অরুন্ধতীনগরের বাড়িটি মহান ইতিহাসের গর্বিত সাক্ষী, সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশকেই
শেখ আদনান ফাহাদ, শিক্ষক ও গবেষক
প্রকাশিত: ০৪:৩৮ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শুক্রবার আপডেট: ১২:২১ পিএম, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শনিবার
একটা আধাপাকা টিনশেড ঘর। অথচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। এই ঘর মহান এক ইতিহাসের গর্বিত সাক্ষী। সেই ইতিহাস, যা আমাদের অনেকেরই অজানা। এমন একটি ঘর সম্পর্কে আমরা আজ জানব যেখানে ১৯৬৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপনে দুই সপ্তাহ অবস্থান করে তৎকালীন ভারত সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনইতিক দলের সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এমন এক উপাখ্যান যার পরিপূর্ণ লিপিবদ্ধকরণ এখনো সম্ভব হয়নি। সেই কবে বহিরাগত আর্যদের হাতে স্বাধীনতা হারিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের টিকে থাকার লড়াই শুরু! কয়েক হাজার বছর পথ পেরিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ক্রমশ বাঙালী হয়ে উঠা এবং চূড়ান্তভাবে ১৯৭১ সালে একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের মালিক হওয়ার গৌরবময় যাত্রায় যে রাজনীতিবিদ বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রধান রুপকার হয়ে উঠেছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালী জাতির পিতা এই সুমহান রাজনীতিবিদের রোমাঞ্চকর জীবনের অজস্র ঘটনার মধ্যে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব বা বলা যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে আজকের এই লেখা।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন নিয়েই যত আলোচনা। কিন্তু উনার জীবন তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্মাণের পথ পরিক্রমায় সামরিক এবং কূটনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা কম। সব আলোচনা এই এক লেখায় সম্ভব নয়। তবে আলোচ্য নিবন্ধে আমরা এমন কিছু জানব যা আমাদের অনেকের আগে জানা ছিল না। এই লেখায় আমরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা শহরের এমন একটি বাড়ি সম্পর্কে জানব যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সাথে থাকা প্রতিনিধি দল প্রায় দুই সপ্তাহ গোপনে অবস্থান করেছিলেন। ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে শেখ মুজিবের সেই আগরতলা যাত্রা এবং প্রায় পক্ষকালব্যাপী সেখানে অবস্থান সাধারণ মানুষের কাছে তো বটেই, অনেক প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসবিদের কাছেও অজানা।
‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ ১৯৬৮ সালে দায়ের করা হলেও শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় গমন করেন ষাটের দশকের শুরুতেই। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ভারতীয় কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা লাভের আশায় শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম আগরতলা গমনের প্রয়াস পান ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। দ্বিতীয়বার একই উদ্দেশ্যে আগরতলা গমন করেন ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে। তবে কোনো কোনো লেখক শেখ মুজিবের আগরতলা গমনের সাল সম্পর্কে নিজেরা সুনিশ্চিত না হওয়ায় ইতিহাস লেখায় বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন। দৈনিক সিলেট সংলাপ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক, লেখক আ ফ ম সাঈদ নিজ গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা: ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস’ গ্রন্থে শেখ মুজিবের ১৯৬২ সালে আগরতলা গমন নিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান আর এন কাও এর রেফারেন্স দিয়েছেন।বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আর এন কাও বলেন, ১৯৬২ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু গোপনে আগরতলা গিয়েছিলেন দিল্লী যাওয়ার উদ্দেশ্যে-এ তথ্য তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাকে আগে জানিয়েছিলেন। তখন ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের একজন সচিবের মাধ্যমে দিল্লীর সাথে বঙ্গবন্ধুর যোগাযোগ হয়েছিল। দিল্লী গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে তিনি আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। যথাসময়ে বঙ্গবন্ধু আগরতলা সীমান্তে গেলেও তাঁকে বিএসএফের হাতে গ্রেফতার হতে হয়। বঙ্গবন্ধুর সহযোগী বলেছেন, যাঁদের অভ্যর্থনা জানাবার জন্য আসার কথা ছিল, তাঁরা দেরীতে এসেছিলেন বলে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল (সাঈদ২০১৭:২৯)।
আগরতলার এই বাড়ীতে সবাইকে নিয়ে প্রথম যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তারপর মধ্যরাতে অরুন্ধতীনগরের বাড়ীতে চলে যান, ছবি: শেখ আদনান ফাহাদ
সাংবাদিক সাঈদ তাঁর বইতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার রেফারেন্সও দিয়েছেন। সাঈদ লিখেছেন, শেখ হাসিনা ১৯৯২ সালের ২৬ মে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট এ সাবেক মুখ্যসচিব রুহুল কুদ্দুসের ৬৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত আলোচনাসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন : “শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটি সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করেন। এ জন্যে তিনি ৬২ সালে সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করেন। ১৯৬২ সালেই শেখ মুজিব সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় যান। সেখান থেকে ফিরে আসার পর তাঁকে গ্রেফতার করে দুদিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করার স্থান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বেছে নিয়েছিলেন চট্টগ্রামের টাইগার পাস এবং কালুরঘাট। এ দুটি স্থান থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কথা ছিল” (সাঈদ২০১৩:২৯)। ১৯৯২ সালের ২৭ মে ইংরেজি দৈনিক মর্নিং সান পত্রিকায় বার্তা সংস্থা ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি)’র বরাত দিয়ে এ খবর প্রকাশিত হয় বলে লিখেছেন আ ফ ম সাঈদ।
স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের একজন মরহুম আব্দুর রাজ্জাকের এক সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়েও শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৬২ সালের আগরতলা গমনের খবরকে পাকাপোক্ত করেছেন সাংবাদিক আ ফ ম সাঈদ। আব্দুর রাজ্জাক ১৯৮৭ সালের ২৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক মেঘনায় এক সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। সেখানে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালে একটা ডেসপারেট মুভ নিয়ে আগরতলা যান। তখনও ব্যাপারটা ম্যাচুরড হয়নি। তিনি আগরতলা গিয়ে এরেস্ট হয়ে যান। আগরতলা থেকে দেশে ফিরে এলে তিনি ধরা পড়েন”।
