অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সবুজ মাসাল আর কারাজের বর্ণিল টিউলিপের উপত্যকায়

শাওলী মাহবুব

প্রকাশিত: ০৪:৫৮ পিএম, ১৩ জানুয়ারি ২০২১ বুধবার   আপডেট: ০৪:৫৯ পিএম, ১৩ জানুয়ারি ২০২১ বুধবার

বাংলাদেশি কন্যা আকতার জাহান মিলি তার ইরানি স্বামী হাসানের সাথে পায়ের তলায় সর্ষে নয় বরং দু’পায়ে চারচাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ান সারাক্ষণ। সুহৃদ এই বন্ধুর কাছে খবর মিললো হাজারো টিউলিপ ফুটেছে খুব কাছের এক বাগানে; সাথে হোয়াটস অ্যাপে এক মনকাড়া ছবি। খুব কাছে বলতে তেহরান থেকে ঘন্টাখানেকের ড্রাইভ। কারাজ প্রদেশের আলবোর্জ পর্বতচূড়ার আড়ালে, প্রায় লুকিয়ে থাকা কন্দর গ্রামে।

ছবিটি দেখে মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম অবশ্যই যেতে হবে এ বাগান দেখতে। কবে না কবে ইউরোপ যাওয়া হবে, তারপর নেদারল্যান্ডস, তারপর টিউলিপ বাগান। না অতোটা ধীর ধৈর্যের মানুষটি আমি নই। কাজেই সিদ্ধান্ত হলো যাবো। কিন্তু বললেই তো আর হলো না। সাথে এ হিসেবও ছিলো যে মানব ইতিহাসের এক বিশেষ সময় পাড়ি দিচ্ছি আমরা। করোনা মহামারী! তিন মাস হতে চললো লকডাউন চলছে ইরানে। মাত্রই ক’দিন হলো সীমিত পরিসরে খুলছে দোকান-পাট আর গাড়ি। এখনও হোটেল, কটেজ সমস্তই বন্ধ। কাজেই বের হওয়া অতো সহজ কথা নয়। ঘুরতে যাবার অনুরোধ জানালাম আরেক সুহৃদ ইরানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সহধর্মিনী সাদিয়া আজমকে। ছবি দেখে তিনিও সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হলেন। তবে শুধু টিউলিপ বাগান নয়। একটু লম্বা হয়ে গেলো ভ্রমণ-পরিকল্পনা। ঠিক হলো প্রথমে যাবো ইরানের উত্তরে মাসাল প্রদেশ; সেখান থেকে চালুস রোড হয়ে কারাজের টিউলিপ বাগানে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে কারাজের কন্দর গ্রামের টিউলিপ বাগানে।

৮ মে ২০২০ সকালবেলা রওনা হলাম। মার্চ একুশ থেকে ইরানে বাহার বা বসন্তের শুরু। তবে, তেহরানকে তিনপাশে ঘিরে থাকা আল-বোর্জ এর চূড়ায় এবার এখনও, এই মে মাসেও বরফ। তেহরানবাসীদেরই রীতিমতো যা বিস্মিত করেছে। বসন্তে বাগানগুলোতে যে ফুলের সমারোহ থাকে তাতে করে ইরানিদের ঘরে থাকা দায়। গাড়িতে একটা তাবু নিয়ে হলেও তারা চলে যায় সোমাল বা উত্তর ইরান। এটা তাদের মূল পর্যটন অঞ্চল। কাস্পিয়ানকে ঘিরে বেশ অনেকগুলো শহর রয়েছে সোমালে। গিলান, মাজানদারান, গোলেস্তান এখানকার প্রধান প্রদেশসমূহ আর চালুস, আমল, রামসার, বাবল, আনজালি, রাসত, সারি এবং কায়েম শাহ্র উত্তরের প্রধান প্রধান শহর। এখানে কোথাও সমতলীয় জলবায়ু, কোথাও পার্বত্য অঞ্চলের জলবায়ু আবার কোথাও বা আধ-শুষ্ক জলবায়ু দেখা যায়, ঋতুভেদে যাদের সৌন্দর্যের ভিন্ন ভিন্ন রঙ রয়েছে। মাসাল তেমনই গিলান প্রদেশের এক ছোট শহর। মাসালের পাহাড়গুলো বসন্তে একদম সবুজাবৃত থাকে। মাসালে গেলেই আমার মনে হয় বাংলাদেশে চলে এসেছি। ঠিক করা হলো পাহাড়ের গায়ে সেঁটে থাকা দুটো কটেজে এক রাত কাটাবো। ব্যক্তিগত গাড়ি হওয়ায় নিজেদের কম্বল, বেডকভার, রুম জীবাণুনাশক এর ছোটখাটো একটা ড্রাম অর্থাৎ লোটকম্বল সমেত রওনা হলাম মাসালে।

