স্বজনদের শেষ মাটি দিতে না পারা প্রবাসীদের জীবনে বড় কষ্ট
আরীফ মুহাম্মাদ
প্রকাশিত: ০৬:৫২ পিএম, ২৭ জানুয়ারি ২০২১ বুধবার আপডেট: ০৬:১৮ পিএম, ২৮ জানুয়ারি ২০২১ বৃহস্পতিবার
আরীফ হোসাইন আম্মাকে হারিয়েছি গত ১৩ জানুয়ারি। (ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমেরিকার সময় রাত সাড়ে ৯ টার দিকে ছোট ভাইয়া (শরীফ) ফোন করে জানালেন আম্মা আর আমাদের মাঝে নেই। হঠাৎ মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কেননা আম্মার বয়স প্রায় ৮০ বছর হলেও মোটামোটি সুস্থ ছিলেন।
দুঃসংবাদ শোনার পর থেকেই প্রথম কয়েক ঘন্টা কথা বলার মতো কোন শক্তি ছিলো না। এমনকি উঠে দাড়ানোর মতো শক্তিও পাচ্ছিলাম না। এ অবস্থা দেখে আমার দুই সন্তানও কাঁদছে। তারা বুঝেও উঠতে পারছেনা, আমার কি হয়েছে। আমার স্ত্রী সন্তানদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করছে তাদের দাদু দুনিয়া ছেড়ে পরপারে চলে গিয়েছেন। তখন তারাও আমাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। ঐ সময় আমার মনে হচ্ছে কলিজাটা বের হয়ে যাবে। কয়েক ঘন্টা আওয়াজ করে বেহুশে কান্না-কাটি করেছি।
মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে শান্তনা দেওয়ার জন্য রাতেই ছুটে এসেছেন আমার প্রতিবেশী মাহফুজুর মতিন ও আব্দুল কুদ্দুস ভাই। কান্নার শব্দ শুনে আমার পাশের বাসার কোয়ারিন্টিনে থাকা ইমাম ফায়েজ ভাই ফোন করে শান্তনা দিয়ে কোরান ও হাদিস অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির জন্য উচ্চ স্বরে কান্না-কাটি না করার অনুরোধ করলেন। আমিও জানি মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করে কান্না-কাটি করলে গুনাহ হয়। মুলত মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনার পর থেকে স্বাভাবিক হুশ জ্ঞান আমার ছিলোনা। প্রতিবেশী, স্ত্রী ও সন্তানদের শান্তনাতে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশে বড় ও মেঝো ভাইয়াকে (কামাল উদ্দিন ও সবুজ) ফোন দিলাম, কিন্তু আমরা কেউ কান্নার জন্য কথা বলতে পারছিনা। একে একে অন্যান্য ভাই বোনদেরও ফোন দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করছি, সবার একই অবস্থা। কেউ স্বাভাবিক কথা বলার অবস্থায় ছিলো না।
আমরা ৫ ভাই ও ৬ বোন মোট ১১ জন। সবার মধ্যে আমি ছোট। আমি (আমেরিকা) এবং তৃতীয় নাম্বার ভাই (জুনায়েদ) সৌদি আরবে থাকেন। জুনায়েদ ভাইকেও রাতে ফোন করেছি। কয়েক সেকেন্ড কথা বলার পর আর কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনি। আমরা সবাই জানি, সবাইকে একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তেমনি আমাদের আম্মাও প্রায় ৮০ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে বাবাও প্রায় ৯০ বছর বয়সে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আমেরিকায় থাকায় মা ও বাবা কাউকে শেষ দেখা সম্ভব হয়নি। স্বজনদের শেষ মাটি দিতে না পারা প্রবাসীদের জীবনে বড় কষ্ট।
বাবা মারা যাওয়ার পরও অনেক কষ্ট হয়েছিলো। তবে আম্মার কথা মনে করে মনকে শান্তনা দিয়েছি, মা-বাবা’র মধ্যে মাথার উপর একজনের ছায়াতো আছে। ৮ বছর আগে বাবার মৃত্যু এবং গত ১৩ জানুয়ারি আম্মাকে হারানোর পর দুনিয়াকে খুব অসহ্য মনে হচ্ছে। আম্মার মৃত্যুর পর একটা রাতও ভালো করে ঘুমাতে পারিনি। তাকে প্রতিরাতেই স্বপ্ন দেখি। সর্বশেষ আম্মাকে দেখেছি ২০২০ সালের মার্চে। করোনা মহামারির মধ্যে আম্মাকে দেখতে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। এখন সর্বশেষ দেখার কিছু স্মৃতি রোমন্থন করি, যেন আম্মাকে সামনা সামনি দেখছি। দেশে গিয়ে বেশ কয়েক দিন সারাদিন-রাত আম্মার পাশে শুয়ে বসে কাটিয়েছি। নিজহাতে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছি। ঐ সময়গুলো আম্মার সঙ্গে আমার শ্রেষ্ঠ সময় কেটেছে।
জীবদ্দশায় আম্মা ১১ ভাই বোনকে সমানভাবে ভালোবাসতেন। প্রত্যেক ভাই বোনের কাছে মনে হতো আম্মা আমাকেই বেশী ভালোবাসেন। এছাড়াও আম্মা ছেলের বৌ ও মেয়ের জামাইদেরও সমানভাবে স্নেহ করতেন। এমনকি আম্মার ৪০ জন নাতি নাতনিকে সমানভাবে ভালোবাসতেন। সকল নাতি-নাতনির নাম আম্মা শেষ বয়সে এসেও মনে রাখতে পেরেছিলেন। নাম ধরে সব নাতি-নাতনির খোঁজ খবর নিতেন। অথচ আমিও সব সময় আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ৪০ জনের নাম মনে রাখতে পারিনা। এজন্য আম্মাকে একজন সফল লিডার মনে করি। যেমন একজন লিডার তার অধীনস্থ সবাইকে সমানভাবে মুল্যায়ন করে।
অবশ্য আমার মরহুম বাবাও (ডা. সিদ্দিকউল্লাহ) পরিবার ও সমাজের একজন সফল নেতা ছিলেন। তিনি জীবদ্দশায় তার ৬ মেয়েকে সুপাত্রস্থ এবং ৫ ছেলেকে পড়া লেখা করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আম্মা-বাবার প্রচেষ্টায় আজকে আমরা ১১ ভাই-বোন আল্লাহর রহমতে ভালোই আছি। সদ্য প্রয়াত আমার আম্মা ও মরহুম বাবাকে আল্লাহ বেহেস্ত নসীব করুক। আমিন।
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক, নিউইয়র্ক