অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-৭]

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

প্রকাশিত: ১১:৫৪ এএম, ৬ জানুয়ারি ২০২১ বুধবার   আপডেট: ০৩:১৪ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২১ রোববার

১৯৮৪, মূল- জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

১৯৮৪, মূল- জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

[পর্ব-এক] [পর্ব-দুই] [পর্ব-তিন] [পর্ব- চার] [পর্ব- পাঁচ] [পর্ব-ছয়]

পর্ব-৭

‘স্মিথ!’ টেলিস্ক্রিন থেকে কর্কশ চিৎকার ভেসে এলো। ‘৬০৭৯। স্মিথ ডব্লিউ.! হ্যাঁ, তুমি, নিচে ঝোঁকো! তুমি এর চেয়ে ভালো পারো। তুমি চেষ্টা করছো না। আরও নিচে, প্লিজ! এবার ভালো হচ্ছে, কমরেড। এবার সবাই আরামে দাঁড়াও, আর আমাকে দ্যাখো।’
  
হঠাৎ উইনস্টনের সারা শরীর দিয়ে গরম ঘাম ছুটলো। চেহারাটি সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য হয়েই থাকলো কিছুটাক্ষণ। হতাশার অভিব্যক্তি নেই। নেই ক্ষোভেরও প্রকাশ। চোখের পলকে অভিব্যক্তি পাল্টে গেলো। সোজা দাঁড়িয়ে ব্যায়াম শিক্ষিকার মাথার ওপর তুলে ধরা বাহুদুটিতে নজর তার। আহ! সুন্দর!, হাতের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এমনটা হয়তো কেউই বলবে না, তবে একটা স্বাস্থ্যসম্মতা ও দক্ষতার প্রকাশ রয়েছে- নীচু হলেন ব্যায়াম শিক্ষিকা এবং বৃদ্ধাঙ্গুলী দুটির নিচের প্রথম ভাঁজ পর্যন্ত মাটিতে ছুঁয়ে দিলেন।
 
‘ওয়ান-টু-থ্রি, কমরেডস! আমি চাই ঠিক এভাবেই করে দেখাও তোমরা সবাই। আমাকেই দেখো। আমার এখন ঊনচল্লিশ। চার সন্তানের মা।’ এরপর আবারও নিচু হলেন ব্যায়াম শিক্ষিকা। ‘তোমরা দেখতে পাচ্ছো আমার হাঁটু একটুও ভাঁজ হয়নি।’ ‘তোমরা সবাই চাইলেই এটা করতে পারো,’ আবার সোজা হতে হতে বললেন তিনি।

‘পঁয়তাল্লিশের নীচে যে কেউ সহজেই নীচু হয়ে তাদের পা ছুঁয়ে দিতে পারবে। আমাদের সবার যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে লড়াই করার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা অন্তত আমাদের নিজেদের ফিট রাখতে পারি। মনে রেখো আমাদের ছেলেরা মালাবার যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ছে! নাবিকেরা রয়েছে ভাসমান দূর্গে! একবার চিন্তা করো ওদের কত ঝুঁকিই না নিতে হচ্ছে। এখন আবার চেষ্টা করো কমরেডরা, এবার অনেক ভালো হচ্ছে,’ বলছিলেন ব্যায়াম শিক্ষিকা। আর ঠিক তখনই উইনস্টন প্রাণপন চেষ্টায় তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল ছুঁয়ে দিলো। গত ক’বছরে এই প্রথম সে কাজটি করতে পারলো।

অধ্যায় চার

টেলিস্ক্রিনটা পাশেই, কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই উইনস্টনের। গজরাতে গজরাতে স্পিকরাইট যন্ত্রটি টেনে নিলো, ফুঁ দিয়ে মাউথপিসের ধুলো সরালো, চশমা পরলো। এভাবেই শুরু হলো দিনের কাজ। ডেস্কের ডান দিকে রাখা নিউমেটিক টিউব থেকে চারটি কাগজের সিলিন্ডার বের করে একটা একটা করে প্যাঁচ খুলে খুলে ক্লিপে লটকালো।
 