মাসালে যেতে রাস্তার মাঝ বরাবর রুদবার নামের এক শহর আছে, যা কিনা “উইন্ডি সিটি” নামে পরিচিত। পথে পড়ে যাওয়া রুদবারের শেফিদ নদী আর শেফিদ বাঁধ অসাধারণ এক আবহ তৈরি করেছে। আমরা বাংলার মানুষেরা নদী বললেই বড় কিছু ভেবে ফেলি। কিন্তু ইরান নদীর দেশ নয়। এখানে পানি সঙ্কটও বেশ। শুধুমাত্র শীতকালে বৃষ্টি আর তুষারপাতের পর পানির উচ্ছ্বাস দেখা যায় বয়ে চলা এই নদীগুলোতে। পাহাড়ি পাথুরে পথে চলতে থাকা রুমঝুম শব্দের খরস্রোতা নদীগুলো আসলে এক একটি বয়ে চলা ঝর্ণা। শেফিদ নদীটি ছোট হলেও বেশ স্বচ্ছ। ফারসি শেফিদ অর্থ হলো সাদা। শেফিদ নদীতে “শেফিদ মাহী” বা “সাদা রঙে”র একরকমের মাছ আছে। সঙ্গে থাকা ইরানি মাসুদ জানালেন স্বাদে মাছটি আমাদের ইলিশ মাছের মতো।
 
মাসাল যাবার পথে গিলান প্রদেশে নামলাম হযরত আব্দুল কাদের গিলানি (রা.) (যিনি আমাদের দেশে হযরত আব্দুল কাদের ‘জিলানি’ নামে পরিচিত হলেও ইরানিরা বলে গিলানি) এর মা উম্মুল খায়ের ফাতিমা (রা.) মাজারে। হানবালি সুন্নি ধারার ইসলাম প্রচারক হযরত আব্দুল কাদের গিলানি (রা.) ১০৭৮ খ্রীস্টাব্দে জন্মেছিলেন এই গিলান প্রদেশেই। যদিও তিনি সমাহিত হয়েছেন ইরাকের বাগদাদে। গিলানে এসে তাঁর জন্মস্থানটি দেখার লোভ সামলানো গেলোনা। মাজারটির দেখভাল করেন একজন ইরানি নারী খাদেম। মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পড়া তাঁর। চাবি হাতে তালা খুলতে খুলতে জানালেন তিন মাসে এই প্রথম খোলা হলো মাজার প্রাঙ্গণ।

