তৈরি পোশাকের মেয়েরা পাচ্ছে শিক্ষার সুযোগ, পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়েও
বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৪:৩৮ পিএম, ২৩ জানুয়ারি ২০২১ শনিবার আপডেট: ০৫:৩৩ পিএম, ২৩ জানুয়ারি ২০২১ শনিবার
তৈরি পোশাক খাতের মেয়েরা এখন পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়েও
গার্মেন্টসের নারী কর্মী। স্কুলের গণ্ডি পার না হতেই কিশোরী (ধরে নেয়া যায়) বয়সে তাদের কাজ জুটে যায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। অর্থাভাবই কারণ। এতে পড়াশোনা আর হয়ে ওঠে না। পরিবারের ভরণ পোষণ চালাতে এ কাজ বেছে নেয় তারা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে খুবই সাধারণ চিত্র এটি।
বিশ্বে তৈরি পোশাক শিল্পে সুপরিচিত নাম বাংলাদেশ। এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট, নেক্সট, গ্যাপ, মার্কঅ্যান্ডস্পেন্সার ও টার্গেটের মতো ব্র্যান্ডের পণ্য উৎপাদিত হয় এদেশেই। যা তৈরি করে আমাদের মেয়েরা। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের প্রায় ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ কর্মীই নারী।
এই সেক্টরে কাজের পরিবেশ এখনো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ রয়ে গেছে। একই সঙ্গে মজুরিও অনেক কম। বেতন গ্রেডের হিসেবে নতুন কাজে ঢোকা একজন গার্মেন্টস কর্মী মাসে সর্বসাকুল্যে আয় করেন ৮ হাজার টাকা। তা সত্ত্বেও কিশোরীদের এই কাজটাই বেছে নিতে দেখা যায়। আর গবেষণা এও বলছে, স্বল্প শিক্ষার কারণেই স্বল্প মজুরি।
স্রেফ পারিবারিক দৈন্যের কারণে অনেক মেয়ে লেখাপড়ায় মেধাবী ও সম্ভাবনাময় থাকার পড়েও সামান্য আয়ের তাগীদে কাজে যোগ দেয়।
গার্মেন্টস খাত এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এই মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি উদ্যোগ নিয়েছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ)। তৈরি পোশাক কারখানার মেয়েরা এখন সুযোগ পাচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। এ জন্য চালু করা হয়েছে 'পাথওয়েজ ফর প্রমিজ' নামের একটি কর্মসূচি।
সফলভাবে সেই কোর্স সম্পন্ন করে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারছে মেয়েরা। এরকম অসংখ্য গার্মেন্টস কন্যার হৃদয়ে সফল হওয়ার বীজ বুনে দিয়েছে ‘পাথওয়েজ ফর প্রমিজ’। উন্নয়নশীল দেশগুলোর নারীদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে অর্থাভাব এবং প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগের অভাবসহ বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে কাজ করছে তারা।
কিভাবে? প্রথমে শিক্ষাসুবিধা বঞ্চিত প্রতিভাধর মেয়েদের খুঁজে বের করে 'পাথওয়েজ ফর প্রমিজ'। পরে তাদের ভিন্ন ধারার শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য প্রস্তুত করে তোলে। এর আওতায় একবছর প্রস্তুতি নিতে পারেন গার্মেন্টস কন্যারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ইচ্ছুক বেশিরভাগ নারীর অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা অর্থ। সেই সমস্যার সমাধান দিয়েছে ‘পাথ ওয়েজ ফর প্রমিজ’। যেসময় তারা পড়াশোনা করেন, সে সময় গার্মেন্টসে কাজ করতে পারেন না। তা পুষিয়ে দিতে তাদের মাসিকবৃত্তি দেওয়া হয় প্রকল্পটির আওতায়।
গার্মেন্টস কর্মীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ এবং মান উন্নয়নে কাজ করছে এই‘পাথওয়েজ ফর প্রমিজ’। এইউডব্লিউ’র ক্যামব্রিজ ও মাসাচুসেটস অফিস এ প্রকল্পের জন্য তহবিল সংগ্রহ করছে। এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের ১৮টি দেশের শিক্ষার্থীদের এই কার্যক্রমের আওতাভূক্ত করা হয়েছে।
