ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস
ওমর, দ্য টেন্টমেকার ।। অনুবাদ: কবির চান্দ ।। মূল: নাথান হাসকেল
কবির চান্দ, লেখক ও অনুবাদক
প্রকাশিত: ০৬:৪৩ পিএম, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বুধবার আপডেট: ১১:৫১ পিএম, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বুধবার
এক. সুলায়মান পয়গম্বরের যাদুর গালিচা
সেই প্রাচ্য, যার পরিবর্তন ঘটে না!
আকাশের দিকে যারা তাকায় তারা বলে যে নক্ষত্রমণ্ডলী আজো সেরকমই রয়ে গেছে। কালপুরুষের কোমরবন্ধনী ফারাওর সময় যেমন ছিল আজো সেরকমই জ্বলজ্বল করছে। ক্যাসিও পিয়া আজও তার রত্নখচিত চেয়ারে সেরকমই সমাসীন। কেবল গ্রহগুলো নিয়তিনির্দিষ্ট অবশ্যম্ভাবী পথে ধেয়ে চলেছে। যদিও জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, যাদেরকে স্থির দেখায় সেই তারাদলও গোলকধাঁধাঁয় নাচের মতো ঘুরছে এবং দ্রুত ধাবমান সময়ের সাথে প্রতিমূহূর্তে জায়গা বদল করছে।
আমাদের গল্পের প্রেক্ষাপট সেই অপরিবর্তনশীল প্রাচ্য। পরিবর্তন হলেও আমরা হয়তো একজীবনে এর চিহ্ন টের পাবনা। এক শতাব্দীতেও হয়তো এখানকার অধিবাসীদের জীবন ও আচরণে তেমন কোনো বদল হবে না, কিন্ত ইতিহাসের পাতায় ছাপ রেখে যাওয়া এখানকার উন্নতি বা অবনতি জ্ঞানীর চোখে ঠিকই ধরা পড়বে। ইরানের সুন্দর উপত্যকাকে বিরানভূমিতে পরিণত করা বিবর্ণ ধ্বংসস্তুপের আড়ালে কোন রহস্য ওঁত পেতে আছে? দেশটির কাঁচের মত স্বচ্ছ নদীর বুকে হিল্লোল তুলে বয়ে যাওয়া কোমল বাতাসকে কুর্ণিশ করে ঘাসগুলো ফিসফিস করে কোন গল্প বলে? এই ধ্বংসস্তুপগুলো যেন এক বিস্মৃত সভ্যতার গূঢ়লিপি; এই ঘাসগুলো যেন দূর অতীতে নৈরাজ্যের কালো সাগরে ডুবে যাওয়া সমৃদ্ধির জন্য কাঁদে; তাদের ভাষা বুঝতে পারলে জানা যেত আরাম ও পরিশীলিত উৎকর্ষের পর সেখানে কী ভয়ানক তাণ্ডব নেমে এসেছিল।
বর্তমানের এই আধুনিক সভ্যতা শুরুর আগে কালের ঘড়ি বুঝি তার ঘন্টার কাঁটা দিয়ে আর কোনো যুগকে এমন করে চিহ্নিত করে রাখেনি। ইংল্যান্ডে তখন দ্য কনফেসর নামে খ্যাত এডওয়ার্ডের দীর্ঘ মঙ্গলময় রাজত্বের সমাপনী ঘটতে চলেছে; ফ্রান্স থেকে তখন দ্য কনকুয়ারার নামে পরিচিত উইলিয়াম নরমান নাইটদের বহর নিয়ে সমুদ্রে পাল তুলেছেন; স্পেনে রাজত্ব করছেন তৃতীয় সাঙ্কো, জার্মানিতে চতুর্থ হেনরি আর ফ্রান্সে প্রথম ফিলিপ রাজত্ব করছেন। মুসলমানদের হাত থেকে পবিত্রভূমি উদ্ধারের নামে লক্ষ লক্ষ লোকের জীবন বিনাশী ক্রুসেডের প্রবল ঢেউ উঠেছে ইউরোপ জুড়ে।