মাজার প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে মাসাল পৌঁছুতে পৌঁছুতে আমাদের বিকেল তিনটা বেজে গেলো। বিকেলের নম্র আলো তখন পাহাড়গুলোর সবুজ মায়াবী গায়ে। আমাদের জন্য বরাদ্দ কটেজ দুটো বেশ উঁচুতে। কটেজের চারপাশ ঘিরে আছে সবুজ পাহাড়। কটেজ মালিকের বয়স তিরিশের কোটায়। একসময় তেহরানের ছোটোখাটো চাকুরি করেছেন তিনি। সেটা ছেড়ে দিয়ে মাসালেই থিতু হয়েছেন এখন। মা, স্ত্রী এবং পাঁচ ও সাত বছরের দুই ছেলেকে নিয়ে পর্যটকদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কটেজ ভাড়া দেয়াসহ একটি মাছের ফার্মের ব্যবসাও আছে তার। সেখানে স্টারজান মাছ এবং ট্রাউট মাছের দেখা মিললো।এখানকার স্টারজান মাছটি একদম ছোট আকারের কুমিরের মতো দেখতে এবং কেভিয়ারের জন্য এ মাছটি বিশ্ববিখ্যাত। ফার্ম ঘুরে দেখার পাশাপাশি বাচ্চারা এরই মধ্যে এক ঝর্ণার খবর পেয়ে গেলো এবং কখন যেনো পাহাড়ি খাড়া গা বেয়ে সে ঝর্ণা দেখেও এলো।

বিকেলবেলা পাহাড়ের গায়ে ঢলে পড়া সূর্যের অস্ত যাওয়া দেখার জন্য বেরিয়ে গেলাম সবাই মিলে। পাহাড় চূড়ায় যেতে যেতেই দেখতে পেলাম বিভিন্ন স্থানে ইরানি পরিবারগুলো বনভোজনে মেতেছে। একটু মায়া হলো। ইরানিরা এসময় কখনোই ঘরে থাকে না। এবার দীর্ঘসময় তারা গৃহবন্দী। কাজেই লকডাউন একটু শিথিল হতেই রাস্তার পাশে পাহাড়ের গায়ে দূরত্ব রেখে রেখে অবস্থান করে, আনন্দ পাবার চেষ্টা করছে।

এসব ভাবতে ভাবতেই বুঝলাম চলার পথের হিম হিম পাহাড়ি বুনো বাতাস আমাদের শরীর মন সব জুড়িয়ে দিচ্ছে। পথেই দেখা পেলাম সবুজ মখমলে ঢাকা এক উপত্যকার। সবুজ ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে নাম না জানা বুনো নীল ফুল ফুটে ছিলো। মনশান্ত করা এসব ছবি দেখতে দেখতে কখন যেনো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার মিটার উপরে উঠে গেলাম। উচ্চতা মাপার যন্ত্র জানান দিলো আমরা একদম চূড়ায় পৌঁছে গেছি। যেখান থেকে কোথাও যাবার আর কোন পথ নেই। এখানে আর কোন সবুজও নেই। শুষ্ক পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা বরফগুলো তীব্র কঠিন হিম ছড়াচ্ছিল সেখানে। সূর্যাস্তের নিবিড় আলো, নিঃসঙ্গ জায়গাটিতে শেষ বিকেলের কিরণ ছড়িয়ে কেমন রহস্যময় করে তুললো। ফারসিতে পাহাড়কে বলে “কুহ”। সেই অজানা হিমপুরী আমার কাছে এক কুহেলিকা মনে হলো। কতটা বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে ওখানে যেতে হয় সেটা আর নাই বলি। কোন দক্ষ ড্রাইভার ছাড়া ওখানে যাওয়া মানে হলো এক সেকেন্ডের সিদ্ধান্তের হেরফেরে গাড়ি দু’হাজার মিটার নিচে গিয়ে পড়া। কাজেই দক্ষ চবলক ছাড়া ওখানে না যাওয়াই শ্রেয়। সূর্যাস্তের পর ফিরে এলাম কটেজে।