খুপড়ির দেয়ালে তিনটি প্রকোষ্ঠ। স্পিকরাইট যন্ত্রের ডানে একটিতে ছোট নিউমেটিক টিউব। যার ভেতরে লিখিত বার্তাগুলো আসে। বাঁয়ের খোপটি অপেক্ষাকৃত বড়, সংবাদপত্রের জন্য বরাদ্দ। আর পাশ দেয়ালে, উইনস্টনের হাতের নাগালের মধ্যে অপর প্রকোষ্ঠের আয়তকার মুখ ইস্পাতের গরাদ দিয়ে শক্ত করে আটকানো। এটি মূলত একটি গহ্বর। অকেজো, নষ্ট কাগজের গন্তব্যস্থল। গোটা ভবনে এমন হাজার হাজার অথবা লাখ, লাখ গহ্বর রয়েছে। কেবল যে কামরা গুলোতে তাই নয়, বারান্দায়ও একটু পরপরই এমন গহ্ববরের মুখ দেখা যায়। কি কারণেই যেনো এগুলোর নাম হয়ে গেছে ‘স্মৃতি গহ্বর’। যে যখনই জানবে কোনও একটি নথি ধ্বংস করতে হবে, অথবা যখনই কোনও একটি কাগজের টুকরো পড়ে থাকতে দেখবে তখন স্বয়ংক্রিয় কাজটিই হবে সেটি তুলে নেওয়া আর কাছের স্মৃতি গহ্বরে ফেলে দেওয়া। সেখানে ওটি গিয়ে পড়বে প্রবাহমান তপ্ত বাতাসে, যা উড়িয়ে নিয়ে ফেলবে মস্ত এক হাপরের ভেতর। এই মস্ত ভবনের কোনও এক গোপন স্থানে হা করে আছে সেই হাপর। যে চারটি কাগজ উইনস্টন খুললো সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো সে। প্রতিটিতেই এক কিংবা দুই লাইনের একটি করে বার্তা লেখা, সংক্ষেপিত সাংকেতিক ভাষায়। এগুলো নিউস্পিকের ভাষা নয়, তবে নিউস্পিকের শব্দের ব্যবহার রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ কাজে এই ভাষার ব্যবহার চলে। যেমন লেখা আছে: 
টাইমস ১৭.০৩.৮৪ বিবি স্পিচ ম্যালরিপোর্টেড আফ্রিকা রেক্টিফাই
টাইমস ১৯.১২.৮৩ ফোরকাস্টস ৩ ওয়াইপি ফোর্থ কোয়ার্টার ৮৩ মিসপ্রিন্টস ভেরিফাই কারেন্ট ইস্যু।
টাইমস ১৪.২.৮৪ মিনিপ্লেন্টি ম্যালকোটেড চকোলেট রেক্টিফাই
টাইমস ৩.১২.৮৩ রিপোর্টিং বিবি ডেঅর্ডার ডাবলপ্লাসানগুড রেফস আনপারসনস রিরাইট ফুলওয়াইজ আপসাব অ্যান্টেফিলিং।

ভালোলাগার একটা হালকা আবেশে চতুর্থ বার্তাটি পাশে সরিয়ে রাখলো উইনস্টন। শেষের এই বার্তাটি জটিল এবং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। বাকিগুলো নিয়মমাফিক, গতানুগতিক কিছু বিষয়। তবে দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে কতগুলো পরিসংখ্যানের তালিকা নিয়ে ফালতু খাটুনি আছে।