এরই মধ্যে‘পাথওয়েজ ফর প্রমিজ’ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৯০ শতাংশ মেয়েই সাফল্য দেখিয়েছেন। যার মধ্য দিয়ে তাদের আয়-উন্নতি যেমন বেড়েছে, সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতাও বেড়েছে।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন’র প্রতিষ্ঠাতা কামাল আহমেদকে উদ্ধৃত করে এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিজ নিজ সমাজ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে উদাহরণ তৈরি করেছেন এই মেয়েরা। যা এরকম হয়ে উঠতে অন্যদের উৎসাহিত করছে। এই ফলাফল অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
২০১৬ সালে যাত্রা করা এই শিক্ষা কার্যক্রমে এ পর্যন্ত অংশ নিয়েছেন ৪৭০ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে এসএসসি পাস করা ৪৩০ জনই অ্যাক্সেস অ্যাকাডেমি প্রাক-কলেজ প্রস্তুতি প্রোগ্রামে ভর্তি হন। উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির আরেকটি পূর্ব-প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম এটি। এদের মধ্যে প্রথম ব্যাচে ভর্তি হওয়া ২৫ শিক্ষার্থী ২০২০ সালের মে’তে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।
কি পড়ানো হয় তাদের? এই পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে রিডিং কম্প্রিহেনশন, রাইটিং ও বিজনেস স্টাডিজ। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সাবজেক্ট- শিল্পকলা। নিপীড়িত গোষ্ঠীর, বিশেষত সংঘাতময় এলাকার নারীদের জন্য নিজেকে মুক্তভাবে তুলে ধরার শিক্ষাও দেওয়া হয় তাদের। এর মধ্য দিয়ে তারা সফল যোগাযোগ কৌশল শেখে। ঊর্ধ্বতন কারো সঙ্গে কথা বলার সময় ভীতি কাটিয়ে উঠতে পারে এবং আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়। সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন হয়।
এই প্রকল্পের আওতায় শেখানো হয় নৃত্যকলা, সঙ্গীত ও পারফর্মিং আর্ট।
“এরা সকলেই সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণি থেকে আসা শিক্ষার্থী। তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশের কারণেই তারা অন্তর্মুখী স্বভাবের। নাট্যকলা তাদের বহির্মুখী হয়ে উঠতে, যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধিতে এবং নিজেদের প্রকাশ করতে সহায়তা করে। কোনো দ্বিধা ও শঙ্কা ছাড়াই নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলার নতুন ভাষা খুঁজে পায় তারা।“
“যখন আমি প্রথম এইউডব্লিউতে পড়াশোনা শুরু করি, তখন খুবই ভীত ছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার ইংরেজি দক্ষতা ভালো না, আমি কি পারবো? ভর্তি হওয়ার পর দ্রুত কয়েকজন বন্ধু তৈরি করে ফেলি। আমার শিক্ষকরা দারুণ সহায়তা করেন। আমি এখন অনেক আত্মবিশ্বাসী। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাসকরি, বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাকে যে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে, তা আমার সারাজীবনের সব চেয়ে বড় উপহার”।
এই কর্মসূচির চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো শিক্ষার মাধ্যমে মেধাবী নারীদের জীবনের পরিবর্তন ঘটানো। উন্নততর জীবন উপহার দেয়া। সর্বোপরি, গার্মেন্টস শিল্পে বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে ফেলা। যারা পড়াশোনা শেষ করেছেন, তারা তাদের অর্জিত জ্ঞান দিয়ে এই খাতের অনেক বিষয়াদি বুঝতে পারবেন। প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো আনতে সক্ষম হবেন। তৈরি পোশাক শিল্পের নারী কর্মীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত পেতে আশার সঞ্চার করবেন তারা।
“আমরা এসব নারীদের দুঃখ, দুর্দশা নির্মূলে সহায়তা করতে অবশ্যই সক্ষম হবো। তাদের জীবন-জীবিকার প্রতি যাদের ন্যূনতম সহানুভূতি নেই, ওদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল আনতেও সক্ষম হবো। এই স্মার্ট, প্রতিভাধর নারীরা তাদেরই সোচ্চার হতে সহায়তা করবেন, যাদের আগে ন্যায্য দাবি-দাওয়া তোলার সাহস ছিল না।“