ধীরে রাত নেমে এলো ইরানি পাহাড়ি গাঁয়ে। রাতের খাবারের আয়োজন চলল। আমি আমার কটেজের বারান্দা থেকে দেখছিলাম কী করে ইরানি বধূ তার স্বামীকে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করছেন। মাথায় স্কার্ফ বাঁধা, সাথে লং স্কার্ট টপস পরা। ঘর থেকে জিনিসপত্র এনে সাজাচ্ছিলেন তার ঘরের বারান্দায়। রাতের খাবারের পরিবেশনা ওই বারান্দাতেই হবে। পরে জেনেছি ওর নাম সুরেইয়া। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি নয়। বারান্দার মেঝেতে পাতা হয়েছে হালকা কার্পেট। রাতের খাবারের আয়োজনে কটেজ মালিক নিজেই সাহায্য করলেন। বারবাকিউতে আমাদের পছন্দ করা মাছ এবং মুরগির উইংস ঝলসে দেয়া হলো। সাথে পরিবেশন করলেন ঘরে তৈরি মাখন, পনির, পাউরুটি, মাসালের বিখ্যাত আস্ত রসুনের আচার আর টকদই। ইরানি সুমিষ্ট চালের ভাত তো ছিলোই। আমাদের সাথে থাকা দুজন ইরানিসহ সবমিলে সাতজন বসে গেলাম খেতে। কটেজ মালিক স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মাঝে মাঝে খবর নিচ্ছিলেন। খাওয়া পর্ব শেষে দীর্ঘরাত জুড়ে আড্ডা জমল। বিষয় ইরানি আর বাঙালি নারীর সংসার। এখানে উল্লেখ্য ইরানি নারীরা অত্যন্ত কর্মঠ এবং বেশ দাপটের সাথে তারা সংসার বা ব্যবসা চালান। খাওয়া-আড্ডার সময়টিতে আসলে ভুলে গিয়েছিলাম করোনা মহামারী, সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক, গ্লাভস পরা ইত্যকার সমস্ত কিছু। এগুলো পরার তাড়া পাইনি তখন আর মন থেকে। পাহাড়ি মৃদুমন্দ বাসন্তী বাতাসে শরীর মন প্রশান্তিতে ভরে ছিলো, মনে হচ্ছিল পুরোনো চেনা পৃথিবীতে আবার ফিরে গেছি যেখানে মাস্ক, গ্লাভস কিছুই পরার প্রয়োজন নেই। তবে কটেজে ফিরে রুম, বালিশ, বেডকভার কম্বল ডিসইনফেক্ট করে তবেই ঘুমোতে গেছি। পরদিনের গন্তব্য কারাজের টিউলিপ বাগান।
 
বাঙালি নারীর শাড়ি-প্রীতি সাংঘাতিক। পরব না পরব করেও ফুলবাগানে ছবি তোলার শখে পরে ফেললাম এক সাদা জামদানি শাড়ি। সেই সাথে পরতে হলো মাস্ক ও গ্লাভস। কাজেই বোঝা বেড়ে গেলো কয়েক গুণ। সকাল এগারোটায় রওনা হলাম কারাজের টিউলিপ বাগানের উদ্দেশ্যে। উত্তরের অনেকগুলো শহর ঘুরতে হলো। দেখলাম কোন শহরই তখনো খোলেনি। দোকানপাট, বড় বড় শপিং মল সব কিছুই বন্ধ। দুপুরে একটু থেমে নিলাম রামসার শহরে। সেখানে কাস্পিয়ান সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে একটু সতেজ হয়ে নিলাম। অবশেষে অনেকগুলো শহর পেরিয়ে পৌছুঁলাম চালুস শহরে।

চালুস উত্তরের মাঝামাঝি শহর। এশহরেও সবকিছু বন্ধ।  “চালুস রোড” সেদিন সবে খুলে দেয়া হয়েছে। সাংঘাতিক গাড়ির জ্যাম পুরো রাস্তায়। চলতে শুরু করলাম চালুস রোড - বিশ্বের চতুর্থ ভয়ঙ্কর সুন্দর রাস্তা ধরে। আকাশ ছোঁয়া এ রাস্তা ইরানিদের গর্ব আর আমাদের মতো সমতলী পর্যটকদের জন্য অপার বিস্ময়। চালুস রোড নিয়ে আলাদা প্রবন্ধ লিখেছি। কাজেই পাহাড়ি এ পথের সৌন্দর্য বর্ণনার ক্ষেত্রে এবার আর না যাই। তবে এটুকু বলতে হয় পাহাড়ি রাস্তার পাশের ঝর্ণাগুলোতে এবার এতো বেশি পানি ছিলো যে গাড়ির জানালা বারবার খুলতে হয়েছে সে সৌন্দর্য দেখার জন্য।