টেলিস্ক্রিনে পেছনের নম্বরগুলো ঘুরিয়ে ‘দ্য টাইমস’ এর পুরোনো পত্রিকাগুলো বের করে নিলো উইনস্টন। মিনিক কয়েক সময়, এর মধ্যে কাজ না সেরে ফেললে ওগুলো দ্রুতই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিউমেটিক টিউবে ঢুকে পড়বে। যে বার্তাগুলো এখন তার কাছে আছে এগুলোর ভিত্তিতে সংবাদপত্রটির পুরোনো সংখ্যার সংশ্লিষ্ট খবর বা নিবন্ধে পরিবর্তন আনতে হবে। ওরা বলে শুদ্ধিকরণ। যেমন ধরুন, টাইমসের ১৭ মার্চের সংখ্যায় ছাপা হয়েছে, বিগ ব্রাদার তার আগের দিনের বক্তব্যে ধারনা ব্যক্ত করেছিলেন, দক্ষিণ ভারত যুদ্ধক্ষেত্র শান্ত থাকবে আর ইউরেশীয়রা হামলা চালাবে উত্তর আফ্রিকায়। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটলো তা হচ্ছে ইউরেশীয় হায়ার কমান্ড দক্ষিণ ভারতে হামলা চালালো আর উত্তর আফ্রিকায় কিছুই ঘটলো না। এতে টাইমসের রিপোর্টের ওই অনুচ্ছেদে সংশোধনী প্রয়োজন হয়ে পড়লো। এমনভাবে সংশোধন হলো যেনো বিগ ব্রাদার যা ভেবেছিলেন ঠিক তেমনটিই ঘটেছে যুদ্ধক্ষেত্রে। অথবা ধরুন ১৯ ডিসেম্বরের টাইমস সংখ্যায় প্রকাশিত ১৯৮৩ সালের শেষ তিন মাসের ভোক্তা সামগ্রীর শ্রেণিবিণ্যাস করে পূর্বাভাস প্রতিবেদনের ওপর তৈরি রিপোর্টের কথা। এটি ছিলো একই সাথে নবম ত্রি-বার্ষিক পরিকল্পনার ষষ্ঠ কোয়ার্টারও। আজকের সংখ্যায় রয়েছে ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশের খবর, তাতে দেখা যাচ্ছে পূর্বাভাসে যা কিছু বলা হয়েছিলো তার অনেককিছুতেই বড় বড় ভুল হয়ে গেছে। এখন উইনস্টনের কাজ হচ্ছে আনকোরা রিপোর্টের তালিকা আর পরিসংখ্যান ধরে পুরোনো রিপোর্টের ভুলগুলো শুধরে দেওয়া। তৃতীয় বার্তাটিতে ছোট্ট একটি ভুল যা শুধরে দেওয়া মিনিট কয়েকের কাজ। মাত্র গত ফেব্রুয়ারিতে প্রাচুর্য মন্ত্রণালয় থেকে একটা অঙ্গীকারনামা প্রকাশিত হয় (দাপ্তরিক ভাষায় নিঃশর্ত অঙ্গীকারনামা) যাতে বলা হয় ১৯৮৪ সালে চকোলেট রেশনিং কমানো হবে না। উইনস্টন নিশ্চিত করেই জানে এ সপ্তাহের শেষদিকে চকোলেট রেশনিং কমিয়ে ত্রিশ গ্রাম থেকে বিশ গ্রাম করার ঘোষণা আসছে। তাকে কেবল একটি কাজই করতে হবে তা হচ্ছে, ওই অঙ্গীকারনামার পরিবর্তে একটি সতর্কবানী লিখতে হবে এই ভাষায় যে, এপ্রিলের কোন এক সময় রেশন কমিয়ে দেওয়া প্রয়োজন হতে পারে।

একেকটি বার্তা নিয়ে উইনস্টন যখন কাজ করে তখন সে স্পিকরিটেন সংশোধনীগুলো দ্য টাইমসের মূল কপির সঙ্গে গেঁথে দ্রুত নিউমেটিক টিউবে ঢুকিয়ে দেয়। কাজটি শেষ হতে না হতেই চরম অবচেতনার মাঝেও বার্তার মূল কপিটিসহ সে নিজে যদি কোনো নোট নিয়ে থাকে সেগুলো সব দলামোচা করে দ্রুত স্মৃতি গহ্বরে ফেলে দেয় আগুন-বাষ্পের খাদ্য হিসেবে।
 
