অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

দুদককে শক্তিশালী করতে সংস্কার কমিশনের ৪৭ সুপারিশ

অপরাজেয় বাংলা ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৯:৫৪ পিএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ বুধবার  

ব্যক্তিগত স্বার্থে সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ লেনদেনকে অবৈধ ঘোষণা এবং আইনে কালো টাকা সাদা করার বৈধতা স্থায়ীভাবে বন্ধ করাসহ ৪৭ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বুধবার (১৫ জানুয়ারি) জমা দেওয়া প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করেছে এ কমিশন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলছে। এর অংশ হিসেবে দুই ধাপে মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গঠন করা হয় নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও সংবিধান সংস্কারে কমিশন।

চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এ কমিশনগুলোর প্রতিবেদন দেওয়ার কথা ছিল। তবে কাজ শেষ না হওয়ায় ৩ জানুয়ারি প্রতিবেদন দেওয়ার সময় বাড়ানো হয়। এর মধ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের জন্য ৩১ জানুয়ারি ও বাকি পাঁচটি কমিশনকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছিল। এর মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন দিতে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় চেয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা কমিশনগুলোর প্রতিবেদন দেওয়ার কথা আছে আগামী মাসের শেষের দিকে।

দুদককে শক্তিশালী, কার্যকর ও ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে কমিশনারদের পদ বাড়ানো, নিয়োগ, সার্চ কমিটি, আইনের সংস্কার, বেতন বৃদ্ধি ও প্রণোদনার জন্য সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন।

ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে এ সংস্কার কমিশন গত ৩ অক্টোবর তার কার্যক্রম শুরু করে। সংস্কার কমিশন বলছে, দেশে জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কোনো কৌশল নেই। দুর্নীতি দমন শুধু দুদকের একার কাজ নয়, এখানে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে। যেমন সংসদ, আইন ও বিচার বিভাগ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিভিন্ন কমিশন, ব্যবসা খাত ও রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের দুর্নীতিবিরোধী ভূমিকা থাকতে হবে। যে জাতীয় কৌশল প্রণয়নের কথা বলা হচ্ছে, তাতে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নির্ধারণ করা থাকবে; যার মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে, সেটি নিয়মিতভাবে নজরদারি করতে হবে।

সুনির্দিষ্ট কিছু আইন না থাকায় অর্থ পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে মনে করে সংস্কার কমিশন। কমিশন বলছে, যে ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন, তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থ ও বন্ধুত্বের বলয় থেকে সিদ্ধান্ত নেন। এটা বন্ধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরাসন আইন দরকার।

রাজনীতি ও নির্বাচনসংক্রান্ত অর্থায়নে স্বচ্ছতার জন্য কিছু সুপারিশ করেছে কমিশন। তারা বলেছে, রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী আয়-ব্যয় নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে। হলফনামার তথ্য প্রকাশ করতে হবে। যদি হলফনামায় পর্যাপ্ত তথ্য না থাকে, তথ্য গোপন করা হয় ও বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ থাকে, তবে তার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় থেকে জাতীয়—সব পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে তাদের পরিবারের সবার সম্পদের বিবরণী নির্বাচন কমিশনে জমা দেবেন। সেটি নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করবে। এটি প্রতিবছর হালনাগাদ করতে হবে, যত দিন তারা জনপ্রতিনিধি থাকবেন।

দুর্নীতি দমনে সব সেবামূলক খাত স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেশনের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। কমিশন বলছে, বেসরকারি খাতে ঘুষ লেনদেন এখন পর্যন্ত অবৈধ নয়। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের আওতায় সরকারি খাতের মতো বেসরকারি খাতেও ঘুষ লেনদেন অবৈধ, কিন্তু সেটা এখনো কার্যকর হয়নি।

