ভ্যাকসিন নিয়ে দয়া করে অপপ্রচার করবেন না
কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ১২:৪৬ পিএম, ২২ জানুয়ারি ২০২১ শুক্রবার
করোনার শুরু থেকে অস্বস্তিকর সমন্বয়হীনতা আর সামর্থ্যের অপ্রতুলতা নিয়েই বাংলাদেশ করোনাকাল মোকাবেলা করছে। ইউরোপ-আমেরিকা এমনকি ভারতের মত অগণন লোকের আক্রান্তের তথ্য সরকারি হিসাবে নেই। স্বাভাবিক মৃত্যুহারের চেয়ে বেশি মৃত্যুও নেই দেশে। রাস্তায়-রাস্তায় লাশ পড়ে থাকবে এমন অপপ্রচার কিংবা প্রচারণারও সত্যতা মেলেনি। অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি। প্রণোদনা দিয়ে সরকার সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছে অর্থনীতি সচল রাখতে। প্রান্তিক পর্যায়ে সরকারি সহায়তাও ছিল শুরুতে। সবকিছু মিলিয়ে উন্নত দেশগুলোর মত করোনা এত অস্বস্তিতে ফেলেনি দেশবাসীকে। যদিও এখানে মানুষের বেপরোয়া চলাফেরা ছিল এবং আছেও তবু আমরা মোটামুটিভাবে সফলই করোনা মোকাবেলায়।
করোনা মোকাবেলার এই সাফল্য কতটা সরকারি তরফে আর কতটা ব্যক্তিগত তরফে মরতে-মরতে বেঁচে যাওয়া সে আলোচনা এই মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয়। যে হার্ড ইমিউনিটির গল্প শুনে এসেছি সেটা কী পর্যায়ে, কী এর প্রভাব-সাফল্য সে আলোচনারও দরকার নাই। এখন পর্যন্ত আমরা যারা বেঁচে আছি তারা রীতিমত শঙ্কা আর করোনাকে জয় করেই বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকার মধ্যে মাধুর্য আছে। বোধসম্পন্ন সংগ্রাম এখানে আমাদের না থাকলেও এটা আদতে আমাদের অজ্ঞাতে আমাদের দ্বারা পরিচালিত এক সংগ্রামই। এখানে সরকারি হিসাবে আমাদের লক্ষ লোক জয়ী হয়েছে, বেসরকারিভাবে জয়ী হয়েছে কোটি লোক। গুণতিতে না আসা এই কোটি লোকও করোনা মোকাবেলায় মোটামুটি সফল এক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনার থাবায় তছনছ পুরো বিশ্ব। গত বছরের ১১ মার্চ করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এখন পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তাতে সহসাই এ থেকে মুক্তি মিলছে না বলেই মনে হয়। তবে এই সময়ে বেশ কয়েকটি কোম্পানির ভ্যাকসিন উদ্ভাবন হয়েছে, প্রয়োগও শুরু হয়েছে অনেক দেশে। ভ্যাকসিনের পিছু ছুটছে পুরো বিশ্ব। এমন অবস্থায় তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমাদের ভ্যাকসিন প্রাপ্তির যে অনিশ্চয়তা ছিল সেটা অনেকটাই দূর হয়েছে। কমপক্ষে তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন আনার কাজ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করেছে সরকার। বৃহস্পতিবার ভারত থেকে এসেছে বিশ লাখ চার হাজার ডোজ ভ্যাকসিন। সরকারি তরফে জানানো হয়েছে এই বিশ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন ভারত সরকার আমাদেরকে ‘উপহার’ হিসেবে পাঠিয়েছে। ‘বিনামূল্যের’ এই উপহারের জন্যে ভারত সরকারকে ধন্যবাদ!
ভ্যাকসিন আসবে কি না এনিয়ে একটা সন্দেহ তৈরি হয়েছিল কয়েকদিন আগে। অবশেষে সব সন্দেহকে অমূলক প্রমাণ করে ভ্যাকসিনের একটা চালান এসেছে বাংলাদেশে। এরমাধ্যমে আদতে ভ্যাকসিনের প্রাপ্তি নিয়ে হুট করে গজিয়ে ওঠে সন্দেহ দূর হয়েছে বলে বিশ্বাস। এখন যে বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে সেটা হচ্ছে এই ভ্যাকসিন কার্যকর কি না? এই আলোচনার উৎস মূলত আমাদের সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত মানসিকতা ও অবিশ্বাস। অথচ ভ্যাকসিনগুলো প্রায় সকল ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে তবেই প্রয়োগ করার অনুমোদন পেয়েছে। যে ভ্যাকসিন এসেছে এবং যা আসবে সেগুলো পরীক্ষামূলক পর্যায়ের নয় নিশ্চিতভাবেই। তাই অবিশ্বাস থেকে সৃষ্ট সন্দেহকে দূরে ঠেলে দেওয়া উচিত আমাদের। তা না হলে আমরা নিজেরাই নিজেদের পিছিয়ে যাওয়ার পথ রচনা করব। ভ্যাকসিনের শতভাগ কার্যকারিতার যে বিষয়টি সেটা কয়েক মাসের পরীক্ষানিরীক্ষায় সম্ভব হয়ত না তবে এটা মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী যে না সেটা শতভাগ নিশ্চিত। এখানে আমাদের অপেক্ষার বিষয় যদি থেকে থাকে তবে সে অপেক্ষা মানবকল্যাণের, আর বর্তমান যে অবস্থা সেটারও উদ্দেশ্য একই ওই মানবকল্যাণ। তাই এখানে অহেতুক প্রশ্ন-সন্দেহ আর অবিশ্বাস অপ্রত্যাশিত।
