মেয়েটি দেখতে ভীষণ সুন্দর ও মেধাবী, তবে ভারতীয়
কৈশোরেই ব্রিটেনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক বাঙালি নারীর গল্প
মুনতাসির সিয়াম
প্রকাশিত: ১২:০৪ পিএম, ৯ জানুয়ারি ২০২১ শনিবার আপডেট: ০৪:০৭ পিএম, ৯ জানুয়ারি ২০২১ শনিবার
ডরোথী ব্যানার্জীর জন্ম ভারতে। বেড়ে ওঠা ইংরেজ কায়দায় ব্রিটেনে, সে হিসেবে একজন ইংরেজ। বিয়ে করে স্বামীর সুবাদে পরবর্তীতে হয়েছেন ফরাসিও; আর মনে প্রাণে তিনি একজন ওয়েলস (যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত একটি দেশ)।
অন্যভাবে বলতে গেলে, ডরোথী চিরকলাই একজন বহিরাগত। কখনো সুযোগের ভিত্তিতে, আবার কখনো বা নিজের পছন্দে। এমনকি তার কিশোরী বয়স থেকেই পাওয়া যায় এমন সব উদাহরণ। ১৯১৪ সালে তিনি ওয়েলসের সবচেয়ে সম্মানজনক সাংস্কৃতিক পুরস্কার অর্জন করেন, যা কিনা একইসঙ্গে তার জীবনেরও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। সে সময় এ ঘটনাটি বেশ সাড়া ফেলেছিলো, যার আসল কারণ- প্রকৃতপক্ষে তিনি ওয়েলস ছিলেন না। প্রথম নারী হিসেবে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের একটি আইন বিষয়ক ডিগ্রি অর্জনের মধ্যদিয়ে আবারও আলোড়ন তোলেন তিনি। তারপরও বহিরাগত হওয়ায় বারবারই তাকে হতে হয়েছে বঞ্চনার শিকার।
ভারতে থাকাকালীন সময়ে ডরোথী ও তার পরিবার শ্রেণী, সংস্কৃতি এবং ধর্মের মধ্য দিয়ে অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে পড়েছিলেন। তারা ছিলেন উচ্চবর্ণের বাঙালি ব্রাহ্মণ, যদিও তার শৈশব কেটেছে সাদাসিধে ভাবেই। নেপালের সীমান্তবর্তী এলাকা রামপুরে (বাংলা থেকে কয়েক মাইল দূরে) নিজেদের পারিবারিক এস্টেটে থাকতেন তারা। পরে ডরোথীর পরিবারের সবাই খ্রিস্টান ধর্মও গ্রহণ করেন। ধর্ম বদলের পর ডরোথীর দাদা স্কটিশ যাজক বা পাদ্রী হিসেবে কাজ করেন কলকাতায় অবস্থিত স্কটিশ মিশনারি আলেকজান্ডার ডাফে। ১৯০৪ সালে এসে ঘটে ডরোথীর ‘ভারতীয়’ জীবনের পালাবদল। সে সময় তার বয়স মাত্র দশ বছর। অথচ স্কুলে পড়ার জন্য দুই ভাই বার্টি ও নীলের সঙ্গে তাকেও পাঠিয়ে দেয়া হয় লন্ডনে। ডরোথীর বাবা-মা দুজনেই বেশ অনেকটা সময় পার করেছেন ব্রিটেনে। তাই তাদের ইচ্ছা ছিলো- সন্তানেরা যেন বেড়ে ওঠে ইংরেজ কায়দায়।
আরও পড়ুন: ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৪
লন্ডনে যাওয়ার পর ডরোথীদের তিন ভাই-বোনের পুরনো একটি ছবি অক্ষত আছে এখনও। সে ছবিতে ডরোথীকে দেখা যাচ্ছে সাদা পোশাকে সংযমী এক বালিকা রূপে, সঙ্গে পরিপাটি করে কালো ফিতায় বাঁধা চুল; আর তার বড় ভাই বার্টির পরনে স্যুট-টাই। এ ছবিটি খুব স্পষ্টভাবেই তুলে ধরেছে তাদের ইংরেজ হয়ে উঠতে চাওয়ার গল্প, যদিও চারপাশের লোকের চোখে তারা বরাবরই ভারতীয়।
ডরোথীর বাবা পেশায় ছিলেন একজন ব্যারিস্টার (আইনজীবি), একইসঙ্গে ভূস্বামী বা জমিদারও। ডরোথী বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন তার মায়ের সঙ্গে, যিনি কিনা মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে বেশ দৃঢ় মনোভাবী। বোঝাই যাচ্ছে- ব্রিটেনে মেয়েদের ভোটাধিকারের পক্ষে সক্রিয় সমর্থক ছিলেন মা মেয়ে দুজনেই, ব্রিটেনই হোক বা ভারত; কোন জায়গাতেই মেয়েদের সুযোগ সুবিধার তেমন একটা চল ছিলো না তখন। