মাছ থেকে মানুষ
শেখ আনোয়ার
প্রকাশিত: ০৫:০৫ পিএম, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার আপডেট: ০৫:০৮ পিএম, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার
জলজ জীব হচ্ছে পৃথিবীর আদিম প্রাণী। বিবর্তনের মাধ্যমে এই প্রাণীরা ডাঙ্গায় বসবাসকারী জীবে রূপান্তরিত হয়। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি আবিষ্কার করেছেন তিনশত বছরের প্রাচীন আঁশে ঢাকা বৃহদাকার মাছের কঙ্কাল। এ রকম মাছের কঙ্কাল এর আগে আর আবিষ্কৃত হয়নি। বিজ্ঞানীরা তাই বলছেন, এ ধরনের মাছ থেকে ডাঙ্গায় বাস করা চার হাত পেয়ে প্রাণীর উৎপত্তি হয়েছে। ন্যাচার ম্যাগাজিনে এক রিপোর্টে বলা হয় শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী নিল এইচ সুবিনের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী নর্থ পোল থেকে ছয়শত মাইল উত্তরে কানাডিয়ান আর্কটিক সাগরপাড় থেকে মাছের এই ফসিল আবিষ্কার করেন।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাছের সামনের দিকের পাখনা, আঁশ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য থেকে মনে হচ্ছে এটি ছিলো রাক্ষুসে মাছ। এর দৈর্ঘ্যের পরিমাণ চার থেকে নয় ফুট। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এর অ্যানাটমিক বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে বলেছেন, এটি যদিও মাছ তবে এতে যে পরিবর্তন ঘটেছিলো তা থেকে অনুমান করা যায় এটি থেকে স্থলজ প্রাণীর উৎপত্তি হয়েছে। এবং এভাবে এটি থেকে উভচর প্রাণী তারপর সরীসৃপ, স্তন্যপারী প্রাণী এবং তা থেকে ক্রমে মানুষে রূপান্তরণ ঘটেছে।
মাছটির সামনের পাখায় বিজ্ঞানীরা বাহু তৈরি হওয়ার আলামত পেয়েছেন। এছাড়া মাছটিতে আঙ্গুল, কব্জি, কনুই এবং কাঁধও হতে শুরু করেছিলো বলে বিজ্ঞনীরা জানান। এছাড়া মাছটির চ্যাপ্টা খুলি অনেকটা কুমিরের খুলির মতো। মাছটির ঘাড়, পাঁজর এবং অন্যান্য অংশ চার পেয়ে বা ট্রেট্রাপড নামক এক প্রকার স্থলজ প্রাণীর মতো। অন্যান্য বিজ্ঞানীরা বলছেন, ফসিলটিতে বড় রকমের রূপান্তরের প্রমাণ ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত খন্ডন করতে পারবে যা রূপান্তরগত দূর্বলতার কথা বলে ডারউইনের তত্বকে খারিজ করেছে। বিজ্ঞানীরা ফসিলটিকে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত রূপান্তরের বড় দৃষ্টান্ত মাছ থেকে চারপা প্রাণীর বলে দাবি করেছেন।
কানাডার নুনাভার্ট রাজ্যের বয়োজ্যেষ্ঠদের মতে মাছটির নাম টিকটালিক। বাহুর উৎপত্তি সম্পর্কে বিজ্ঞানী সুবিন বলেন, সম্ভবত; মাছের পাখা বৃদ্ধি ও বিকশিত হয়ে বাহু হয়েছে। যেমনটা টিকটালিক মাছের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়। এক সাক্ষাৎকারে বিবর্তন জীববিজ্ঞনী ড. সুবিন আরও বলেন, ফসিলটি খুবই জরুরি এবং অসামান্য। তিনি বলেন, এটিকে অনেকটা হলিকাউ বলা যায়। দু’জন জীবাশ্মবিদ এ ফসিলের আবিষ্কার সমন্ধে বলেছেন, রূপান্তর হচ্ছিলো এরকম আরও কিছু মাছের ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছিলো যা তিনশত পঁচাশি বা তিনশত ঊনষাট মিলিয়ন বছর আগে ডেভোনিয়ান যুগের শেষ দিকের। কিন্তু টিকটালিক একটি মধ্যবর্তী অবস্থা যার সঙ্গে মাছ এবং মেরুদন্ডী প্রাণীর সম্পর্ক রয়েছে। তারা বলেন, এটি বিবর্তন বা রূপান্তরের একটি নির্দেশক হতে পারে।
