২৫ ধর্ষণ মামলার পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ এমজেএফ’র
দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শান্তি না হওয়াই ধর্ষণ বাড়ার মূল কারণ
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশিত: ০৩:৫০ পিএম, ১৪ জানুয়ারি ২০২১ বৃহস্পতিবার আপডেট: ০৫:০৩ পিএম, ১৪ জানুয়ারি ২০২১ বৃহস্পতিবার
২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের ধর্ষণ মামলার বিস্তারিত তুলে ধরেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এই সময়ের মধ্যে ২৫টি মামলার ১৫ জন আসামি গ্রেফতার পর থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জামিন পেয়ে গেছেন। ২০ জন অভিযুক্ত ধর্ষক জামিনে মুক্ত আছে, কারাগারে ৩ জন এবং ২ জন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরও উল্লেখ করা হয়েছে, অভিযুক্তদের গ্রেফতারে কোনো ব্যবস্থাতো করা দূরে থাক, জামিনে মুক্তরা মামলাকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।
বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আজ এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই তথ্য তুলে ধরে। এমজেএফের ৭ টি সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে ফলোআপকৃত ২৫ টি ধর্ষণ মামলার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা এবং ধর্ষণ মামলা পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণগুলো খুঁজে বের করাই এই সংবাদ সম্মেলনের উদ্দেশ্য। দেশের ৭ টি সহযোগী সংগঠন এই কাজে সহায়তা করেছে
দেশের ১০ টি জেলা – ঢাকা, গাজীপুর, নীলফামারি, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর এবং জয়পুরহাট থেকে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। মামলার আইনগত দিক উপস্থাপনা করেছেন সিনিয়র আইনজীবি এলিনা খান।
অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়-
২৫টি ধর্ষণ মামলার মধ্যে অধিকাংশই আছে বিচারাধীন ও সাক্ষ্যের পর্যায়ে।
মামলা করার ৬ মাসের মধ্যে চার্জশিট হয়েছে ২২ মামলায়।
২০১৪ -২০১৫ সালে চার্জশিট হয়েছে এরকম ৯ মামলার রায় এখনো হয়নি।
২০১৬-২০১৭ সালে চার্জশিট হয়েছে এরকম ১২টি মামলার রায় এখনো হয়নি
৩ মামলায় এখন পর্যন্ত অভিযোগপত্র দাখিলই করা হয়নি।
২টি মামলা একদম নিস্ক্রিয়
৪টি মামলার নথিপত্র গায়েব
চার্জশিট হওয়া ২০ মামলার শুনানি হয়েছে ছয় থেকে সাতবার
একটিতে এখনো মেডিকো-লিগ্যাল টেস্ট হয়নি।
ঝুলে থাকা মামলাগুলো পর্যালোচান করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাক্ষী হাজির না হওয়াতে তারিখ পিছিয়ে গেছে। অভিভাবকরা হতাশ হয়ে আর কোর্টে যেতে চাইছেন না। দরিদ্র অভিভাবকরা আর্থিক অসুবিধার জন্য মামলা না চালনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা কেন?
- এই কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে মামলা বিচারের জন্য নথি প্রাপ্তির তারিখ থেকে ১৮০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। এবং মামলার শুনানি শুরু হলে, তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া আছে। কার্যক্ষেত্রে এসব মানা হচ্ছে না।
- তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার কারণে ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হচ্ছে না।
- পাবলিক প্রসিকিউটর ভিকটিম ও সাক্ষীকে মামলার তারিখে আদালতে হাজির করানোর ব্যাপারে উদ্যোগী নন।
- থানা পুলিশ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ধর্ষণে শিকার শিশু ও নারীকেই নানাভাবে দোষারোপ করার চর্চা প্রচলিত।
- আসামি পক্ষের আইনজীবীরা ধর্ষণের শিকার শিশু ও নারীর সঙ্গে ইচ্ছাকৃত খারাপ আচরণ করেন।
- আইনে ধর্ষণ অপরাধ আপোষ অযোগ্য হলেও, পারিপার্শ্বিক চাপে আপোষ রফার ক্ষেত্রে আদালত অনেক সময় নির্লিপ্ত থাকেন।
- মেডিকো লিগ্যাল ও সাক্ষ্য প্রমাণের ক্ষেত্রে টু-ফিঙ্গার টেস্টের এর মতো অবমাননাকর পদ্ধতি উচ্চ আদালতের রায়ে নিষিদ্ধ হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া এখনও প্রচলিত।
- দেরিতে ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষার কারণে আলামত নষ্ট হয়ে যাওয়া।
- মেডিকেল রিপোর্ট সঠিকভাবে না লেখা।
কোনো বয়সের নারী ও শিশু কি নিরাপদ?
ধর্ষণের শিকার ২৫ জন নারী ও শিশুর মধ্যে প্রতিবন্ধী নারী ৩ জন।
৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশু ৪ জন।
১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু ৫ জন।
১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী কিশোরী ও নারী ১৬ জন।
অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে ২টি ধর্ষণের ঘটনায় ২জন প্রতিবন্ধী নারীর ২টি সন্তান হয়েছে। কিন্তু এই শিশু দুটি এখনো পিতৃত্বের পরিচয় পায়নি। ধর্ষণের ফলে জন্ম হওয়া শিশুর দ্বায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করার কথা থাকলেও সেটা কার্যকর হচ্ছে না।
এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম সংবাদ সম্মেলনের বলেন, ধর্ষণ ঘটনার দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শান্তি না হওয়ায়, প্রকৃত অপরাধীরা উৎসাহতি হচ্ছে। সেইসঙ্গে ধর্ষণের ঘটনা না কমে বরং বেড়েই চলছে।
সংবাদ সম্মেলনে ধর্ষণের শিকার নারীর ন্যয়বিচার নিশ্চিতে কয়েকটি দাবি জানানো হয়েছে।
ধর্ষণ-সংক্রান্ত আইন সংস্কার করা
সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন
নির্ধারিত সময়ে তদন্ত ও বিচার শেষ করা
আইনি বিধানগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা করা
দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা
ধর্ষণের মামলা আপোষ করা বা আপোষের চেষ্টা করাকে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা।
প্রয়োজনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১৫ ও ১৬ ধারা সংশোধন করা। আর ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে ভাষা ও শ্রবণ এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যাতে ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য দিতে পারে, এমন ব্যবস্থা রেখে আইনটির সংশোধন করা।
এছাড়া কেবলমাত্র আইনজীবীর সহযোগিতা না দিয়ে ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশু এবং সাক্ষীর আদালতসহ বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত ও অন্যান্য ব্যয় বহন করার দাবিও উঠেছে সম্মেলনে। এছাড়া পুলিশ, বিচারক, আইনজীবী, চিকিৎসক, কোর্ট স্টাফ ও ধর্ষণ মামলার বিচার সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের জেন্ডার সমতা, হাইকোর্টের নির্দেশনা, সংস্কারকৃত আইন, সম্পর্কে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
যে ৭ টি সহযোগী সংগঠন এই কাজে সহায়তা করেছে, তারা হচ্ছে, নারীপক্ষ, সিআরপি, প্রতিবন্ধী উন্নয়ন পরিষদ, পল্লীশ্রী, সাবলম্বী উন্নয়ন সমিতি, পিপলস অরিয়েন্টেড প্রোগ্রাম এবং মহিদেব যুব কল্যাণ সমিতি।