অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

চিড়িয়াখানায় অজগরের খাঁচায় জীবিত খরগোশ গুনছিলো মৃত্যুর ক্ষণ

কাইসার রহমানী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ০৮:০৪ পিএম, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ সোমবার   আপডেট: ১১:০৪ পিএম, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার

চিড়িয়াখানায় অজগরের খাচায় জীবিত খরগোশ

চিড়িয়াখানায় অজগরের খাচায় জীবিত খরগোশ

চিড়িয়াখানায় দর্শণার্থীদের কমবেশি সবারই আনন্দঘন সময় কাটে। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়–স্বজন,বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায় ঘুরতে যাওয়াটা একটা খুশিরই বিষয়। তাই সব মিলিয়ে চিড়িয়াখানার পরিবেশ সবসময় উৎসবমুখর থাকে। কিন্তু যাদের ঘিরে এই আনন্দ-উৎসব, সেইসব বোবা প্রাণীগুলোকে খুব বেশি আনন্দিত দেখা যায় না। গোমরামুখে খাঁচার এদিক-ওদিক করা ছাড়া ওগুলোর আর কিছুই করার থাকেনা। সীমাহীন বনের দুরন্ত প্রাণীরা ভাল থাকবে কি করে ইট পাথরের শহরে বানানো চিড়িয়াখানায়। তাইতো তাদের জন্য এখন বেশি ভাবা হচ্ছে সাফারি পার্কের কথা। তবে চিড়িয়াখানাও বিনোদনের এক সনাতনী ধারণা। ঢাকার চিড়িয়াখানা তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এই চিড়িয়াখানার পশুদের প্রতি এর রক্ষকদের আচরণ কতটা মানবিক। সে প্রশ্ন প্রায়শঃই ওঠে। আজও উঠেছে। সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) সেই প্রশ্ন সামনে এনে একদল পশুপ্রেমি সমবেত হয়েছিলেন ঢাকার মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায়। 

বেলা তখন ১১টা। ঢাকাসহ দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ এসে ঢুকছিলেন চিড়িয়াখানায়। ভিতরে ঢুকেই তাদের মুখে নতুন কিছু দেখার আনন্দের প্রকাশ। চিড়িয়াখানায় ঢুকলেই বাম পাশে মিলবে হরিণ। লোকজন বনের হরিণকে সরাসরি দেখতে পেয়ে মহা খুশী।

ভ্যানে করে ঘাস-লতা পাতা নিয়ে এসেছেন চিড়িয়াখানার কর্মচারীরা। ঘাসের স্তুপ মাথায় নিয়ে ছুড়ে ফেলছেন সেসব তারা হরিণের খাঁচায়। হরিণগুলো দৌড় দিয়ে এসে সবুজ ঘাসে নিজেদের ক্ষুধা মেটাতে ব্যস্ত। এদিকে মোবাইল ও ক্যামেরায় সেসব ধারণ করতে ব্যস্ত দর্শণার্থীরা।

প্রায় সব খাঁচাতেই পশু-প্রাণী-পাখিদের খাবার দেয়া হচ্ছিলো তখন। বানরের খাঁচার সামনে দেখা গেলো বেশি ভিড়। খাবার দেয়া হয়েছে গাজর, শশা, কলা ইত্যাদি। বানর সেসব খাবার নিয়ে নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করছে। যা দেখে দর্শনার্থীরাও বেশ মজা পাচ্ছেন। বকের খাঁচার ভিতরে রাখা পানি ভর্তি পাত্রে ছেড়ে দেয়া হলো কিছু মাছ। বক যেন অনেক মাছ সামনে পেয়ে চিন্তায় পড়ে গেল, কোন মাছটা আগে খাবে !

এভাবে প্রায় সব খাঁচাতে খাবার দেয়া হচ্ছে। চোখ আটকে গেল সাপের খাঁচার সামনে। বিশাল এক অজগর সাপ ঘুমিয়ে আছে। আর সেই সাপের আশে পাশে ছুটোছুটি করছে একটা তুলতুলে খরগোশ। খরগোশটিকে ছাড়া হয়েছে, সাপের খাবারের জন্য। সাপ তার ঘুম থেকে জেগে উঠলেই, জীবিত খোরগোশটিকে গিলে খেয়ে ক্ষুধা মেটাবে।

বিষয়টি কারো কারো কাছে মজার ঠেকলেও মেনে নিতে পারছিলেন না অনেকে। 

কুষ্টিয়া থেকে চিড়িয়াখানা দেখতে আসা স্কুল শিক্ষক আলী আসগর বলছিলেন, দৃশ্যটি দেখতে তার অস্বস্তি লাগছে।

"জীবন্ত একটা প্রাণী কোনরকম জীবন বাঁচানোর রাস্তা ছাড়াই,তাকে যে খাবে তার সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর মৃত্যুর প্রহর গুণছে। এটা অস্বস্তিকর,” বললেন তিনি। 

বেশ কয়েকজন জানালেন, সাপের খাঁচার ভিতরে জীবন্ত খরগোশ খাবার হিসেবে দিতে এর আগেও তারা বেশ কয়েকবার দেখেছেন।

অনেক দর্শণার্থী বিষয়টি বুঝতেই পারছেন না খরগোশকে খাঁচায় খাবার হিসেবে দেয়া হয়েছে। তারা মনে করছেন খোরগোশ মনে হয় সাপের খাঁচাতেই থাকে। 

চিড়িয়াখানার এই আচরণ কিংবা ব্যবস্থা এনিম্যাল এথিকস বহির্ভূত। ভেতরে এমনটা চলছে জেনে এরই মধ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গড়ে উঠেছে এর বিরোধীতাকারী একটি গ্রুপ। সেই গ্রুপটির সদস্যরাই অনলাইন ছেড়ে, অফলাইনে এসে সশরীরে হাজির হয়েছেন চিড়িয়াখানায়। প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন, জীবন্ত নিরীহ প্রাণিটিকে অজগরের খাদ্য হিসেবে খাচায় পুরে দেওয়ার। 

