টমেটোর খোসা থেকে মানুষের চামড়া
শেখ আনোয়ার
প্রকাশিত: ০৪:১১ পিএম, ৪ জানুয়ারি ২০২১ সোমবার আপডেট: ০৪:৩০ পিএম, ৪ জানুয়ারি ২০২১ সোমবার
আগুন! এসিড। শুনলেই গা-টা যেন শিউরে ওঠে। দুর্ঘটনায় ভয়াবহ আগুনে ঝলসে মাঝে মাঝে অনেকেই মারা যায়। এছাড়া হতাশায়, ক্ষোভে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করে অনেকে। আর দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া এসিডেও অনেককে পুড়তে হয়।
বেশি পুড়ে গেলে তো মৃত্যু অনিবার্য। কিন্তু ততোটা না পুড়লেও যদি শরীরের চামড়া ঝলসে যায় তবে তো মৃত্যুরই শামিল। কারণ ঝলসানো চামড়ার সৌন্দর্য ফেরাতে যে কৃত্রিম চামড়া দরকার তা বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। তাই তারা অনেকটাই অসহায়। এখন বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে ‘কৃত্রিম চামড়া’ নিয়ে।
সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ার এডভান্সড টিস্যু সায়েন্সেস (এটিএস) এর বিজ্ঞানীরা একটি সুখবর দিয়েছেন। সংস্থার প্রেসিডেন্ট গেইল নটন জানিয়েছেন, আর মাত্র বছর খানেকের মধ্যেই শুরু হবে মানুষের চামড়ার বাণিজ্যিক উৎপাদন। গবেষণা চালাতে গিয়ে হার্ভার্ড মেডিক্যাল কলেজের বিজ্ঞানী ড. যোশেফ ভ্যান্টি ও তাঁর সহযোগীরা প্রথমেই তৈরি করে ফেলেন একটি কৃত্রিম বা সিন্থেটিক পলিমার। মজার ব্যাপার হলো, এই কৃত্রিম পলিমারের মূল জিনিস পলি ল্যাটিক এসিড বা পিএলএ এবং পলি গ্লাইকলস এসিড বা পিজিএ। এই বস্তুটি আবার সংগৃহীত হয় বাড়িতে তরকারির ঝুড়ির মধ্যে থাকে যে টমেটো তারই খোসা থেকে। পিএলএ এবং পিজিএ কে আবার বিশুদ্ধ করা হয় এমন এক গবেষণাগারে যেখানে আবহাওয়া ২৫০ গুণ ধুলিকণা এবং জলীয় বাষ্পমুক্ত। গবেষণার দ্বিতীয় ধাপে বিশুদ্ধ পিএলএ ও পিজিএ মিশিয়ে বিজ্ঞানীরা তৈরি করেন স্পঞ্জের মতো বায়োডিগ্রেডেবল বা প্রকৃতিতে সহজেই মিশে যায় এমন এক পলিমার। এর আবার শতকরা ৯৭ ভাগই বিশুদ্ধ বাতাসে ভরা। বলা যায়, এটি এর বাহক। এর মধ্যেই তৈরি হয় দেহের কোষগুলো। তৃতীয় ধাপে বিজ্ঞানীরা খুঁজলেন এমন এক কোষ যা সহজেই বিভাজিত হয়। আর এই বিভাজিত কোষগুলো সহজেই জখম মানুষের পোড়া শরীরের চামড়ার বদলে প্রতিস্থাপিত করা যাবে।
বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের শরীরের ত্বকে থাকে নানা ধরনের কোষ। এতে থাকে এমএইচসি-ক্লাস-টু নামের একটি এন্টিজেন। বিজ্ঞানীরা খুুঁজে বের করলেন, শরীরের চামড়া ডারমিস স্তরের ফাইব্রোব্লাস্ট কোষে এই এন্টিজেনের পরিমাণ সবচেয়ে কম। একই পথে গবেষণা চালাতে গিয়ে ড. ভ্যান্টি ও ড. ল্যাঙ্গার একগুচ্ছ ফাইব্রোব্লাস্ট কোষ কৃত্রিম পলিমারের মধ্যে বিভাজিত করতে সক্ষম হয়েছেন। কোষটি কৃত্রিম পলিমারে রেখে কৃত্রিম পরিলমারটিকে রাখেন কার্বোহাইড্রেট, এমাইনো এসিড ও ভিটামিনের নির্দিষ্ট দ্রবণে। কম্পিউটারের মাধ্যমে দ্রবণটির মাত্রা এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, যাতে চার সপ্তাহের মধ্যে দ্রবণের নির্দিষ্ট মাত্রার কোন পরিবর্তন না হয়।
শুধু কি তাই?
দ্রবণটিতে জীবিত কোষ থাকে বলে তার বর্জ্য পদার্থ যেমন ইউরিয়া এসব দ্রবণে যাতে না থাকে তাও দেখাশোনা করে থাকে কম্পিউটার। এছাড়া দ্রবণটি যে প্রকোষ্ঠ বা চেম্বারে থাকে সেখানে অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রিত হয় অন্য আর একটি কম্পিউটারের মাধ্যমে। কৃত্রিম পলিমারের মধ্যে ডারমিস কোষগুলো তৈরি হয়ে যাবার পর বাহকটি একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড দ্রবণে দ্রবীভূত করে ফেলা হয়। এভাবেই তৈরি হয়ে যায় মানুষের দেহ ত্বকের একটি মাত্র স্তর। আর এই ডারমিস স্তরটিকে সুনিয়ন্ত্রিভাবে দেহে বসানো গেলে দেহের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় অন্য স্তরগুলোও পর পর তৈরি হয়ে যায়। শুধুমাত্র শরীরের কৃত্রিম ত্বক তৈরি করেই বিজ্ঞানীরা ক্ষান্ত হননি। তৈরি করেছেন এক ত্রিমাত্রিক কৃত্রিম পেশী। সেই সঙ্গে চেষ্টা চলছে কৃত্রিমভাবে নতুন অঙ্গ তৈরির। তাই আগামী দিনে আগুনে ঝলসে, বিকৃত চেহারা নিয়ে আর কষ্ট করতে হবে না একথা বলাই যায়।
শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।