সাগর থেকে বিদ্যুৎ
শেখ আনোয়ার
প্রকাশিত: ১১:২৪ এএম, ১২ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার আপডেট: ১১:২৫ এএম, ১২ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার
বিদ্যুৎ ছাড়া জীবন সভ্যতা অচল। কথাটা সবাই জানি এবং মানি। অবাক হলেও সত্যি, আমাদের দেশে এক যুগ আগে সবসময় বিদ্যুৎ থাকতো না। সন্ধ্যাবেলায় মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়তে বসতে হতো। তখন সারাক্ষণ লোডশেডিং হতো। এই বিদ্যুতে আমাদের চাহিদা পূরণ না হওয়ায় বর্তমানে পারমাণবিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন শেখ হাসিনা সরকার। দেশের বিদ্যুৎ সঙ্কট মোকাবেলায় জরুরি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয়ায় বাংলাদেশ এখন আলোয় উজ্বল। বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশ থেকে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্তের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে বাংলাদেশ। এখন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতায় এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বিদ্যুতের এই প্রচলিত উৎস বর্তমানে অপ্রতুল। তাই বিদ্যুতের অপ্রচলিত উৎস ব্যবহার এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাল উত্তীর্ণ হয়ে প্রয়োগের প্রচেষ্টা চলছে। এই অপ্রচলিত উৎসগুলোর মধ্যে সাগর একটি টেকসই উৎস। সাগরের ঢেউ থেকে শক্তি, সাগরের ঢেউ থেকে বিদ্যুৎ, এমন কথা অনেক বছর ধরেই শোনা গেছে। কিন্তু সেসব ধারণা বাস্তবে প্রতিফলিত হয়নি। কম দামের বিদ্যুতের জোগান দিতে পারেনি সাগরের বিশাল বিশাল তরঙ্গ মালা। সাগরের ঢেউ থেকে বিদ্যুৎ ছিলো এক স্বপ্ন।
এমনটি মনে হবেই না কেনো? আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে সাগরবেষ্টিত কয়েকটি দেশের গবেষকরা গবেষণা করেছেন। এমনকি বেসরকারি উদ্যোগেও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছিলো। উনিশ’শ নিরানব্বই সালে এক ঝড়ে সে উদ্যোগও ভেস্তে যায়। সে সময় সাগরের তরঙ্গ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রত্যাশার সমাধি ঘটে। এবার একদল বিজ্ঞানী আশা জাগিয়ে বলেছেন, হতাশ হওয়ার কোনো কারণই নেই। সাগর শক্তি জোগাতে পারবে। সৌর এবং বায়ু শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপারে যতোটা আশাবাদী, সাগর থেকে তার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সাগরে বয়া বসিয়েছেন। এসব বয়ার ভেতর পিস্টন বসানো রয়েছে। সাগরের অসংখ্য ঢেউয়ের তালে তালে বয়া ওঠানামা করবে। সেই সঙ্গে এর ভেতরের পিস্টন একটি জেনারেটরকে ঘুরাবে এবং বিদ্যুৎ জমা হবে ব্যাটারিতে।
প্রাথমিকভাবে বসানো একটি বয়া থেকে এভাবে এক কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা গেছে। নৌবাহিনীর প্রহরার কথা মনে রেখে এই বয়া বসানো হয়েছে। প্রহরার কাজে ব্যবহৃত মানুষবিহীন ডুবোজাহাজে শক্তির জোগান দেয়ার কাজে এসব বয়া সাহায্য করবে। কাজ করতে গিয়ে শক্তি ফুরিয়ে গেলে সেগুলো সাগরে বসানো বয়ার কাছে গেলে সেখান থেকে নিজের পুরনো ব্যাটারি বদলে নেবে এবং এ কাজের জন্য কোনো মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন পরবে না। এক’শ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম এমন একটি বয়া দুই বছরের মধ্যে বানানোর পরিকল্পনা বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে হাতে নিয়েছেন। তারা উপকূলের এই ঢেউভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানোর কথা ভাবছেন। এর উৎপাদন ক্ষমতা দশ থেকে একশ’ কিলোওয়াট হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বয়ার মধ্যে যেহেতু কোনো জটিল যন্ত্রপাতি থাকছে না, তাই এসব বয়া কয়েক দশক ধরে সচল থাকবে। এ জাতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কোনো রকম ভর্তুকির প্রয়োজন পড়বে না বলেও বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
বর্তমানে এসব বয়া দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে বেশ খরচ পড়ছে। এভাবে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাজার দরের দ্বিগুণ। তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হলে দাম কমে আসবে। ঢেউ বিদ্যুৎ তৈরির জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রে খরচ হবে পঞ্চাশ লাখ ডলার। সাগর বিদ্যুতের উৎস ফুরিরে যাবার ভয় নেই। আমদানিরও প্রশ্ন নেই। একবার ব্যবস্থা করে নিলে যুগ যুগ ধরে সুলভে পাওয়া যাবে বিদ্যুৎ। এতে কয়লা পেট্রোলিয়ামের ব্যবহার কমবে। পারমাণবিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করারও দরকার হবে না। যখন-তখন বিদ্যুৎ বেগে, বিদ্যুৎ চলে চলে যাবে না।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।