যে অদৃশ্য কুঠুরির ভেতর এই নিউমেটিক টিউব চলে যাচ্ছে সেখানে ঠিক কি হয় তা পুঙ্খানুপুঙ্খু জানেনা উইনস্টন। তবে এ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারনা সে রাখে। দ্য টাইমসের  কোনও একটি সংখ্যায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়ে গেলে সাথে সাথেই তা সংগ্রহ করে নেওয়া হয়। এরপর দ্রুত ওই বিশেষ সংখ্যাটি পুনঃমুদ্রণ করে ফেলা হয় আর মূল সংখ্যার সকল কপি ধ্বংস করা হয়। আর্কাইভের ফাইলে পুরোনো কপির বদলে স্থান করে নেয় নতুন কপি।
 
বদলে ফেলার এই চর্চার প্রয়োগ যে কেবলই সংবাদপত্রের সংখ্যায়, তা নয়, পুস্তক, সাময়িকী, প্রচারপত্র, প্যাম্ফেলেট, পোস্টার, লিফলেট, চলচ্চিত্র, শব্দবার্তা, কার্টুন, ছবি থেকে শুরু করে যে কোনো সাহিত্যকর্ম বা প্রামাণ্য দলিল পর্যন্ত যা কিছু রাজনৈতিক বা আদর্শিকভাবে গুরুত্ববহন করে তার সব কিছুই এর অন্তর্ভূক্ত। এভাবেই দিনের পর দিন বলা যায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, মিনিটের পর মিনিটেই অতীতকে করে তোলা হচ্ছে পাকাপোক্তভাবে নির্ভুল। এভাবেই পার্টির প্রতিটি অনুমান দালিলিক প্রমাণসহ হয়ে উঠছে ভ্রান্তিহীন। তা হোক কোনও সংবাদ, অথবা কোনও মতের প্রকাশ, সময়ের প্রয়োজনের সঙ্গে যার মিল নেই তার নথিটি থাকারও অবকাশ নেই। সকল ইতিহাসই আদতে একটি পাণ্ডুলিপি যা ঘষে পরিষ্কার করা হয়েছে, নয়তো ঠিক যখনই প্রয়োজন হয়েছে লিখে ফেলা হয়েছে নতুন করে। কাজ যখন শেষ তখন তার মধ্যে কোনও ভ্রান্তি ছিলো এমনটা প্রমাণের এতটুকু সুযোগ রাখা হয়নি। রেকর্ডস বিভাগের সবচেয়ে বড় অংশটি উইনস্টন যে অংশে কাজ করে তার চেয়ে অনেক অনেক গুন বড়। সেখানে কেবল তাদেরই গতায়ত যারা এই ভুল ধরার কাজে আর বাতিল করা হয়েছে এবং ধ্বংস করা হবে এমন বই, খবরের কাগজ এবং অন্যান্য নথি সংগ্রহের কাজে ন্যস্ত। দ্য টাইমসের যে সব সংখ্যায় রাজনীতির নতুন মেরুকরণ কিংবা বিগ ব্রাদারের ভুল ভবিষ্যবচনে বারবার পুনর্লেখন হয়েছে সেগুলো তার পুরোনো তারিখ নিয়েই নথিভুক্ত হয়ে আছে। এই কপির বাইরে ওই সংখ্যার আর একটি কপিরও অস্তিত্ব রাখা হয়নি, যা এই অসামঞ্জস্যতার প্রমাণ হিসেবে খাড়া হতে পারে। বইগুলোও বার বার জব্দ করা হয়েছে, নতুন করে লেখা হয়েছে এবং অকপটে তা ফের বাজারে ছাড়া হয়েছে। একটিবারের জন্যও কোথাও স্বীকার করে নেওয়া হয়নি, বলা হয়নি যে এতে কিছু পরিবর্তন আনা হলো। এমনকি লিখিত যেসব নির্দেশনা উইনস্টনের হাতে আসে,  কাজ শেষ হওয়া মাত্র যেগুলোর অস্তিত্ব সে নিজেই বিলীন করে দেয়, তাতেও কোনও দিন বলা হয়নি যে ওটি ছিলো নিজেদের ভুল, বরং বলা হয়েছে যা লেখা হয়েছে তা ভুল, মুদ্রণপ্রমাদ কিংবা ভ্রান্ত উদ্ধৃতি যা শুদ্ধতার খাতিরেই নতুন করে লেখা প্রয়োজন।