কিন্তু সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও লেখক অ্যারিক আলবার্গ এবং ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জেনিফোর অ্যা ক্লার্ক সুবিনের দলের টিকটালিককে মধ্যবর্তী অর্থাৎ মাছ ও স্থলজ প্রাণীতে রূপান্তরের দাবিটা উড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের জীবাশ্ম বিদ্যার পরিচালক এইচ রিচার্ড লেন বলেন, এটি এক মহামূল্যবান আবিষ্কার, এর মাধ্যমে আমরা বিবর্তন আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবো। এ গবেষণায় অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়েছে যেসব প্রতিষ্ঠান তার মধ্যে রয়েছে সায়েন্স ফাউন্ডেশন এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি। এ ফসিল আবিষ্কারের পেছনে ড. সুবিন ছাড়া আরও যেসব আবিষ্কারক ছিলেন তারা হলেন, ফিলাডেলফিয়ার ন্যাচারাল হিস্ট্রির জীবাশ্মবিদ মাইকেল জে. নোভাসেক। তিনি বলেন, যা যা প্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে মাছ থেকেই চারপেয়ের উদ্ভব এ চিন্তাটা আরও শক্ত হয়েছে। এটি বিবর্তনের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যা আগে আমরা জানতাম না।
ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে, রক্ষণশীল খ্রিস্টানরা যার বিরোধিতা করছে। সেক্ষেত্রে এ বিরোধিতাকে মোকাবেলা করতে ড. সুবিনের টিম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে চুপচাপ। তারা বলেছেন, তাদের এ যুক্তি খন্ডন করতে হবে যে এক প্রকার ফসিল থেকে বিবর্তন ঘটে তা অন্য প্রকার হতে পারে না। ইনস্টিটিউট ফর ক্রিয়েশন রিসার্চের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডন টি গিস বলেন, দাবিকৃত বিবর্তনশীল মাছটিকে খুব সতর্কভাবে বিশ্লে¬ষণ করে দেখতে হবে। তার মতে, তিনি বিবর্তনকে এখনও প্রশ্নাতীত মনে করেন না। কারণ জীবাশ্মবিদরা এখনও পর্যন্ত কোন বিবর্তনশীল ফসিল আবিষ্কার করতে পারেননি যা কিনা অমেরুদন্ডি এবং মাছের মধ্যবর্তী অবস্থা।
ড. সুবিন এবং ডায়েসলার তাদের অনুসন্ধান শুরু করেন দু’হাজার আঠেরো সালে অ্যালসমার আইল্যান্ডে। ভূগোল মানচিত্রে ডেভেনিয়ান পাথরের ক্ষয়প্রাপ্ত ছবি দেখে তারা উৎসাহিত হন । তারা ভেবেছিলেন এটি খনন করা সহজ হবে। তারা যেসময় খনন কাজ চালাচ্ছিলেন সেটি ছিলো গরমের সময়। ড. সুবিন বলেন দু’হাজার উনিশের জুলাইয়ের আগে আমরা আসল জায়গায় যেতে পারিনি। তারা ওই জায়গায় অনেকগুলো মাছের কঙ্কাল পেয়েছেন। যার বেশির ভাগই ছিলো অক্ষত এবং ত্রিমাত্রিক। মাছগুলোর বড় খুলি এবং ধারালো দাঁত দেখে মনে হয় এগুলো শিকারি। মাছের দাঁতের সঙ্গে ঘাড়ের সংযোগ রয়েছে। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. জেনকিন বলেন, মাঝে মধ্যে পানি থেকে ওরা ডাঙ্গায় ওঠে। তাই এই মাছের মাথা স্বাধীনভাবে নড়াচড়ার জন্য শক্ত ঘাড় দরকার ছিলো। মাছগুলোর বক্ষে যে পাখনা তা হাড়ের ওপরের বাহু, কব্জি এবং প্রথমদিকে স্থলে বসবাসকারী প্রাণীর হাতের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। পাখনার যে জোড়া রয়েছে তা দেখে মনে হয় এটি স্থলে চলাচল করতে উপযোগী। সবকিছু বিবেচনা করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, টিকটালিক তার বাহু সদৃশ পাখনা দিয়ে সম্ভবত উপকূলে চলাচল করতো।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।