অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

থিয়েটারের বন্ধু: বন্ধুর থিয়েটার

মাসুম রেজা

প্রকাশিত: ০৪:৩৫ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০২১ বুধবার   আপডেট: ০৭:২০ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০২১ বুধবার

ইশরাত নিশাত। সবাই ওকে নিশাত বলেই জানে। নিশাত আমার বন্ধু। বন্ধুত্বের শুরুর দিকে আমি ওকে ‘এ বু’ বলে ডাকতাম, জবাবে নিশাতও আমাকে ‘এ বু’ বলে ডাকতো। আমাদের বন্ধুত্বের মূল উপজীব্য ছিলো ঝগড়া, আমরা দুজনে এত এত ঝগড়া করেছি তার কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। এই ঝগড়া দিয়েই আমরা ছত্রিশ বছরের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব উদযাপন করেছি। 
নিশাতকে আমি প্রথম দেখি মঞ্চে। মামুনুর রশীদ’র লেখা আরণ্যক নাট্যদলের গিনিপিগ নাটকে। গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝিতে আমি ঢাকা এসেছিলাম সৈয়দ জামিল আহমেদ-এর একটা কর্মশালায় অংশ নিতে। তখন আমাদেরকে কর্মশালার অংশ হিসাবে গিনিপিগ দেখানো হয়েছিলো। গিনিপিগে নিশাত, সালাহউদ্দিন লাভলু ও আজিজুল হাকিম অভিনয় করেছিলো। পরবর্তীতে এই তিনজনই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়। গিনিপিগে এই ত্রয়ীর অভিনয়ে আমি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, তা নিয়ে আমি আমার বন্ধুদের বলতে থাকতাম। ঐ নাটকে নিশাত ও লাভলু ঢাকার আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত আর আজিজুল হাকিম আসেন বরিশালের একটা গ্রাম থেকে। দারুণ একটা এডিপাসিয় গল্প ছিলো নাটকটার। 

নাটকে লাভলু, নিশাতকে একটা সংলাপ দিতো যা আমার এখনো স্মরণ আছে ‘সিগারেটটা এত দীর্ঘ হয় না কেনো যে, সারাদিন টানবো তবু শেষ হবে না’। অনার্স পরীক্ষা শেষ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কানাডা চলে যাবো। বকুল ভাই (শামসুল আলম বকুল) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুশীলনে কাজ করতেন। পড়াশুনা শেষ করে ঢাকা চলে এসেছিলেন। কানাডা চলে যাওয়ার পরিকল্পনাটা মূলত বকুল ভাইয়ের ছিলো। বকুলভাই ঢাকা আসতে বললেন, আমি ঢাকা এলাম। যেহেতু নাটক অন্তপ্রাণ মানুষ ছিলাম তাই বেইলি রোডে মহিলা সমিতিতে গেলাম নাটক দেখতে। টিকেট শেষ তাই বকুল ভাইয়ের ব্যবস্থাপনায় হলের উপরের তলায় ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম। (তখন মহিলা সমিতি মিলনায়তনে ব্যালকনির টিকিট বিক্রি হতো না)। হঠাৎ একসময় আমার চোখে পড়লো একটি মেয়ে ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নাটক দেখছে। পরনে জিন্সের প্যান্ট ও সাদা টি-সার্ট। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম এ সেই মেয়ে, গিনিপিগে যার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। একটু পরে দেখলাম বকুলভাই তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমি মনে মনে ভাবলাম মেয়েটির সাথে পরিচয়ের সুযোগ তবে হলো। বকুল ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন ‘ওর নাম নিশাত, ও আরণ্যকে কাজ করে’। আমি বললাম আমি উনাকে চিনি। সেই থেকে পরিচয়ের সূত্রপাত। সেটা ছত্রিশ বছর আগের ঘটনা। 

আমাদের কানাডা যাওয়া বারবার পেছাচ্ছে তাই বকুল ভাইকে বললাম রাজশাহী ফিরে গিয়ে মাস্টার্সটা শেষ করে আসি। ফিরলাম রাজশাহীতে। এরই ভিতরে দু’বার নিশাত নাটকের কাজে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসলো। বাড়লো আমাদের ঘনিষ্ঠতা। নিশাত, লাভলু ও বকুলভাইসহ আরো দু’ একজনের আরণ্যক ত্যাগের খবর পেলাম রাজশাহীতে বসেই। বকুল ভাই জানালেন ‘আমরা একটা নতুন দল করছি, তুই মাস্টার্স শেষ করে এসে আমাদের সাথে কাজ করবি’। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু তপন দাশ আগেই ঢাকা চলে এসে বকুল ভাইদের সাথে মিলে তৈরী করলো ‘দেশ নাটক’। বকুল ভাই প্রধান ব্যক্তি। সাথে আছে লাভলু, নিশাত, তপন। আমি মাস্টার্স শেষ করে এসে সেই বছরেরই (১৯৮৭) শেষে যুক্ত হলাম দেশ নাটকের সাথে। ব্যক্তিগত বন্ধু থেকে নিশাত আমার থিয়েটারের সহকর্মী বন্ধু হয়ে গেলো। 

