই বি কাউয়েল অক্সফোর্ডে এ পা-ুলিপির সন্ধান পান এবং একটি অনুলিপি তৈরি করে খৈয়ামের সবচেয়ে বিখ্যাত অনুবাদক ফিটজেরাল্ডকে দেন। ফিটজেরাল্ড মূলত এই পাণ্ডুলিপি থেকেই রুবাইয়াত অনুবাদ করেছিলেন, যদিও তিনি এর সবগুলো অনুবাদ করেননি এবং কখনো কখনো মূলকে অনুসরণ করেননি। ফিটজেরাল্ড অবশ্যি কোলকাতা থেকে কাউয়েলের পাঠানো আরেকটি পাণ্ডুলিপিরও সহায়তা নিয়েছিলেন।

** ফার্সির সব উচ্চারণ বাংলায় পুরোপুরি ধারণ করা কঠিন। যতটা সম্ভব কাছাকাছি উচ্চারণ দেয়া হয়েছে। মূল উপন্যাসে রুবাইটির কেবল অর্থ দেয়া আছে, পাঠকদের সুবিধার্থে অনুবাদক বাংলা অনুবাদে বাংলায় ফার্সি রুবাইটির উচ্চারণ সংযুক্ত করেছেন।

*** রুবাইটির বাংলা অনুবাদ কবির চান্দকৃত। 

কিস্তি চার: পুরনো বন্ধুদের সাক্ষাৎ