অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

পথ থেকে পাওয়া

পুষ্প বেঁচে আছেন অন্যদের সময়ে!

মো. নাঈম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ০৪:৪৪ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার   আপডেট: ০৪:৫৯ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার

শীত নামছে বেশ জাঁকিয়ে। কানে হেডফোন গুঁজে তরুণদের অনেকেই শুনছে ‘ডিসেম্বরের শহর’। আমি হেঁটে চলছি চট্টগ্রাম শহরের বুক চিরে ধাবমান ট্রেন জংশন ষোলশহরে। নতুন বছর শুরু হওয়ার দিন তিনেক বাকি। গ্রাম থেকে শহরে এসেছি একটা জরুরি কাজে। সময়ের আধা ঘন্টা আগে পৌছে যাওয়ায়, বিরক্তি দূর করতে অপেক্ষা করছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বেনামি টিএসসি’ খ্যাত ষোলশহর রেল স্টেশনের ফুট ওভারব্রিজের ওপরে। 

ব্রিজের এক কোনায় চোখ আটকে গেলো। দেখতে অগোছালো অপ্রকৃতিস্থ এক লোক। অন্ধকারে বসে আছেন। মাথা নুইয়ে কী একটা বই পড়ছে। কাছে গেলাম। সন্তর্পনে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন, যেন শামুক ঢুকে গেলো খোলশে। উঁকি দিয়ে দেখি, কিছু লিখছেন। কৌতুহল না চেপে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম- 
- ভাইয়া কি করছেন? 
- পড়ছি। 
- কী বই এটা?  

বইয়ের মলাটটা দেখালেন! তাতে বিষ্মিত হলাম। হুমায়ুন আজাদের "আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে"। কৌতুহল বাড়লো। বইয়ের পৃষ্ঠাগুলি জুড়ে আকি-বুকির ছড়াছড়ি। 

দেরি না করে পড়ার চেষ্টার করলাম অগোছালো লেখাগুলি। বিভিন্ন পৃষ্ঠায় হাতে লেখা নিচের লাইনগুলো বোধগম্য হলো-

“করো বৃষ্টি পাতায় বৃষ্টি কাকে বলে। বৃষ্টি পড়ুক"। 
"জীবনে কে যেন কিছু সাতার সাতার পুকুরে কাটে"। 
"ভেবেছো আজ চুপ করে বসে থাকার সময়"। 
"এই ভালো তখন লেবুটাকে ঘিরে ঘিরে নষ্টত্বরে দাও"। 
" নেই ভালো সামান্য ভালো শিলা,পুরোনো দাত খুবই পুরনো"। 

কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। লেখাগুলো পুরোপুরি বোধগম্য না হলেও  পথের পাশের এমন একজন মানুষের কাছ থেকে এমন কিছু প্রত্যাশা করি নি। 

দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, কেনো এই মানুষটি এখানে? হঠাৎ ভাবনা ভাঙ্গে। কাঁপা গলায় তিনি বললেন,

- “এক কাপ চা খাওয়াবেন?” 
- "হ্যাঁ নিশ্চই,চলুন"। 

তাকে নিয়ে গেলাম পাশের এক দোকানে । চায়ের সাথে কিছু নাস্তারও অর্ডার করতেই খাওয়া শুরু করলেন। দেখে বুঝলাম, কয়েকদিন ধরে না খেয়েই আছেন। বললেন- 

-" সবগুলো খাই?” 
-"হ্যাঁ নিশ্চয়ই, সবগুলোই খান।" 

জিজ্ঞেস করলাম, -"পৃথিবীটা অনেক কঠিন তাই না?" 
জবাবটা ছিল এরকম,- "পৃথিবীতে রঙ্গিন প্রজাপতি দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না।" 

নির্বাক আমি তাকিয়ে রইলাম অপরিচিত গণশহরে অপরিচিত যুবকের দিকে। বিশ্বাস করতে পারছিলাম নিজের কানকে। মনে হচ্ছিলো, কেউ এখনই ভাঙ্গিয়ে দেবে আমার ঘুম, সব স্বপ্নে দেখছি আমি। 

অযত্নে-অবহেলায় দাঁত তার শ্রী হারিয়েছে অনেক আগেই। এমন এক লোক যত যাই বলুক, তবে, এমন তো কোনো সাধারণ মানুষের কথা হতে পারেনা।

নাম জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, নাম তার,"পুষ্প"। 

বিস্ময়ের যেন শেষই হচ্ছিলো না আমার সেদিন। বইটা এগিয়ে দিতে দিতে আমাকে বললেন,"বইটা তুমি রাখো"। খাওয়া শেষ হতেই "আমি যাই" বলে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিলেন মুহুর্তেই। 

বিল পরিশোধ করতে গিয়ে দোকানির কাছে শুনলাম তিনিও নাকি কোন এক সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। এতোদিনে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার কথা। বলার অপেক্ষাই রাখে না বড় ধরনের কোন ট্রাজেডির শিকার এই পুষ্প। তার ট্রাজেডির গল্প জানার জন্য পরে অনেক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম সেই ব্রিজটার ওপর। দেখা আর পাই নি। 

জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহারটা যেই পুষ্পের কাছ থেকে পেলাম, জীবন নামক প্রজাপতি টা কেন সেই পুষ্পের পরাগ গায়ে মাখালো না তা আজানাই রয়ে গেল।

অপেক্ষা বেশিরভাগ সময় বিরক্তিকর হলেও, সবসময় নয়। অনেক সময় দিয়ে যায় পুষ্পের মতো কিছু অভিজ্ঞতাও। যা হয়তো পাওয়া যাবে না কোনো সিনেমায়, কোনো বইয়ের পাতায়। পুষ্পরা লুকিয়ে থাকে আমাদের মাঝেই।

শীত নামছে বেশ জাঁকিয়ে। ষোলশহর ছেড়ে আমি ধীরে ধীরে অপরিচিত গণশহরে পা বাড়িয়ে দিলাম...। হঠাৎ তার দেওয়া বইটির কথা মনে হলো। আর মনে হলো পুষ্প বেঁচে আছেন, তবে তার সময়ে নয়, অন্যদের সময়ে। 

লেখক: মো. নাঈম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। মোজো স্টোরিটেলার এবং ফ্রিল্যান্স রাইটার।