আমরা বন্ধু হলেও স্বভাবে আমরা ছিলাম বিপরীত। তাই ঝগড়াটা আমাদের সঙ্গ ছাড়তো না। আমি নিশাতকে সবসময় বলতাম ‘লাইনে আয় বন্ধু, ও বলতো আমি ঠিক লাইনেই আছি। আমি বলতাম; কারো নাটক দেখে খারাপ লাগলে তুই যে তার মুখের উপর বলে দিস তোর ভালো লাগেনি, এটা কী ঠিক? ও বলতো এটাই ঠিক। বলতাম শিল্পকলায়, গ্রুপ থিয়েটারে কে কী করছে তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের নাটকের কাজটা কর। ও বলতো আমি যা করছি তা নাটকেরই কাজ, এই কাজ না করলে আমরা নাটকটা ঠিক মতো করতে পারবো না। আচ্ছা ঠিক আছে মাথা ঘামাচ্ছিস ঘামা কিন্তু এই নিয়ে রাস্তায় নামিস না। ও বলতো রাস্তাতো নামার জন্যেই বন্ধু, রাস্তায় না নামলে কিছু হবে না। 
শিল্পকলা প্রাঙ্গনে কিছু অনিয়ম নিয়ে শুরু করলো গণসাক্ষর সংগ্রহ। নিশাত আমার সেই বন্ধু যে, সেই ১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে আমার পকেটে কড়কড়া একটা বিশ টাকার নোট ঢুকিয়ে দিয়ে বলতো টিএসসিতে যাওয়ার বাসভাড়া। আমি আর তপন সেই টাকা বাঁচাতাম বাসে না উঠে চামেলিবাগ থেকে পায়ে হেঁটে টিএসসিতে গিয়ে। যাতে দলের অন্যান্যদের সাথে চা, সিঙ্গাড়া খাওয়া যায়। 

ওর হাতের রান্নার কথাটা একটু বলে নিই। আমাদের থিয়েটার অঙ্গনের অনেকেই জানেন নিশাতের রান্নায় কী অপূর্ব স্বাদ হতো। ওর মৃত্যুর পরে ওর যে জন্মদিন গেলো গত আগষ্টে তখন আমি লিখেছিলাম ‘তুই মিশে আছিস কৈ মাছের ঝোলে। মিশে আছিস আনারস দিয়ে ইলিশে। বাঁধাকপির সবুজ সবুজ আধাসেদ্ধ মাখন ভাজা স্বাদে। তুই আছিস আমের আচারের বোয়ামে, কাঁকড়ার কারিতে, মুরগির নাম না জানা নানা রেসিপিতে, সারারাত ধরে ভুনে ভুনে এক অলৌকিক রঙের বিফের বাটিতে, গোটা গোটা লাল মরিচ দিয়ে চিংড়ির হরেক ব্যঞ্জনায়, নাক কান দিয়ে আগুন বের হওয়া মরিচের হিসহিসানিতে, আমড়ার টকে, রেশমি সেমাইয়ের অতল দুগ্ধ সরোবরে, বাইমের থকথকে ভুনায়, অপার্থিব স্বাদময় তেহারিতে, দীর্ঘ পাবদার অতিদীর্ঘ আস্বাদে। 
নিশাতের গানের গলাও বেশ ভালো ছিলো। একসময় নিয়মিত ওর গান শুনতাম। তবে দীর্ঘ অযত্নে ও সুরটা হারিয়ে ফেলেছিলো। আমি ওকে এ নিয়ে বকাও দিতাম। নির্দেশনা ও আলোক পরিকল্পনার কাজ বেশ সুনামের সাথে নিশাত করতো। দেশ নাটকে যাত্রানাস্তি নামে একটা নাটকের নির্দেশনা দিয়ে ওর নির্দেশনার শুরু। নাটকটা রচনাও করেছিলো নিশাত। দেশে ও দেশের বাইরে নিশাত  থিয়েটারের এ জাতীয় কাজগুলো করেছে। মঞ্চ নাটকের রিভিউ লিখেছে বিভিন্ন পত্রিকায়। সেই রিভিউগুলো নিয়ে বিক্ষীত থিয়েটার শিরোনামে একটা বইও প্রকাশিত হয়েছিলো। তবে আমি ওকে অভিনয় শিল্পী হিসাবেই জানি। আলী যাকের-এর নির্দেশনায় দেশ নাটকের ‘দর্পনে শরৎশশী’ নাটকে কী অসাধারণ অভিনয় করেছে নিশাত। ঐ নাটকে একটা সংলাপ ছিলো ‘অভিনয় করে মাতিয়ে দিতে হবে তোকে’। নিশাত সত্যিই ঐ নাটকে অভিনয় করে মাতিয়ে দিয়েছিলো। 