মাসাল থেকে রওনা দিয়ে প্রায় ছ’শো কিলোমিটার যেতে যেতে বিকেল নেমে এলো। বেলা যতো পড়ে আসছিল আমাদের উদ্বিগ্নতা ততো বাড়ছিল কারণ সন্ধ্যায় বাগানের সৌন্দর্য দেখা মুশকিল হয়ে যাবে। পাহাড়ি এলাকায় সন্ধ্যা নামে খুব তাড়াতাড়ি। সে আরেক সমস্যা। এখন বেলা ডুবছে ইরানি সময় আটটায়। ঘড়ির প্রতিটি সেকেন্ডও তখন সূর্যের শেষ আলো পাবার জন্য মূল্যবান। অবশেষে সৃষ্টিকর্তা মুখ তুলে চাইলেন। আবারো এক বিপদসংকুল পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে “শেষ বেলাকার” শেষের আলোয় দূর থেকে দেখতে পেলাম কন্দরের টিউলিপ গার্ডেন। চারপাশের ধূসর আলবোর্জের মাঝখানে ঝলমলে, বর্ণিল সব রঙের হাসি। ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা আটটা ছুঁই ছুঁই। আগে থেকে যোগাযোগ করে যাওয়ায় বাগানের মালিক আলী রেজা মোস্তফা নিজেই এলেন অভ্যর্থনা জানাতে।

টিউলিপের এক “এশিয়ান ইতিহাস” রয়েছে । টিউলিপ শব্দের উৎপত্তি পারসিয়ান শব্দ “দেলবান্দ” যার বাংলা অর্থ পাগড়ি। সাধারণভাবে মনে করা হয় পাগড়ির মতো আকার বলে একে এমন নাম দেয়া হয়েছে। ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যাই হোক এটা ভীষণ সত্যি যে, পাগড়িতে টিউলিপ পড়া একটা সময় ফ্যাশন ছিলো বলে এর নাম “দেলবান্দ” রাখা হয়েছে। আবার ইতিহাসও বলে ইউরোপ নয় বরং ইরান, মধ্য এশিয়া এবং তুরস্ক থেকে টিউলিপ গেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। যা হোক কন্দর গ্রামের এই টিউলিপ বাগান ইতোমধ্যেই ইরানের “টিউলিপ রাজধানী” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ত্রিশ ধরণের ২১ লাখ টিউলিপ ছিলো এবার বাগানটিতে। ৩.৫ হেক্টর জমিতে লাল, খয়েরি, হলুদ, গোলাপি টিউলিপগুলো রঙের স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছিল। স্বর্গের সব রঙ যেন ভুল করে মর্তে নেমে এসেছে। এ স্বর্গীয় রঙ মনের রঙে মিলে অদ্ভুত এ আনন্দের সঞ্চার করল সবার মাঝে। করোনার সময়েও এখানে প্রচুর ভিড় জমে আছে। প্রাণঘাতি ভাইরাসকে যেন থোরাই কেয়ার। মরণের আগেই এমন স্বর্গ পেলে কার তখন মরণের কথা মনে থাকে। এখানে এসে তাই ভুলে যেতে হলো করোনার সমস্ত সতর্কতা। সতর্কতার শেষ চি‎‎হ্ণ হিসেবে হাতে শুধু “গ্লাভসখানি” রইলো।

