মূলাধারের সূত্রে চিত্রমালা
মোস্তফা জামান
প্রকাশিত: ০৯:০৭ পিএম, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সোমবার
কবি রবীন্দ্রনাথের ছবি যদি ‘মানসবিশ্বের এমন এক পর্যায়, যার পরিচয় অনেকেরই অজানা’ এমত স্তর থেকে জন্মেছিল, তবে শামসেত তাবরেজিও এমন নিশ্চেতনার স্তর থেকেই ছবি আঁকেন দাবি করা যায় কবি। দুই কবিই প্রামাণ ̈ আকার-আকৃতি থেকে দূরে থেকে সাকার বর্গীয় ছবির প্রণেতা।তারা বস্তুকে অপরিচিত বা নতুনতর মাত্রায় উন্নীত করে দর্শক সমীপে পেশ করেন।
যে কোন সাকারবাদী মানসলোক বা চৈতন্যের নৈরাকার বিষয়েরও আকার দিয়ে থাকেন। কবি রবীন্দ্রনাথের ছবিতে বিভিন্ন জন্তুর আকার যেমন, পাখি, সরীসৃপ, এমনকি কাল্পনিক সাপ হাজির হয়েছে। এগুলো নিরাকার (যাতে মানসলোক ও অজানালোক দুইই বর্তমান) আর আকারের দুনিয়ার মধ্যে মধ্যস্ততা করে। এইসব প্রাইমোর্ডিয়াল বা আদিম ভাব-প্রকাশকারী মূর্তির পাশাপাশি রবীঠাকুর তুলনামূলক সাবলীলতার সাথে এঁকে রেখে গেছেন অজস্র জ্যামিতিক বা আর্কিটেকচারাল মুখাবয়ব ও শরীর- এগুলো অধিকতর নিরাকারমূখী। রবীন্দ্রনাথ ও তাবরেজি দুজনে সাকারবাদী হওয়া সত্ত্বেও, শান্তিনিকেতনের কবি আর ঢাকার ক্রমবর্ধমান নাগরিক জটিলতার কবির ছবি দুই বিপরীত মেরুর প্রপঞ্চ তুলে ধরে।
কবির নির্মাণকর্মে স্বতঃস্ফূর্ততা অনিবার্য, আরও যা অনিবার্য তা হলো নির্মিত শিল্পবস্তুতে জগত বিষয়ে কিছু সত্য তুলে ধরার বাসনা। তাবরেজির কাজে সত্যভাষণ চিহ্নিত করা যায়। কবি রবীন্দধনাথ যদি এটার্নাল হিউম্যানিটির’ সূত্রে সার্বজনীন সত্য তুলে ধরে থাকেন, ঢাকার গোলমেলে আধুনিকতার কেন্দ্র থেকে তাবরেজি এক সতন্ত্রত স্বর তৈয়ার করে চলেছেন। একক ফর্ম বা মোটিফের বিপরীতে অজস্র ফর্মের সমারোহে চিত্রকল্প গড়ে তুলে এই শিল্পী ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তুলে ধরতে ছবি এঁকে চলেছেন।
রবিঠাকুরের দ্বিধা ছিল। তিনি ‘অসোয়াস্তি' লাগার কথা নিজমুখে স্বীকার করে গেছেন। বিশেষ করে প্যারিস ও বার্লিনের একক প্রদর্শনীর পর জনতার দরবারে চিত্রকলা বিষয়ে যে হৈ চৈ কাগজে হঠাৎ বিস্ফোরণ মতো দেখা গেল, তা নিয়ে কবির আত্মতৃপ্তি ও দ্বিধা দুইই লক্ষ্য করা গেছে। তাবরেজি এই দ্বিধাদ্বন্দে পতিত শিল্পী নন। কারণ তিনি ক্যানভাস, কাগজ, এমনকি বক্স ভেঙ্গে পাওয়া কার্ডবোর্ডে এক্রিলিকে যা রচনা করেন, তা কবির সৃষ্টি হিসাবে রচনা করেন না। এই কবি নিজেকে ‘সম্পূর্ণ’ চিত্রী হিসাবে গড়ে তুলেছেন।
তাবরেজির শিল্পীজীবনের শুরু হঠাৎ করেই। শিল্পীবন্ধু শিশির ভট্টাচার্য ও অন্যান্যরা তাকে শিল্পের পরিসরে পা দেয়ার দুঃসাহস যুগিয়েছেন। যে রসদ নিয়ে তিনি এই নতুন ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন, তা মোটেই প্রতিষ্ঠিত শিল্পভাষার সাথে সম্পর্কিত না।
নিউ ইয়র্কে বসে একদা জা মিশেল বাস্কিয়া যা রচনা করে গেছেন, তেমন ‘অপ্রকিতস্থ ধাঁচের চিত্রকল্প গড়ায় তাবরেজি সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছেন। বাস্কিয়ার প্রান্তিকতার সাথে তাবরেজির কতটা মিল, সেই তর্ক রেখে মনযোগ দেয়া জরুরি যে, বাংলাদেশের এই প্রতিষ্ঠিত কবি তার কাব্য ভাষা প্রান্তিক অবস্থান থেকে নির্মাণ করেছেন। মনে পড়ে তার ‘আবাগাবা’ শিরোনামের ছোট্ট এক কবিতা। এই সূত্রে তার ছবির সাকারত্বে যে মূলাধারের× প্রভাবের পাশাপাশি এক উদ্ভট বা অনির্ণেয় রসের প্রভাবও রয়েছে, এ বিষয়ে কিছু কথা বলা জরুরি।