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে বলা যেতে পারে- মূলত মায়ের জন্যই ডরোথী তার ভাইদের মতোই সুযোগ পেয়েছিলেন ভালোমানের শিক্ষা অর্জনের। সময়ের হিসাবে সে ঘটনাটি বিরল বললে ভুল হবে না মোটেও। ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টল) ড. সুমিতা মুখার্জীর ইংল্যান্ড ফেরত ভারতীয়দের নিয়ে লেখা একটি বই থেকে বোঝা যায় অন্তত এমনটাই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভারতীয় শিক্ষার্থী ছিলো প্রায় হাজার খানেক, যার মধ্যে ৫০-৭০ জন শিক্ষার্থী শুধু নারী।
বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিলো ডরোথী পড়তে যাবেন ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনে। কিন্তু পারিবারিক লোকাচার দেখে দেখে লন্ডন হয়ে উঠেছিলো তার কাছে রুচিবাগীশদের আঁখড়া, মানে সুরুচি ও শোভনতা সম্পর্কে অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে আর কী। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন সমুদ্রতীরবর্তী শহর অ্যাবেরিস্টুইথ ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ ওয়েলস, যেখানে ওয়েলস ভাষীদেরই প্রাধান্য। মেয়ের এমন সিদ্ধান্ত বাবার পছন্দ হয়নি একেবারেই, যদিও বাবার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ডরোথী পড়তে যান নিজের পছন্দের জায়গাতেই। তবে তাকে একা ছাড়া হয়নি, বোনের সহচর হিসেবে বড় ভাই বার্টিও ভর্তি হন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। ডরোথীর সেদিনের সে সিদ্ধানটি পরিণত হয়েছিলো কলেজের প্রগতিশীল মর্যাদায়। এক্ষেত্রে তুলে ধরা যেতে পারে অ্যাবেরিস্টুইথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সংরক্ষণাগারাবিদ ও ইতিহাসবিদ ডঃ সুসান ডেভিসের মন্তব্য। তিনি বলেছেন, অ্যাবেরিস্টুইথ ইউনিভার্সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি নীতিই ছিলো- সমস্ত ধর্মীয় অনুশাসন এবং সাংস্কৃতিক পটভূমিকে বরণ করে নেয়া। এ ছাড়া এটি ছিলো ওয়েলসের সবচেয়ে পুরনো ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও একটি, যারা কিনা লিঙ্গীয় সমতায় বিশ্বাসী।
আরও পড়ুন: সিলভিয়া প্লাথের শেষ বই
বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর ডরোথী দেখেন অর্ধেক শিক্ষার্থীই সেখানে নারী, যা কিনা সংখ্যার বিচারে তখনকার সময়ের বেশিরভাগ ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় অনেক বেশি। ১৯১৬ সালে তার স্নাতক সমাবর্তনের সময় দেখা যায়- অনেক পুরুষই যখন ফ্ল্যান্ডার্স এবং ফ্রান্সে লড়াই করছে, তখনো পরিষ্কার ছিলো মেয়েদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। (ফ্ল্যান্ডার্স শব্দটা আমাদের কাছে খুব একটা পরিচিত নয় হয়তো। এটি বেলজিয়ামের উত্তর অংশে অবস্থিত ডাচ ভাষী মানুষের একটি এলাকা।
কলেজে পড়াকালীন সময়ে সাহিত্য এবং বিতর্ক শাখায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো ডরোথীর। কলেজ জার্নাল বা সাময়িকী-তে সম্পাদনার কাজেও সাহায্য করতেন তিনি। এ সব মিলিয়েই শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ডরোথী। তবে তার সেরা দিনটি আসে ১৯১৪ সালে কলেজের বার্ষিক ইলেস্টডফোডে। (প্রতিবছর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সংস্কৃতি ও ভাষার জন্য ইলেস্টডফোড অনুষ্ঠানটি উদযাপিত