সিরিয়া এবং ইরাকে আরবদের দুর্বল হয়ে আসা মুষ্টি থেকে ক্ষমতার রজ্জু পিছলিয়ে গেছে। এশিয়ায় তুর্কি সেলজুক রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তুগরল বেগ বাগদাদের খলিফাকে বাধ্য করেছেন তার বিজয়ের ধর্মীয় স্বীকৃতি দিতে, তাকে পূবের সুলতান হিসেবে মেনে নিতে এবং তার কাছে নিজ কন্যাকে বিয়ে দিতে। কিন্তু উচ্চাশার পূর্ণ অর্জনের পূর্বেই ১০৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান, আর তার ভাগ্নে আল্প আর সালান তার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি তদীয় আমির আৎসিজের সহায়তার সেলজুকের গৌরব পতাকা আরও বিস্তৃত করেন, আলেপ্পো দখল করেন, সিরিয়া আর ফিলিস্তিন জয় করেন আর গ্রিকদের সঙ্গে যুদ্ধে তাদের সম্রাট রোমানাস ডাইওজেনিসকে বন্দী করেন। কিন্তু বিজয়ের চুড়ান্ত লগ্নে তিনি নিহত হন। আরেক বন্দী তুর্কি সর্দার ইউসুফ বারজামি জামার আড়ালে লুকানো ছুরি বের করে তাকে হত্যা করেন। আরসালানের ছেলে মালিক শাহ নিজ চাচা কাবুর্দকে হামেদানের* সংক্ষিপ্ত যুদ্ধে পরাস্ত ও হত্যাকরে আর কোনোবাধা-বিঘ্ন ছাড়াই সিংহাসনে আসীন হন। যোগ্য উজির হাসান, ইতিহাসে যিনি নিজাম-উল-মুলক নামে পরিচিত, তার রাজত্বকে সমৃদ্ধির সর্ব্বোচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে সহায়তা করেন। এমন সুযোগ্য ও উদার উজির প্রাচ্যে আর কখনো রাজদণ্ড ধরেছেন কিনা সন্দেহ।
এমনটা প্রায়ই ঘটে থাকে যে, যখন এক মহাদেশের বিস্তৃত এলাকা ঘন মেঘের চাদরে আবৃত অন্য কোথাও হয়তো নির্মল রোদেলা আকাশ। একাদশ শতাব্দীতে ঠিক তাই ঘটেছিল। বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে ইউরোপ তখন আধা-বর্বর, শিক্ষা-দীক্ষা কেবল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সীমাবদ্ধ। কোনো বড় কবি অমর কবিতা লিখছেন না, কোনো মহানশিল্পী রেখে যাচ্ছেন না তার উজ্জ্বল প্রতিভার উত্তরাধিকার। এমন সময়ে খোরাসান নামে পারস্যের এক সুদূর প্রদেশ সমৃদ্ধি ও মহিমার শিখরে অবস্থান করছিল।
যারা কল্পনা করতে ভালোবাসেন, তাদেরকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, আসুন নবি সুলায়মানের বিখ্যাত গালিচায়** চেপে বসি, আর মানসচক্ষে ঘুরে আসি খোরাসানের সেই গৌরবোজ্জ্বল অতীত থেকে।
---
* মূল বইতে “কামাদান” নামক স্থানে এ যুদ্ধ হয়েছিল উল্লেখ আছে। লেখক নাম লিখতে ভুল করেছেন। যুদ্ধটি হয়েছিল পারস্যের এককালীন রাজধানী হামেদানে।
** মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে নবি সুলায়মান গালিচায় বসে বাতাসে ভেসে ভ্রমণ করতে পারতেন। কোরআনেও ইঙ্গিত আছে যে বাতাস তাঁর আদেশ মানত এবংতিনি এ উপায়ে দুমাসের পথ একদিনে পাড়ি দিতে পারতেন।
[চলবে]