আমার বিরসাকাব্য নাটকে বিরসার মায়ের চরিত্রে ভীষণ ভালো অভিনয় করতো নিশাত। অভিনয়টা ওর রক্তে ছিলো। স্বানামধন্য অভিনয় শিল্পী নাজমা আনোয়ার-এর মেয়েরতো তাই থাকার কথা। তখন কয়েকমাস ধরে আমার জলবাসর নাটকের মহড়া চলছে। নিশাত আমাকে বললো, বন্ধু এই নাটকে অভিনয়ের ব্যাপারটা আমি দেখবো, তুমি শুধু ব্লকিংটা করে দাও। ব্লকিং শেষ হলে, ও অভিনয়ের কাজ শুরু করলো। এই সময়ে ও ডাক্তারের কাছে গিয়ে অনেকগুলো টেস্ট-ঠেস্ট করিয়ে বললো দোস্তো আমিতো ভাবছিলাম আমার পার্টসপুর্টস সব শ্যাষ কিন্তু রিপোর্টতো ভালো, কোনো ঝামেলা নাই। আমি বললাম তাইলে ধরে নে তুই সেকেন্ড লাইফ পেলি, এবার শরীরের যত্ন নে। ও আমাকে বললো থাম, আগে তোর নাটকটা জাত করে নেই। 

শুরু করলো জলবাসরের অভিনয় নিয়ে পারফরমারদের সাথে কাজ। কী অমানুষিক পরিশ্রম করলো আর করালো। ওর কাজের কোয়ালিটি দেখে মুগ্ধ হলাম। কী সূক্ষ সূক্ষ ডিটেইল দেখিয়ে দিলো প্রতিটা চরিত্রের। আমি ওকে বললাম বন্ধু তুই হলি ‘দা মোস্ট ট্যালেন্টেড পারফরমার অফ দা কান্ট্রি’। জলবাসর-এর একটা দৃশ্যের কাজ বাকি ছিলো সেটাও দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে বসে নির্দেশনা দিয়ে শেষ করলো। তারপর ওর বোনের বাড়ি গুলশানে গেলো আর আমরা ফিরে এলাম বাড়ি। কী আশ্চর্য বিষয় আমি নিশাতের কাছ থেকে বিদায় নিতে দিব্যি ভুলে গেলাম। অন্যান্য দিনের মতো নিশাতও চিৎকার করে বললো না; কিরে, না বলেই চলে যাচ্ছিস যে, পছন্দ হয় না, না? যেখানে দাঁড়িয়ে রোজ নিশাতের কাছ থেকে বিদায় নিতাম, মৃত্যুর পর ওকে সেখানে আনা হয়েছিলো। বাচ্চু ভাই, মামুন ভাই, আতা ভাই, নুর ভাই, যাকের ভাই, সারা আপা, শিমুল আপা, কেরামত দা, লাভুল, আসাদ ভাই আরো কত কত মানুষ, কত কত মানুষ। সবাই বললো; নিশাতের কন্ঠে দ্রোহ ছিলো, নিশাত আপসহীন ছিলো, নিশাত যা বলার মুখের উপর বলে দিতো। সবাই মিলে তোর এই গুণগুলোর অনিঃশেষ প্রশংসা করলো। আমি বুঝলাম আমিই ভুল ছিলাম। তুই সঠিক ছিলি। তুই যা করে গেছিস তার জন্যেই তুই ‘তুই’ হয়েছিস। দোস্তো আসলে তোর ঘরানাটা আমার বোঝারই ক্ষমতা ছিলো না। আলগাই তোর সাথে চিল্লাতাম। 

মাসুম রেজা: খ্যাতিমান নাট্যকার।