বস্তুতঃ প্রাচুর্য মন্ত্রণালয়ের নথিতে যখন পরিসংখ্যানগুলো পাল্টে দিচ্ছিলো তখন উইনস্টনের কাছেও বিষয়টি প্রতারণা বলে মনে হচ্ছিলো না। একটি ফালতু জিনিষ দিয়ে আরেকটি ফালতু জিনিষের প্রতিস্থাপন ছাড়া এটি আর কিছুই নয়। যা কিছুই হচ্ছে তার অধিকাংশেরই সঙ্গে বাস্তব জগতের কোনো কিছুর সম্পর্ক নেই। সবকিছুই যেন কেবলই মিথ্যা, কেবলই জালিয়াতি। পরিসংখ্যানগুলো তার মূল সংখ্যায় যেমন তামাশা, শুদ্ধিকরণের পরও একই তামাশা। চাইলেই এগুলো মাথা থেকে সরানো যাবে না। যেমন ধরুন প্রাচুর্য মন্ত্রণালয় তার পূর্ব ধারনা দিলো সিকি বছরে ১৪৫ মিলিয়ন জোড়া জুতো তৈরি হবে। কিন্তু বাস্তবে তা গিয়ে দাঁড়ালো ৬২ মিলিয়ন জোড়ায়। এখন উইনস্টন পূর্ব ধারনার সংশোধনীতে লিখে দিলো ৫৭ মিলিয়ন জোড়া। যাতে দাবি করা যায়, কোটা যা ছিলো তার চেয়ে বেশিই তৈরি হয়েছে। যাই বলুন না কেন, ৬২ মিলিয়নের হিসাবটি না ১৪৫ মিলিয়ন হিসাবের ধারে কাছের, না ৫৭ মিলিয়নের। আর এটা ভাবলেও অবাস্তব ভাবা হবে না যে, আদৌ কোনও জুতোই প্রস্তুত হয়নি। তবে অতীব বাস্তব কথা এই যে, কেউ কখনোই জানবে না, সত্যিকারে কতগুলো জুতো প্রস্তুত হয়েছে, আর কেউ তা জানতে চাইবেও না। সবাই কেবল এটাই জানবে অতি বৃহৎ সংখ্যায় জুতো প্রস্তুত হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত চিত্র হতে পারে ওসেনিয়ার অর্ধেক লোকই নগ্নপায়ে পথ চলছে। নথিভুক্ত সকল তথ্যেরই একই দশা, হোক সে ছোট কিংবা বড়। সবকিছুই মিলিয়ে যাচ্ছে এক ছায়া-পৃথিবীর দিকে, আর তাতে শেষাবধি বছরের তারিখটা পর্যন্ত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
 
হলের চারিদিকে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিলো উইনস্টন। উল্টোদিকের একই আকৃতির আরেকটি খুপড়িতে ছোট সুক্ষ্ম চেহারার কালো থুতনিওলায়া লোকটি, নাম টিলোটসন, অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। হাঁটুর ওপর ভাঁজ করা একটি সংবাদপত্র আর মুখটা স্পিকরাইটের মাউথপিসের সঙ্গে লাগোয়া। টেলিস্ক্রিনের সঙ্গে তার গোপন কথা চলছে এমন একটা আবহ তৈরি করে নিয়েছে চারিদিকে। এরই মাঝে চশমার ভেতর দিয়ে উইনস্টনের দিক একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানলো সে।

