অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

পথ থেকে পাওয়া

রুবেল মিয়ার চোখে শরম, পেটে ক্ষিদা

কাইসার রহমানী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ০৬:৩৪ পিএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার   আপডেট: ০৪:৪৬ পিএম, ৩০ ডিসেম্বর ২০২০ বুধবার

গরম পানির কেটলি থেকে চিনামাটির কাপগুলোতে পানি ঢালছেন চা দোকানি মনু মিয়া। কাপ উপচে আবার পানিগুলো টিনের ট্রে বেয়ে নীচের বালতিতে জমা হচ্ছে। মনুমিয়া এবার গরম পানিতে চা পাতা মিশিয়ে, চা চামচ দিয়ে টুংটাং শব্দ করে ঘুটতে লাগলেন। চিনামাটির কাপ আর স্টিলের চা চামচের সংঘর্ষে মিষ্টি একটা মূর্ছণা তৈরি হয়- টুংটাং-টুংটাং-টাংটাং। 

চা দোকানি মনু মিয়ার কাঁচা হাতের সৃষ্টি সুর, দোকানে যারা ছিলেন তারা বেশ আগ্রহ নিয়েই শুনছিলেন। এতে ব্যাঘাত ঘটে দোকানের পেছনের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক খদ্দেরের কথাতে। হাসতে হাসতে সেই খদ্দের বললেন, মনু মিয়ার দুই হাত আছে তাও বাজনা বাজায়তে পারেনা, আমার মতো একহাত না থাকলে, সেতো চাও বানাইতে পারতো না। বোঝা গেলো এই লোক পুরনো খদ্দের মনু মিয়ার। গোঁফওয়ালা মনু মিয়া খদ্দেরের কথাটা খুব সিরিয়াসলি নিলেন। গোঁফে হাত দিয়ে উত্তর দিলেন, ঠিকই কইসোস। 

বোতাম খোলা হাফ হাতা শার্টের বুকপকেট থেকে ডান হাতে চায়ের দাম বের করে দিলেন পেছনের দাঁড়িয়ে থাকা সেই খদ্দের। তারপর দোকানের সামনে থাকা রিকশার হ্যান্ডেল ডান হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে, বাম পা প্যাডেলে চাপ দিয়ে উঠে পড়লেন সিটে। বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। লক্ষ্য করলাম, থেমে থেমে সকালের হিমেল হাওয়ার কারণে রিকশাওয়ালার হাফ শার্টের বাম হাতের অংশ বাতাসে দুলছে। দেখে মনে হলো, গ্রামের উঁচু গাছটিতে যেন সুতা কাটা অর্ধেক ছেঁড়া ঘুড়ি আটকে আছে। 

রিকশা যাচ্ছে মগবাজারের দিকে। আমারও গন্তব্য মগবাজার। তার রিকশাতেই উঠলাম। বোঝা যাচ্ছে, তিনি বেশ পাকা রিকশাচালক। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বুকে রিক্শা চালান। একহাতেই ধরছেন ব্রেক, সেই হাতেই টুংটাং করে বেল বাজাচ্ছেন। তার যে একটা হাত নেই, তার প্রভাব তার রিকশার গতিতে পড়ছেনা। কথায় কথায় জানতে পারলাম, তার নাম মো. রুবেল মিয়া। বয়স ৬৫। ৩০ বছর ধরে রিকশা চালান ঢাকা শহরে। 

যানজটে পড়েছে রিকশা। চা-সিগারেটের মতো রাস্তাই এখন ফেরি করে মাস্ক বিক্রি হচ্ছে। রুবেল মিয়া একটা মাস্কও কিনলেন পাঁচ টাকা দিয়ে। পুরনো মাস্কটা ডানহাত দিয়ে খুলে, বুক পকেটে রাখলেন। মুখে নিলেন নতুন মাস্ক। যানজটের কারণে কিছুটা বিরক্ত তিনি, বোঝা গেলো তার কথায়।
আমার থাকার কথা বন-বাদাড়ে। আর আমি পাষাণ শহরে রিকশা চালাই। 
জিজ্ঞেস করলাম আপনার গ্রাম ভাল লাগে? 
রুবেল মিয়া জানালেন, তার দেশের বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জের বেতবাড়িতে। ছোটবেলায় খুব ডানপিটে ছিলেন। আয় উপর্জনের জন্য ছোটবেলা থেকেই গাছের লাকড়ি সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন। ৭৫ সালে একটা গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। বাম হাত হারাতে হয় সেই দুর্ঘটনায়।

সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে। রিকশা ছুটে চলছে মগবাজারের দিকে। একহাতেই রিকশা নিয়ন্ত্রণ করছেন রুবেল মিয়া। তার একহাতই যেন দুইহাতের কাজ করছে। 

রুবেল মিয়া জানালেন, ৭৫ সালে তার বয়স ছিল ১৪ বছর। ১১ বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। বাবার যক্ষা হয়েছিল। চিকিৎসা করানোর জন্য বসত ভিটা বিক্রি করতে হয়েছিল। বাবা মারা যাবার পর শূণ্য হাতে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। টঙ্গির এক বস্তিতে সেই সময় থাকতেন। হাত না থাকায় কেউ তাকে কোনো কাজ দিতে চাইতোনা। পরে তিনি আত্মবিশ্বাস নিয়ে রিকশা চালাতে শুরু করেন। সেই যে শুরু ৩০ বছর ধরে এক হাতে তিনি এখনো রিকশাই বয়ে যাচ্ছেন ঢাকার বুকে।  

কথায় কথায় রিকশা পৌঁছে গেলো মগবাজারে। রিকশা থেকে নেমে তাকে অল্প কিছু টাকা বাড়িয়ে ভাড়া দিলাম। বাড়তি টাকা রুবেল মিয়া ফিরিয়ে দিলেন। বললেন, কিছু মনে করবেন না, মানুষের দয়া নিলেতো ভিক্ষাই করতে পারতাম। এক হাত নাই, এটা দেখিয়েই ঢাকা শহরে প্রচুর ভিক্ষা পেতাম। কিন্তু আমি কারো দয়া চা্নই। সম্মান নিয়ে নিজের পরিশ্রমে বাঁচতে চাই। 

রাস্তায় দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ কথা বললাম তার সঙ্গে। রুবেল মিয়া জানালেন, তার এক ছেলে আর দুই মেয়ে। মেয়ে দুটো পালক মেয়ে। সন্তান না হবার কারণে মেয়েদের নিয়েছিলেন তিনি। পরে তার সন্তান হয়। ছোট ছেলে টঙ্গিতে একটি স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। আর পালক মেয়ে দুটোর বিয়ে দিয়েছেন তিনি। তারা ভাল আছে। একজনের স্বামী সিএনজি চালায় আর আরেকজনের স্বামী পেট্রল পাম্পে চাকরি করে। পালক মেয়েরা তার খোঁজ খবর নেই কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা ভাল আছে, এটাই তার ভাল লাগা। আল্লাহ ছাড়া আরো কারো কাছে কিছু আশা করেন না তিনি। 
 
কথা বার্তায় বোঝা গেলো রুবেল মিয়া গল্প করতে খুব পছন্দ করেন। মজা করে কথা বলেন। পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল ঠিক করলেন। বললেন, আমাকে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা খুব পছন্দ করে। তার কিছু বাঁধা রিকশা যাত্রী ছিল। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে নিয়ে যেতেন তিনি, আবার বাসায় নিয়ে আসতেন। টিউশানিতেও নিয়ে যেতেন। অভিভাবকরা এজন্য তাকে ভাল টাকা দিতেন। কিন্তু করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় আয় একেবারে কমে গেছে। এখন সারাদিন রিকশা চালিয়ে ৫০০-৬০০ টাকার মতো আয় হয়। 

খেয়াল করলাম কথা বলতে বললে রুবেল মিয়া চোখ মুছছেন। শার্টের কোনা দিয়ে ডান চোখ কচলিয়ে তিনি বললেন, বয়স হয়েছে তাই এখন চোখে খুব কম দেখেন তিনি। ছোট ছোট অক্ষর দেখতে পাননা ।

মোবাইলে দেখলাম, অফিসের সময় হয়ে গেছে । চলে যেতে হবে। তার শেষ কথা ধরে শেষ  প্রশ্ন করলাম। বাম হাত নেই, চোখে কম দেখেন, রিকশা চালাতে কষ্ট হয়না?
রুবেল মিয়া জিভ দিয়ে ঠোঁট মুছে বললেন, কি করবো মামা! চোখে শরম আর পেটে ক্ষিদা।