ভ্যাকসিন এসেছে। এখন ভ্যাকসিন নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয় এমন কিছু না করাই উচিত সকলের। দায়িত্বশীল কিংবা দর্শক সকলের জন্যেই কথাটা প্রযোজ্য। সন্দেহ তৈরি হওয়ারও পথ বন্ধ করতে হবে। কারণ সন্দেহে মানুষ আস্থাহীনতায় ভুগবে। মানুষের আস্থা অর্জন, আস্থার অগ্রগতি জরুরি এই মুহূর্তে। ভ্যাকসিন নিয়ে এই অবস্থা কেবল আমাদের একার নয়, বিশ্বের প্রতি দেশেই এনিয়ে আস্থা-অনাস্থার দোলাচল আছে। এই অনাস্থা দূর করতে আমরা দেখেছি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে করোনার ভ্যাকসিন নিতে। বাইডেনসহ সেখানকার আরও অনেকেই মানুষদের মাঝে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার বার্তা দিতে চেয়েছেন নিজেদের গ্রহণের মাধ্যমে। বাইডেনের নামটাই যথেষ্ট মার্কিনিদের আস্থা অর্জনে। এমন অবস্থা অনেক দেশের। যদিও আমাদের অঞ্চলে এমন কিছু ঘটেনি এখনও, তবে এটা সম্ভব হলে লাভই হতো আমাদের।
আমাদের দরকার সচেতনতার। এই সচেতনতা বাড়াতে উপলক্ষেরও দরকার হয় মাঝেমধ্যে। এখানে সরকারের পাশাপাশি দায়িত্ব নিতে হবে সমাজে-দেশে প্রভাব বিস্তারকারীদের। এনিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু প্রস্তাব এসেছে, যদিও এগুলো আমলে নেওয়া হবে কি না জানি না। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একটি অনলাইন গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, ‘পয়লা টিকাটা নেওয়া উচিত প্রধানমন্ত্রীর। পাবলিকলি টেলিভিশনের সামনে টিকা উনি নিলে লোকের আস্থা জন্মাবে। পাশাপাশি প্রত্যেক মন্ত্রীর জেলা শহরে গিয়ে সবার আগে টিকা নেয়া উচিত। তাহলে লোকের আস্থা জন্মাবে এবং তাদের বুঝিয়ে বলা যাবে।’ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই প্রস্তাব হালে পানি পাবে না, সমালোচিতও হবে; কারণ সরকারবিরোধী একটা রাজনৈতিক জোটের সংগঠক ছিলেন। তাকে সরকারের নানা মহলের ভালো চোখে না দেখার বিষয়টিও প্রকাশ্য প্রায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তার প্রস্তাবগুলোকে সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধীরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখেন, বিশ্লেষণ করেন। তবে এই বিভক্তি-সংকৃতির বিপরীতে তিনি যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার সুযোগ রয়েছে।
একজন মন্ত্রী, একজন এমপি, একজন সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকাভিত্তিক ভ্যাকসিন গ্রহণে এগিয়ে আসলে খুব সহজেই করোনার টিকা নিয়ে মানুষের বিভ্রান্তি, কিছু লোকের অপপ্রচার, সন্দেহ ও আস্থাহীনতা দূর হয়ে যেতে পারে। তাদের ভ্যাকসিন গ্রহণ একদিকে যেমন নিজেদের সুরক্ষা দেবে, অন্যদিকে ভ্যাকসিন নিয়ে সারাদেশে আস্থার পরিবেশও তৈরি হবে।
দেশের মানুষের জন্যে সরকার যে ভ্যাকসিন নিয়ে আসছে সেটার উদ্দেশ্য মহৎ। এজন্যে বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ। খুব কম সময়ের মধ্যে উদ্ভাবিত এই ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকাটাই অস্বাভাবিক, এটাকে তাই বড় করে না দেখাই ভালো; এ সমস্যাটা বৈশ্বিক ও স্বাভাবিক। এ শঙ্কাকে উপেক্ষা করে আমাদের সকলের উচিত ভ্যাকসিনকে ইতিবাচকভাবে দেখা। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞানীদের বরাত দিয়ে জানাচ্ছে কারা ভ্যাকসিন নিতে পারেন, কাদের নেওয়া উচিত না, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে; এনিয়ে বিজ্ঞজনেরা ভালো বলেছেন, সুতরাং এখানে বিজ্ঞজনের মতামতের বাইরে অজ্ঞজনের মতামত ও মন্তব্য সমীচীন নয়। অজ্ঞজনের কথিত বিজ্ঞ মতামত ও মন্তব্য কাউকে দিকনির্দেশনা দিতে পারবে না, দেওয়ার কথাও না। তারা কেবল বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারবে, আর এই বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের যেকোনো ভ্রান্ত মতামত আমাদের অনেক বড় ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে।
ভ্যাকসিন এসেছে, ভ্যাকসিন আরও আসবে। এটাকে ইতিবাচক ভাবে দেখে সুযোগ পেলে নিজে গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন, আর সুযোগ না পেলেও এটা নিয়ে অপপ্রচার করবেন না। ‘লাইন অব ফায়ারে’ বসেও যখন বেঁচে আছি তখন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিষয়ক ক্ষুদ্র শঙ্কাকেও জয় করতে হবে আমাদের।