আবাগাবা শব্দটি কবির বানানো। এই অর্থহীন শব্দটি মনের এমন এক অবস্থার দিকে নির্দেশ করে যা অন্য কোন শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এর অর্থদ্যোতনা এর অর্থহীনতার মধ্যেই বিরাজ করে। বা অবস্থা নির্দেশ করতে এই নির্মাণ ম্যাটোনিমি হিসাবে কাজ করে- যেনো এ এক হিমবাহের দৃশ্যমান অংশ যা এক বৃহৎ কলেবরের দিকে সহজেই নির্দেশ করে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা ধরতে চাওয়া শিল্পীরা এমন ম্যাটোনিমি বা লক্ষণার সূত্রে ছবি আঁকেন না। তারা আকার- ইঙ্গিতে কথা বলার সান্ধ্য দুনিয়াকে সন্দেহের চোখে দেখেন। সোভিয়েত বামপন্থার কুপ্রভাব হিসাবে একে চিহ্নিত করা যায়। তবে, এর গোড়ায় ইউরোপীয় পজিটিভিস্ট যা বিজ্ঞানমনষ্কতার সার অধিক পরিমানে আছে বললে মিথ্যা বলা হয় না। আসল কথা হলো শিল্পে পদার্থ ও পদের একরৈখিকতার যে ধারণা কলকাতা-ধর্মী আধুনিকতা, ঢাকা-ধর্মী রাজনৈতিকতায় লক্ষ্য করা গেছে তার বিপরীত পরিসরে দাঁড়িয়ে তাবরেজি এক প্রকার লক্ষণা-ভিত্তিক ছবি আঁকেন। পাশাপাশি তার কাজে স্নায়বিক দিকটিও স্পষ্টতর।
রূপের অপ্রকৃতিস্থ চরিত্রের কারণে তাকে যদি বাস্কিয়ার নিকটতম শিল্পী বলে দাবি করা হয়, এ বিষয়ে কিছুটা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। কবি জীবনানন্দ দাস আপন কবিতা বিষয়ে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন যে, কবিতা প্রাথমিকভাবে সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত উপায়ে গড়ে ওঠে, তারপর তাকে ‘প্রকৃতিস্থ’ করে তুলতে হয়। কবি জীবনানন্দ এই পদ্ধতিতে কবিতাকে রহস্যময়তার দুনিয়া থেকে অর্থময়তার দিকে নিয়ে আসতে চেষ্টা করতেন।
ছবির ক্ষেত্রে প্রকৃতিস্থ করে তোলার অর্থ অনেক সময় দৃষ্টিনন্দন করে তোলা বোঝায়। ছবি যাতে ‘ভিড়ের হৃদয়’ প্রশমিত করে প্রশংসা কুড়াতে পারে তাই এমন পথ বেছে নেয়া হয়। এমন সহজ উপায় তাবরেজি গ্রহণ করেন নাই- তিনি আত্মিক ও সামাজিকের মধ্যবর্তী এক পরিসর থেকে বাস্তবের যে পূর্ণ ও অসম্পূর্ণ প্রতিবিম্ব নির্মাণ করেন, তাতে সমাজ, মানব মন ও অঙ্কন বিদ্যার নানারকম উপসর্গ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
উপসংহারে বলা চলে যে এই কবির ভাষাভঙ্গিতে মনোদৈহিক এক মাত্রা লক্ষণীয়- অর্থাৎ তার কাজ পারফর্মেটিভ বা লীলাময়তার সাথে সম্পর্কিত। দেহে অবস্থিত মূলাধারের সুত্রে এমন লীলাময়তা জারি থাকে বিধায় তিনি জগতের অন্যাস্য লীলার খবর নানান চিহ্নের সূত্রে ছবিতে হাজির করেন।
শিল্পী প্রাক ও পরাচৈতনিক আয়নায় তার বাস্তব জীবনের অনুবাদ করে চলেছেন বললে ভুল হয় না। প্রাণশক্তির বা লীলাসমূহের উৎসের দিক নির্দেশ না করে, তাবরেজি জীবনপ্রবাহের মধ্যে বিরাজ করেন। বাংলাদেশের মূলধারার মানবকেন্দ্রীকতা, মানসলোকের সূত্র অনুসন্ধানী বিমূর্ততা অথবা রঙ, রেখা ও মোটিফের বিন্যানের প্রচলিত পদ্ধতি থেকে চোখ ফিরিয়ে, তিনি মূলাধারের সূত্রে ছবি এঁকে চলেছেন।
সূত্র:
১) অনুত্তম ভট্টাচার্য লিখিত ‘কবির ছবি: ছবির বই’ থেকে রবীন্দধনাথের চিত্রকলা বিষয়ে মন্তব্য।
২) হিন্দু সাধনায় মূলাধার হলো ভূমি বা মূল চক্র; দেহের সাতটি চক্রের প্রাথমিক চক্র এটি, যার সূত্রে মানব দেহ দুনিয়াদারীর সাথে যুক্ত থাকে।