কারাজের আদারান জেলায় কন্দর গ্রামের টিউলিপ বাগানটি একান্ত ব্যক্তিগত একটি উদ্যোগ। বাগান মালিক জানালেন মধ্য মার্চ থেকে মধ্য মে পর্যন্ত টিউলিপ ফুলগুলো বাগানে থাকে। তবে কখনো কখনো জুন পর্যন্তও ফুল পাওয়া যায়। বাগান পরিদর্শনের জন্য কিছু প্রবেশমূল্য ধার্য করা আছে। প্রবেশপথে ইরানি মুদ্রা বিশ হাজার তোমান বাংলাদেশি মুদ্রার হিসাবে ১০০ টাকা দিয়ে তবেই ঢুকতে হয় এই স্বর্গে। এবার লকডাউন থাকায় মওসুমের অর্ধেক সময় পর্যটকরা আসতে পারেননি। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে মাত্রই দিন সাতেক আগে বাগান খুলে দেয়া হয়েছে পর্যটকদের জন্য। তবে পুরোদিনের জন্য নয়। একেকবারে মাত্র দু'ঘণ্টার জন্য বাগানটি খুলে দেয়া হয়েছে দর্শকদের জন্য এবং প্রতিটি গ্রুপের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পনেরো মিনিট সময়। পাহাড় চূড়ায় কঙ্কর সমৃদ্ধ মাটিকে আলীরেজা মোস্তফা কী করে স্বর্গোদ্যানে পরিণত করলেন তা এক বিস্ময় বটে!

বাগানের পাশাপাশি আলীরেজা এক রেস্তোরার ব্যবসাও চালু রেখেছেন। আমাদেরকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে তিনি এক মাটির ঘরে নিয়ে গেলেন। প্রায় দেড়শ বছর আগে তাদের দাদা-দাদীর পরিবারে যে ধরণের সংস্কৃতি চালু ছিলো সেগুলো তিনি দেখালেন। আমরা মাটিতে পেতে রাখা কার্পেটে বসলাম। আমাদের সামনে একটু উঁচু যে টেবিল রাখা ছিলো তাকে ইরানিরা “কোরসি” বলে। তেহরানে দেখেছি ছোট যেকোন টেবিলকে ইরানিরা কোরসি বলে। কিন্তু এখানে এসে জানলাম এটা এক বিশেষ টেবিল। এ টেবিলের উপরে বিছানো এক কম্বল নেমে এসেছে মাটি পর্যন্ত। যেখানে আপনি কার্পেটে বসে, শীতকালে কম্বলে পা ঢুকিয়ে আরাম করে খাবার খেতে পারবেন। শীতপ্রধান এলাকা বলে ইরানিরা এই বিশেষ খাবার টেবিল আবিষ্কার করেছে। আমরাও এ কম্বলে পা মুড়িয়ে বসে বেশ কিছুক্ষণ উষ্ণতা উপভোগ করলাম। ইফতারের সময় হয়ে যাওয়ায় বাগান মালিক আমাদের চা, খেজুর এবং ঐ এলাকার বিশেষ এক পিঠা দিয়ে ইফতার করালেন।
 

এবার ফেরার পালা। তিন মাসের ক্লান্তিকর লকডাউন শেষে মাসাল আর কারাজের টিউলিপ বাগান থেকে নতুন সজীবতা বুকে নিয়ে তেহরান ফিরে এলাম। বুঝলাম মানুষ প্রকৃতির ভালোবাসা ছাড়া বাঁচতে পারে না, সে আপনার ঘরে যতো কৃত্রিম সুবিধাই থাকুক না কেনো। প্রকৃতি তার বাতাস, আলো, মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আর সম্পদ দিয়ে মানুষকে শারীরিক মানসিকভাবে সুস্থ রেখে চলেছে আজ অব্দি। আর আমরা মানুষেরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করে করোনা ভাইরাসের মতো দানব তৈরি করে চলেছি। প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এ ভ্রমণ যেন আমাদের সে শিক্ষাই দিল। ইরানে লকডাউন এখনো পুরোপুরি খোলেনি। আমরা অত্যন্ত সতর্কতা নিয়ে দু’দিনের ভ্রমণ সম্পন্ন করেছি। যদি করোনাকালে ভ্রমণ করতে হয় তবে স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি আইন মেনে চলুন। সর্বোচ্চ সতর্কতা রাখুন করোনা ভাইরাস থেকে দূরে থাকার। নিরাপদে থাকুন।