হয় সমগ্র ওয়েলস জুড়ে, যা এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে রূপ নেয় জাতীয় পর্যায়ের)। জাতীয় পর্যায়ের ইলেস্টডফোডের তুলনায় কলেজের অনুষ্ঠানটি অতটাও সম্মানজনক ছিলো না, তবু সেটি একটি বড় জায়গা করে নিয়েছিলো ওয়েলস ভাষীদের মনে। নিজেদের সংস্কৃতির প্রতিচ্ছ্ববি তুলে ধরতে লেখক ও সঙ্গীতশিল্পীরা পুরস্কারের জন্য অংশ নিয়েছিলেন সে অনুষ্ঠানকে ঘিরে প্রতিযোগিতায়। প্রচলিত ওয়েলস ধারার কবিতা বিভাগে প্রতিযোগিতার মূল পর্যায়ে পৌঁছানো প্রতিযোগিদের জন্য পুরস্কার হিসেবে জিতে নেয়ার সুযোগ ছিলো- হাতে খোদাই করা একটি চমৎকার ওক চেয়ার। প্রতিযোগিতার নিয়ম ছিলো ছদ্মনামে কবিতা জমা দেয়ার, সে মতো সব কবিতাই জমা পড়েছিলো ছদ্মনামে। বিজয়ীর নাম ঘোষণার পর জানা গেল- অত্যন্ত নাটকীয় ভঙ্গিমায় ইংরেজিতে লেখা একটি গীতিকাব্যের জন্য কবিতা বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেছেন সীতা ছদ্মনামের একজন। এমন সময় সবাইকে চমকে দিয়ে উঠে দাঁড়ান মিস ব্যানার্জী ওরফে ডরোথী। এরপর নিজেকেই তিনি পরিচয় দেন সে ছদ্মনামের সীতা বলে, সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত এক করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো অনুষ্ঠান; নিমিষেই অনুষ্ঠানটি রূপ নেয় আরও বেশি আগ্রহের জায়গায়। বিজয়ী ঘোষণার পর হিন্দু লেডি চেয়ার্ড দ্য রিমার্কেবল সীনস শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় সংবাদ ছাপা হয় ওয়েলসের দ্য ক্যামব্রিয়া ডেইলি লিডার নামের একটি সংবাদপত্রে।
ডরোথীর বাবা- মা’ও তাদের ১৯ বছর বয়সী মেয়ের সফলতা দেখতে উপস্থিত ছিলেন সে অনুষ্ঠানে। উপস্থিত মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তব্যও দেন ডরোথীর বাবা। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দেশ এবং বর্ণের প্রতিযোগিকে এ ভাবে সাদরে গ্রহণ করে নেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান সবাইকে। আরও বলেন- ভারত যদি কোন কবিকে (ডরোথী-কে বোঝানো হয়েছে) জন্ম দিয়ে থাকে, তবে ওয়েলস তাকে করে তুলেছে শিক্ষিত; এমনকি কাব্যিক প্রতিভা বিকাশের সুযোগও দিয়েছে ওয়েলসই।
প্রথম বিদেশি শিক্ষার্থী ও একইসঙ্গে নারী হিসেবে কলেজ ইলেস্টডফোডে বিজয়ী হয়েছিলেন ডরোথী ব্যানার্জী। কাজেই বিজয়ী হিসেবে তার পুরস্কারের চেয়ারটি অর্জন ছিলো সত্যিই এক যুগান্তকারী ঘটনা। নিজের সফলতায় উৎসাহ পেয়ে এরপর থেকে ডরোথী নিয়মিত কবিতা লিখতে শুরু করেন ওয়েলসের বিভিন্ন সাময়িকীগুলো-তে। পুরোপুরি ওয়েলস চেতনাধারী জার্নাল বা ম্যাগাজিনগুলোও বাদ যায়নি এ থেকে, এমনকি ওয়েলস থেকে চলে আসার পরেও সে সব জায়গায় কবিতা প্রকাশের ধারাবাহিকতা বজায় ছিলো তার। সত্যিকার অর্থেই তিনি ওয়েলসদের ভালোবাসতেন। যদিও ওয়েলস ভাষী ছিলেন না তিনি, এদিক থেকে বরাবরই তিনি ছিলেন একজন বহিরাগতই; এরপরও তাকে মেনে না নেয়ার ভুলটি করেননি সেখানকার মানুষ। তবে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে ওয়েলসে মন ভাঙার কষ্টও সহ্য করতে হয়েছে ডরোথীকে।
আরও পড়ুন: মরুর পাপ