১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধু আগরতলা গমন করলেও সেই প্রচেষ্টায় তেমন সাফল্য না নিয়ে ফিরে আসেন ‘পূর্ব-পাকিস্তান’ এ। ১৯৬৩ সালে আগরতলায় গিয়ে তিনি যে প্রায় পক্ষকালব্যাপী অবস্থান করেন সেটি আমরা সুনিশ্চিত হতে পারি ত্রিপুরার গবেষক ও লেখক প্রয়াত হরিভূষন পাল এর লেখা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ফিরে দেখা’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে। তিনি নিজে বিশদ অনুসন্ধান চালিয়ে ইতিহাসের খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য খুঁজে বের করেছেন। তিনি লিখেছেন, ১৯৬৩ সালে শেখ মুজিব আগরতলায় এসেছিলেন গোপনে সীমান্ত করে, পাকিস্থান সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী তখন শচীন্দ্রলাল সিংহ।হরিভূষন পাল তাঁর গ্রন্থে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের নিজের হাতে লেখা একটি বিবৃতি সংযুক্ত করেছেন। সিংহ বাবু এই বিবৃতিটি ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর কাছে হস্তান্তর করেছিলেন বলে জানিয়েছেন গবেষক হরিভূষণ পাল। বিবৃতিটি নিম্নরূপ:“১৯৬৩ সালে আমার ভাই এম, এল, এ উমেশ লাল সিং সমভিব্যাহারে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ১০ (দশ) জন ত্রিপুরার পশ্চিম জিলার খোয়াই মহকুমা দিয়া আগরতলায় আমার বাংলা বাড়ীতে রাত্রি ১২ ঘটিকায় আগমন করে। প্রাথমিক আলাপ আলোচনার পর আমার বাংলা বাড়ী হইতে মাইল দেড়েক দূরে ভগ্নী হেমাঙ্গিনী দেবীর বাড়ীতে শেখ সাহেব আসেন। সেখানেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। তারপর মুজিব ভাই-প্রস্তাব অনুযায়ী আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর সাথে দেখা করি। আমার সাথে ছিলেন চীফ সেক্রেটারি শ্রীরমন। তাকে (শ্রীরমনকে) শ্রীভান্ডারিয়ায় (বিদেশ সচিব) ঘরে রাখিয়া আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি। নেহেরু মুজিবর রহমানকে ত্রিপুরায় থাকিয়া প্রচার করিতে দিতে রাজী হয় নাই। কারণ চীনের সাথে যুদ্ধের পরে তিনি এত বড় ঝুঁকি নিতে রাজী হন নাই। তাই ১৫ (পনের) দিন থাকিয়া তিনি (শেখ মুজিব) সোনামুড়া দিয়া ত্রিপুরা ত্যাগ করেন। সোনামুড়া পশ্চিম ত্রিপুরার এক মহকুমা, কুমিল্লার সাথে সংলগ্ন। শেখ মুজিবকে সর্বপ্রকার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়”। ত্রিপুরার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর এই লিখিত বিবৃতির সূত্র ধরে ১৯৬৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ভারত গমনের বিষয়টির বিস্তারিত জানার আপ্রাণ চেষ্টা চালান গবেষক হরিভূষণ পাল। অবশেষে ত্রিপুরার প্রবীণ সাংবাদিক, দৈনিক জাগরণ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শ্রী জিতেন্দ্র চন্দ্র পাল মহোদয়ের কাছ থেকে বাড়তি কিছু তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। জিতেন্দ্র বাবু একদিকে যেমন ত্রিপুরার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের অন্তরঙ্গ ছিলেন তেমনই তাঁর সম্পাদিত ‘জাগরণ’ পত্রিকাও ত্রিপুরা জুড়ে বেশ জনপ্রিয় ছিল। জিতেন্দ্র চন্দ্র পাল, লেখক হরিভূষণ পালকে সে সাক্ষাতে জানিয়েছিলেন-“১৯৬৩ সালে তখন সম্ভবত নভেম্বর মাস। শীত একটু একটু পড়তে শুরু করেছে। সীমান্তের ওপার থেকে মুখ্যমন্ত্রী শচীনবাবুর কাছে গোপন সংবাদ আসে যে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান আগরতলায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ও কথা বলতে চান। পূর্ব বাংলার গণ আন্দোলনে সহানুভূতিশীল শচীনবাবু খোয়াই সীমান্ত দিয়ে তাদের আগরতলায় আসার ব্যবস্থা করে দেন। শচীনবাবুর ভাই উমেশবাবুকে খোয়াই পাঠানো হয় শেখ মুজিব ও তাঁর সঙ্গীদের উপযুক্ত সম্মান দিয়ে ও সাবধানে আগরতলায় নিয়ে আসার জন্য। খোয়াই’র মহকুমা শাসককে নির্দেশ দেওয়া হয় অতিথিদের ত্রিপুরায় প্রবেশ করার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। উমেশবাবু খোয়াই’র এস. ডি. ও.’র সাহায্যে দুটি জীপে করে শেখ মুজিব এবং তাঁর সঙ্গীদের আগরতলায় যখন নিয়ে আসেন তখন মধ্যরাত্র। শচীনবাবুর সঙ্গে সামান্য আলোচনার পর অতিথিদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করা হয় অরুন্ধতীনগরে স্বয়ং উমেশবাবুর বাসস্থানে, যা প্রকৃতপক্ষে ছিল শচীনবাবুর ভগ্নী হেমাঙ্গিনী দেবীর বাড়ি। অন্যদের আগরতলা শহরের মধ্যেই আরও দুই জায়গায়, শচীনবাবুর অতি কাছের লোকদের বাড়ীতে যার অন্যতম আগরতলার পুরানো কর্নেল বাড়ী”।