বেলা সোয়া ১১ টার দিকে বিভিন্ন প্রজাতির সাপগুলোর খাঁচার সামনে আসলেন ফেসবুকভিত্তিক সংগঠন বাংলাদেশ র‌্যাবিট গ্রুপের প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য। এই গ্রুপটি খরগোশ নিয়ে কাজ করছেন বেশ কয়েকবছর ধরে।বিপদাপন্ন খরগোশের পাশে দাঁড়ানোই গ্রুপটির কাজ। 

গ্রুপটির সিনিয়র এডমিন নাজ আফরিন খান ছিলেন বেশ সোচ্চার। জানালেন, চিড়িয়াখানায় সাপের খাঁচায় জীবন্ত খরগোশ যেন না দেয়া হয়, সেজন্য তারা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি সমাধান করার চেষ্টা করছেন। 

নাজ বলেন, "এখানে অনেক সময় বাঘ, কুমির সাপের খাঁচায় জীবিত মুরগি, খরগোশ ইত্যাদি দেয়া হয়। এসব প্রাণী আবার কোনরকম খাবার ছাড়াই কখনো কখনো দুই-তিনদিন ধরে শিকারের খাঁচায় পড়ে থাকে। খাঁচার মধ্যে মৃত্যুর ক্ষণ গুণছে একেকটা প্রাণী আরেকটি অপেক্ষাকৃত শক্তিধর প্রাণীর সামনে। এটা আসলে প্রাণী নির্যাতন। 

"প্রাণীদের এমন নির্যাতন করার অধিকার কেউ কাউকে দেয়নি," বলেন নাজ আফরিন খান। 

তারা চান, বিশ্বের অনেক চিড়িয়াখানায় জীবন্ত প্রাণী খাবার হিসেবে দেয়া বন্ধ করা হয়েছে। মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানাতেও যেন এটা বন্ধ করা হয়। 

"খাঁচার প্রাণিকে মৃত প্রাণির মাংস দেয়া হলে যদি খায়, তাহলে জীবন্ত প্রাণী খাবার হিসেবে দেয়ার যৌক্তিকতা কি? লন্ডন চিড়িয়াখানায় ১০০ বছর আগে থেকেই জীবিত প্রাণী খাবার হিসেবে দেয়া বন্ধ করা হয়েছে। মানবিক কারণেই এসব বন্ধ হওয়া উচিত।"

কথা বলতে বলতে কিছুটা সময় পার হয়ে গেছে। এরই মধ্যে জানা গেলো সাপের খাঁচা থেকে খরগোশটিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। 

র‌্যাবিট গ্রুপের একজন সদস্য জানালেন, চিড়িয়াখানার একজন কর্মী কিছুক্ষণ আগে খাঁচা থেকে বের করেছেন খরগোশটি। 

চিড়িয়াখানার কিউরেটরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে জানা গেল তিনি চিড়িয়াখানায় রাউন্ডে বের হয়েছেন। 

গ্রুপের প্রধান নাজ আফরিন খান ফোনে কথা বলছিলেন তার সঙ্গে। যে খরগোশটিকে সাপের খাঁচায় ছাড়া হয়েছিল সেটি তারা নিয়ে যেতে চাইলেন। আর ভবিষ্যতে জীবিত প্রাণী খাবার হিসেবে অন্য খাঁচায় না দেওয়ার দাবি জানালেন তিনি। 

পরে অপরাজেয় বাংলার সঙ্গে কথা বলেন জাতীয় চিড়িয়াখানার কিউরেটর আবদুল লতিফ। তিনি জানালেন, আশেপাশের দেশগুলোতে সাপকে যে ধরণের খাবার দেয়া হয় তা তারা অনুসরণ করছিলেন এতদিন। তবে মানবিক বিবেচনায় এর বিকল্প কি হতে পারে সে বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি। 

"খাবারতো তাদের দিতে হবে। আর আগে যা দেয়া হতো তা ট্রাডিশনাল ফুড। এখন বিশেষজ্ঞদের মতামতে বিকল্প খাবার পেলে, সাপের এই জীবিত খাবার বদলে দেয়া হবে। অচিরেই জীবিত খাবারের পরিবর্তে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হবে," বলেন আবদুল লতিফ। 

কথায় কথায় বেলা বেশ গড়িয়েছে। প্রাণীদের খাঁচাগুলোতে যেসব খাবার দেয়া হয়েছে, তাও ততক্ষণে ফুরিয়ে এসেছে। অনেকগুলো প্রাণি হয় জাবর কাটছে, নয়তো ঘুমিয়ে পড়ছে। কোনো কোনোটি সেই একই গোমড়ামুখে খাচার এপাশ-ওপাশ করছে। বকগুলো পানিতে এক পায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে। বানরগুলোই কেবল নিজেদের মধ্যে ঝগড়া অব্যহত রেখেছে। সেখানটাতেই দর্শণার্থীর ভিড় একটু বেশি। বাঘ দুপুরের ঘুম দিয়েছে। হাতি তার বিশাল শুঁড় এপাশ-ওপাশ করে ক্লান্তি দূর করছে। হরিণগুলো এক জায়গায় দলবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। খাঁচার ভিতর থেকে খাঁচার বাইরের দর্শণার্থীদের প্রতি পশুগুলোর যেন একটা বিষন্ন দৃষ্টি। এতকিছুর মধ্যে একটাই স্বস্তির, অজগরের খাঁচা থেকে মুক্তি মিলেছে একটি খরগোশের।