ডরোথীর ভাইঝি (ভাইয়ের মেয়ে) শীলা ব্যানার্জী, তার কাছে এখনো জমা আছে ফুফুর অনেক পুরনো একটি অনুশীলন খাতা। সেখানে ডরোথী একটি কবিতার পাশাপাশি লিখে রেখেছিলেন এক টুকরো নোট বা মন্তব্যও। সে নোটটি থেকে জানা যায়- সে সময় ডরোথীর বয়স ছিলো ২২ বছর। এক ওয়েলস শিক্ষার্থীর সঙ্গে ৩ বছরের গোপন সম্পর্ক ছিলো তার। একপর্যায়ে ছেলেটির বাবা- মা ডরোথীর উদ্দেশ্যে বলেছিলো- মেয়েটি দেখতে ভীষণ সুন্দর ও মেধাবী হলেও, পারতপক্ষে একজন ভারতীয়। জাত ভেদের কারণে বাবা- মায়ের অমত থাকায় শেষমেশ ভেঙে যায় ডরোথীর এত বছরের বাগদান সম্পর্কটি।
ডরোথীকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিলো বিচ্ছেদের ঘটনাটি। ভালোবাসার প্রতি যে বিশ্বাস ছিলো তা মনে করে অশান্ত হয়ে উঠেছিলো তার মন। সত্যি বলতে- একজন বহিরাগত হিসেবে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন তিনি, কিন্তু ভিন্ন জাত বা বর্ণের হওয়ায় যে তাকে এত বেশি কষ্টের মূল্য চোকাতে হবে; তা ছিলো ডরোথীর একেবারেই অজানা।
ডরোথীর ছোট ভাই নীল পরবর্তীতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইউনিভার্সিটি অফ অক্সফোর্ড) পড়তে শুরু করেন। আড়াআড়ি ভাবে সেখানেও একটি কুসংস্কারের প্রাচীর এসে জুড়েছিলো, অন্য বর্ণ বা জাতির শিক্ষার্থীদের মতো ভারতীয়দের তেমন একটা ভালো চোখে দেখা হতো না বিশ্ববিদ্যালয়ে। নীলের লেখার মাধ্যমে জানা যায়- তার ইংরেজ সহপাঠীদের ছিলো গোটা সাম্রাজ্যের অধিকার, যা কিনা নীলের ছিলো না; তিনি ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। এদিক থেকে ডরোথী ভীষণ সাহসী। অ্যাবেরিস্টুইথ থেকে লন্ডনে ফেরার পর, দ্বিতীয় দফায় ডিগ্রি অর্জনের জন্য কোর্সে ভর্তি হন ডরোথী ও তার ভাই বার্টি দুজনেই। প্রথম নারী হিসেবে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের একটি আইন বিষয়ক ডিগ্রি অর্জনের মধ্যদিয়ে আবারও আলোড়ন তোলেন তিনি।
পড়ালেখার পাট চুকিয়ে সন্তানেরা ভারতে ফিরে এসে কর্মজীবন শুরু করবে এমনটাই আশা করেছিলেন ডরোথীর বাবা- মা। সে মত ভাইয়েরা জাহাজে করে রওনা দিলেও, বেঁকে বসেন ডরোথী। মুক্তমনা এবং নারী সমতায় বিশ্বাসী ডরোথী স্বাভাবিক ভাবেই জড়িয়ে গেছিলেন বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধের মাঝে। তিনি আদৌও এমন কেউ তো ছিলেন না, যেখানে ভারতে গিয়ে বাবা- মায়ের ঠিক করে দেয়া বিয়েতে রাজি হয়েই শুরু করবেন স্বামীর সংসার; এমন কিছু মোটেও সহজ ছিলো তার জন্য। আর তাই পল সুরটেল নামের এক ফরাসি চিত্রশিল্পীর সঙ্গে পালিয়ে যান তিনি। ডরোথীর এমন কান্ডে খুব রেগে যান তার বাবা, যদিও মেয়ের দিকটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন মা।
আরও পড়ুন: ১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৭]
১৯২১ সালে বিয়ে করে ফ্রান্সের দক্ষিণ এলাকায় পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে শুরু করেন ডরোথী ও পল যুগল। পরবর্তীতে স্বামী পল সুরটেল যখন চিত্রশিল্পী হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন, স্ত্রীর জায়গা থেকে ডরোথী অনেকটাই চাপা পড়ে গেছিলেন অন্যদের চোখে। তাদের দুটি সন্তানও হয়েছিলো, যার মধ্যে একজন মারা যায় শিশু বয়সেই। ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে আচমকাই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের খবর শোনা যায় ডরোথীর। সে সময় তিনি অনেকটা এমন করেই বলেছিলেন- নীতিগত ভাবে দূর্বল একজন স্বামীর সঙ্গে সংসার করা আর বিবস্ত্র থাকার মাঝে বিশেষ পার্থক্য নেই।
মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর আবারও ভারতে ফেরত যাওয়ার কথা বলেন ডরোথীর বাবা- মা। এবারও সে ডাকে রাজি হননি তিনি, তবে সেটি খুব সম্ভবত আগের নেয়া সিদ্ধান্তটির অনুশোচনায়। যা হোক, আর্থিক ভাবে খুবই খারাপ সময় পার করছিলেন ডরোথী। ঘর ও জীবন চালানোর জন্য তার বাবা শেষ পর্যন্ত একটি ছোট্ট আঙুরের ক্ষেত কিনে দিয়েছিলেন মেয়েকে। সবমিলিয়ে ডরোথীর জীবন এমন হয়ে উঠেছিলো, যা ছিলো তার কল্পনারও বাইরে। পরে আর কখনো বিয়েও করেননি তিনি।
১৯৫০ এর দশকে ভারত থেকে লন্ডনে গিয়ে ভাইঝি শীলা ব্যানার্জীও অনুসরণ করেন ফুফু ডরোথীরই পথ। ফ্রান্সের দক্ষিণে ফুফুর কাছে বেশ কয়েকবার বেড়াতেও যান তিনি। নিজের ফুফুকে তিনি দেখেন একজন অত্যন্ত সুরুচিপূর্ণ, আত্মবিশ্বাসী এবং মুক্তমনা মানুষের জায়গায়। শীলার কাছ থেকে জানা যায়- কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডরোথী ছিলেন অনেক বেশি ফরাসি। একদম সুস্পষ্ট উচ্চারণেই ফরাসি ভাষায় কথা বলতেন তিনি। এমনকি প্রতি বেলার খাবারের সঙ্গে ওয়াইন পান করারও অভ্যাস ছিলো ডরোথীর, যা কিনা একজন ভারতীয় হিসেবে শীলার কাছে একটু অদ্ভুত মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওয়েলসের বন্ধুদের সঙ্গেও ডরোথীর যোগাযোগ বজায় ছিলো জীবনের শেষ সময় অবধি। আশির দশকের কথা, বৃদ্ধ বয়সের তীর্থ যাত্রা হিসেবে অ্যাবেরিস্টুইথে অবস্থিত নিজের সে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেও ভোলেননি তিনি।
আরও পড়ুন: বলতে এলাম ভালোবাসি : পলাশ মাহবুব : পর্ব-৪
বর্তমানে এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইউনিভার্সিটি অফ এসেক্স) গবেষক ডঃ বেথ জেনকিন্সের লেখা ইউনিভার্সিটি ডিকশনারি অফ ওয়েলস বায়োগ্রাফিতে- নিজের কর্মগুণের বিচারে একটি বিশেষ জায়গা লাভ করেছেন ডরোথী; তালিকায় জায়গা পাওয়া মোট ৫ হাজার ব্যক্তিদের মাঝে তিনিই একমাত্র ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এখানে লেখক যুক্তি দেখান- সত্যিকার অর্থেই ডরোথী ব্যানার্জী ওয়েলসের জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। এমনকি ভোলার নয় তার অ্যাবেরিস্টুইথে থাকাকালীন সময়কার অবদানের কথাও।
ডরোথী বেঁচে ছিলেন প্রায় ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত। কিন্তু ছোট্ট বয়সে চলে যাওয়ার পর আর কখনোই পা রাখেননি ভারতে, যদিও তার কাছে একই সমান গুরুত্ব রাখতো ভারতে থাকাকালীন সময়টুকুও; এ বিষয়টি বোঝা যায় বড়দিন সহ অন্যান্য ছুটির দিনগুলোয় ডরোথীর সাজসজ্জার ধরন দেখলেই। ফরাসি প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঠিকই আনন্দ করে ছুটি উপভোগ করতেন তিনি, তবে সে সময় তার পরনে থাকতো ভারতীয় রীতিতে মেয়েদের স্বীকৃত পোশাক শাড়ি।
সবশেষে না বললেই নয়- অনেক বিষয়েই তুলনামূলক ভাবে ডরোথী ছিলেন হয়তো একটু বেশিই ফরাসি, সম্ভবত আরেকটু বেশি ইংরেজ, হতে পারে তার চেয়েও অনেক বেশি ওয়েলস; পারতপক্ষে এ সবকিছু-কে ছাপিয়ে তিনি ছিলেন ভারতীয়। মুদ্রার অপর পিঠে প্রতিটি সময় প্রতিটি জায়গায় আবার একইসঙ্গে একজন বহিরাগত বা বিদেশিও, সবসময়ই যা কিনা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে ডরোথী ও তার পরিবারের পরিচয়।