টিলোটসনকে ভালো করে চেনে না উইনস্টন। সে কি কাজ করে তাও তার জানা নেই। রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টের লোকেরা তাদের কাজ নিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। লম্বা জানালাবিহীন হলে, দুই সারিতে ছোট ছোট কামরা থেকে অবিরাম কাগজের খসখসানি আর স্পিকরাইটে টানা কথা বলার ঝিমধরা গুনগুনানি ভেসে আসে। এই হলের ভেতর ডজন খানেক লোকতো হবেই যাদের এমনকি নাম অব্দি জানা নেই উইনস্টনের। তবে প্রায় প্রতিদিনই বারান্দা ধরে তাদের হন্তদন্ত ছোটাছুটি দেখে, আর দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচিতে তাদের দেখা মেলে চিৎকার চেচামেচিতে সামিল। পাশের কামরার ধুসরকেশীর কথা সে জানে, দিনের পর দিন মেয়েটি হাপিস করে দেওয়া হয়েছে এমন মানুষদের নাম-ঠিকুজি খুঁজে বের করে চিরতরে মুছে দেওয়ার কাজেই ন্যস্ত। কাজটি তার মতো আর কে-ই পারবে! কারণ বছর কয়েক আগে তার স্বামীকেই তো এমনভাবে বাষ্পায়িত করে দেওয়া হয়েছিলো। কয়েকটা খুপড়ির পরের খুপড়িতে শান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত, স্বাপ্নিক চেহারার মানুষটির কথাও বলা যায়। নাম অ্যাম্পলফোর্থ। কান ভর্তি চুল, বিষ্ময়কর গানের গলা। আর কাজটি হচ্ছে যে কোনও কিছুর বিকৃত রূপ দেওয়া। কবিতার পংক্তিমালা যদি আদর্শবিরোধী হয়, আর তা যদি কোনও কারণে সংকলনে রেখেই দিতে হয় তাহলে সেগুলো বিকৃতরুপ পায় অ্যাম্পলফোর্থের হাতে। এই হলে, জনা পঞ্চাশেক, বা তার কমবেশি লোক কাজ করে যা মূলত বিশাল জটিলতা ভরা রেকর্ডস বিভাগের একটি উপ-বিভাগ মাত্র। পেছনে, উপরে, নীচে আরও ঝাঁকে-ঝাঁকে কর্মী কল্পনাতীত লাখো কাজে ন্যস্ত। রয়েছে বিপুল সংখ্যক মুদ্রণ-দোকান, তাদের সহ-সম্পাদকের দল, দক্ষ মুদ্রাক্ষরিক, আর ভুয়া ছবি তোলার জন্য যন্ত্রপাতি সজ্জিত বিশাল স্টুডিও। এখানে একটি টেলি-প্রোগাম বিভাগ রয়েছে। তাতে রয়েছেন প্রকৌশলী, প্রযোজক আর অভিনেতা-অভিনেত্রীর দল, যাদের বাছাই করা হয় কণ্ঠ নকল করার দক্ষতার মাপকাঠিতে। রয়েছে একদল অভিসম্বদ্ধ করনিক যাদের কাজ হচ্ছে স্রেফ যেসব বই আর সাময়িকি পাল্টে দিতে হবে সেগুলো তালিকা বানানো। বড় বড় গুদামঘর রয়েছে যাতে মজুদ হয় সংশোধিত নথিপত্র, আর রয়েছে লুক্কায়িত চুল্লি যাতে মূল কপিগুলো পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। এবং কোথাও বা অন্যখানে রয়েছে একেবারেই অজ্ঞাতনামা মস্তিষ্কধারীরা, যারা পুরো কাজটির সমন্বয় করছেন, আর নীতি রেখা তৈরি করে দিচ্ছেন যার ভিত্তিতে অতীতের কিছু কিছু বিষয় সংরক্ষিত হচ্ছে, কিছু করা হচ্ছে মিথ্যায়নে সিদ্ধ আর অন্যসব কিছুর অস্তিত্বই ঘষে ঘষে বিলীন করে দেওয়া হচ্ছে।

পরের পর্ব পড়ুন এখানে