বাড়িটির বর্তমান চিত্র, যা সম্প্রতি খুঁজে বের করেন আগরতলার নামী গবেষক পার্থসারথি চক্রবর্তী
হরিভূষণ পালের বইতে লেখা রয়েছে যে, দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে শচীনবাবুর আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় আগরতলায় ফিরে এসে তিনি বাধ্য হন শেখ মুজিবদের পূর্ব পাকিস্তানে ফেরৎ পাঠাবার ব্যবস্থা করতে। এই ক্ষেত্রে তিনি ‘বিদেশি অনুপ্রবেশ আইন’-এর সাহায্য নেন। শেখ মুজিব ও তাঁর সঙ্গীদের ‘পুশব্যাক’ করা হয়। এবং আইন বাঁচাতে, পুশ ব্যাকের আগের রাত্রিটা শেখ মুজিবদের কাটাতে হয় আগরতলার কেন্দ্রীয় কারাগারে, অবশ্যই ‘বিশেষ’ ব্যবস্থাপনায় ও ছদ্মনামে। ভোর হবার মুখে কসবা ও সোনামূড়া সীমান্ত দিয়ে দুইভাগে অতিথিদের পূর্ব পাকিস্তানে ফেরৎ পাঠানো হয়। ফেরৎ পাঠানোর এই প্রক্রিয়াটি যেন নির্বিঘ্নে ঘটে সে জন্যস্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেতার প্রত্যক্ষ তদারকিতে ছিলেন সদর মহকুমার তৎকালীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ এস. ডি.ও.। ঐ সময়ে যারা শেখ মুজিব ও অন্য অতিথিদের সেবাযত্ন করার সুযোগ পেয়েছিলেন আগরতলার সেই ভাগ্যবানদের একজন শচীন বাবুর এ. সি.এস. সত্যেন সিং (অনু)। শেখ মুজিবের সঙ্গি অতিথিদের মধ্যে ছিলেন জনপ্রিয় দৈনিক ‘ইত্তেফাক’-এর সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়া এবং ঐ পত্রিকারই আরও দুইজন সাংবাদিক (পাল২০০৪: ১৯-২০)।
হরিভূষণ পালের লেখা সে বই ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে অনেক তথ্য আছে তাঁর বইতে। তিনি লিখেছেন ১৯৬৭ সালে শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা যান নি। তিনি লিখেছেন, “আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান ১৯৬৭ সালে গোপনে বা প্রকাশ্যে আগরতলায় আসেননি। পাকিস্তান সরকারও এমন কোন অভিযোগ চার্জসীটে উল্লেখ করেননি। যিনি এসেছিলেন তিনি নৌবাহিনীর স্টুয়ার্ড মুজিবর” (পাল ২০০৪: ১৮)।
প্রিয় পাঠক, ১৯৬৩ সালে শেখ মুজিবের আগরতলা গমনের ইতিহাসের সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা মুজিব বাহিনী খ্যাত বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (বিএলএফ) ইতিহাস একটু মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করুন। বর্তমান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারমুজিব বাহিনীর সদস্য ছিলেন। দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় ২০১৫ সালে একটি কলাম লিখেন। ‘একুশ শতক, ভুলে যাওয়া মুজিববাহিনী’ শীর্ষক সেই লেখায় তিনি বলেছেন, ‘মুজিব বাহিনীর জন্ম হয়েছে সেই স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের নেতৃত্বে। এবং সেই বিপ্লবী সংস্থাটি ষাটের দশক থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে, পরিকল্পনা করেছে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার সকল কাজই সফলতার সংগে করতে পেরেছে’। উল্লেখ্য যে, ষাটের দশকের শুরুতে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। তারও আগে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অ্যাসেম্বলি হলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রলীগ, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ এবং ১৯৭১ সালের মুজিববাহিনীর ইতিহাসগুলো জোড়া দিয়ে এক সাথে দেখলেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর তৎপরতার সামরিক এবং কূটনৈতিক দিক আমাদের সামনে পরিষ্কার হবে। পাকিস্তান আমলে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীরা বঙ্গবন্ধুকে একটা বিশেষ নামে ডাকতেন। বলা যায়, একটা সাংকেতিক নাম ব্যবহার হত বঙ্গবন্ধুর। সেই নামটি ছিল ‘পরশ’। সাংবাদিক আ ফ ম সাঈদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি নূর মোহাম্মদ এর একটি সাক্ষাৎকার তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সেখানে নূর মোহাম্মদ জানিয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুর অনুমতি ও আশীর্বাদ নিয়ে পাকিস্তান আমলেই গোপনে বেঙ্গল লিবারেশন আর্মি গঠন করা হয়। নূর মোহাম্মদের বরাত দিয়ে সাংবাদিক আ ফ ম সাঈদ লিখেছেন, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু এই বেঙ্গল লিবারেশন আর্মির কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল গঠন করেন। এই কাউন্সিলের সব সদস্যের একটি করে কোড ছিল। যেমন বঙ্গবন্ধু-পরশ, কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন-আলো, স্টুয়ার্ড মুজিব-মুরাদ, সুলতান-কামাল, রুহুল কুদ্দুস সিএসপি-শেখর, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি-তুষার, লেফট্যানেন্ট মোজাম্মেল হোসেন-উল্কা এবং নূর মোহাম্মদ-সবুজ। ‘পরশ’ নাম নিয়ে বঙ্গবন্ধু সেই ষাটের দশক থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার গোপন সামরিক ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যমণি হয়ে কাজ করেছেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি সফল বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য এই প্রয়াস চালু ছিল। কিন্তু কোনো একটা গোপন মিটিং এ পাকিস্তানী এজেন্ট লুকিয়ে থাকায় সেই মহাপরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায় এবং শেখ মুজিবসহ বাকিরা গ্রেফতার হয়ে যান।
২০১৩ সালে ব্যক্তিগত কাজে আগরতলা গিয়ে সেখানকার বইমেলায় যাই। একটি স্টল থেকে হরিভূষণ পালের লেখা, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ফিরে দেখা’ গ্রন্থটি সংগ্রহ করি। সে সফর শেষ করে ভারত থেকে দেশে ফিরে বইটি পড়তে গিয়ে আগরতলার অরুন্ধতীনগরের বাড়িটির সন্ধান পাই। পরবর্তীকালে দীর্ঘদিন পরে ২০১৯ সালে ‘আমার নিজের লেখা’ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও গণমাধ্যম ভাবনা’ শীর্ষক গ্রন্থের কাজে আমি পুনরায় আগরতলা গমন করি। সেই সফরে আমি অরুন্ধতীনগরের বাড়িটি খুঁজে বের করি। আমাকে এ দারুণ সফরে সহায়তা করেছিলেন আগরতলায় আমার প্রিয় মানুষ শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী দাদা। অতি সম্প্রতি আগরতলার খ্যাতনামা আলোকচিত্র শিল্পী ও লেখক পার্থসারথি চক্রবর্তী এই ঐতিহাসিক বাড়িটি আবার খুঁজে বের করে ছবি তোলে সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। অরুন্ধতীনগরের বাড়িটি ছাড়াও, আগরতলার পুরানো কর্নেল বাড়ী, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের বাড়ি এবং হরিভূষণ পালের লেখা অনুযায়ী আগরতলার পুরনো জেলখানা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগরতলা সফরের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারের উচিত হবে এই স্মৃতি সংরক্ষণ করা। এবং এই সফরে অবদান রাখা সবাইকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সম্মাননা জানানো উচিত বলে মনে করি।
শেখ আদনান ফাহাদ, বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যায়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়