দুদককে শক্তিশালী করতে কয়েকটি আইন সংস্কারের কথা বলেছে কমিশন। দুর্নীতির তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন এর একটি। যে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করেন, তার সুরক্ষায় আইন করতে হবে। একটা তথ্য প্রকাশ সুরক্ষা আইন রয়েছে, তবে সেটির কোনো প্রয়োগ ও কার্যকর প্রচার নেই। এ আইন যথেষ্ট নয়। তাই আইনটি সংশোধন করে কার্যকর ও প্রচার করার সুপারিশ করা হয়েছে।

দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দেশ-বিদেশে থাকা ব্যাংক হিসাবের লেনদেন ‘কমন রিপোর্টি প্র্যাকটিস’–এর আওতায় আনার কথা বলেছে কমিশন। এর মাধ্যমে বিএফআইইউসহ (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব লেনদেনের তথ্য জানতে পারবে। এটি বার্ষিক প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করতে হবে। ১২২টি দেশ ইতিমধ্যে ওই প্র্যাকটিসের অধীন এসেছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানও এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, বাংলাদেশ এখনো হয়নি।

দুদকে নিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা বিবেচনায় যে ধরনের পেশাগত বৈচিত্র্য থাকা দরকার, সেটি নিশ্চিত করতে একজন নারীসহ পাঁচজন দুদক কমিশনার নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের মেয়াদ হবে চার বছর।

সংস্কার কমিশন মনে করে শুধু কমিশনের সংখ্যা বাড়ালে হবে না। নিয়োগেও বৈচিত্র্য থাকতে হবে। যেসব পেশা দুদকের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা যুক্ত সেখান থেকে দুদকের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিতে হবে। দুদকে শুধু আমলাদের নিয়োগে যে প্রধান্য দেওয়া হয়, তা থেকে সরে আসতে হবে।

সংস্কার কমিশন চায় দুদক স্বাধীন ও কার্যকর হোক। তবে দুদকের কোনো স্বাধীনতা সীমাহীন নয়। দুদক যে কাজ করবে, তার জবাবদিহি থাকবে। ভালো কাজের যেমন প্রশংসা থাকবে, তেমন কাজ করতে না পারলে জবাবদিহি করতে হবে।

দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে যে সার্চ কমিটি রয়েছে, সেটিকে সার্চ ও পর্যবেক্ষণ কমিটি করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সার্চ কমিটির দুটি দায়িত্বের সুপারিশ করা হয়েছে। এর একটি, নিয়োগে যাচাই-বাছাই করা। অন্যটি, কমিশন কী কাজ করছে, সেটি পর্যবেক্ষণ করে ছয় মাস পরপর প্রতিবেদন দেওয়া।

রাজনৈতিক বিবেচনায় দুদকে নিয়োগ বন্ধে সাত সদস্যের বাছাই কমিটি করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, পরে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তি যিনি রয়েছেন, তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাছাই কমিটির প্রধান করার কথা বলা হয়েছে। এরপর সদস্য হবেন হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, হিসাব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ), সংসদ নেতার মনোনীত একজন, প্রধান বিরোধীদল থেকে মনোনীত একজন। এ ছাড়া একজন সরাসরি প্রধান বিচারপতি থেকে নিযুক্ত হবেন, যার দুর্নীতিবিরোধী কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

দুদককে আমলাতন্ত্র মুক্ত করতে সচিব, মহাপরিচালক ও পরিচালক—পদগুলোতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যারা দুদকের কাজের জন্য নিজেদের যোগ্য মনে করবেন, তারা এসব পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এ ছাড়া নিজস্ব প্রসিকিউশন বিভাগ ও প্রশিক্ষণ একাডেমি করা, ৫৪–এর ৩ ধারা বাতিল এবং বেতন দ্বিগুণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।

সুপারিশ করা হয়েছে দুদকে শৃঙ্খলা অনুবিভাগ রাখার। এটির দায়িত্ব হবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বরখাস্ত করা। কেউ যাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে না পড়েন, সে জন্য কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে নজরদারি অব্যাহত রাখার সুপারিশও করেছে কমিশন।

এসব বিষয়ে ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সুপারিশের ভিত্তিতে একটি কার্যকর দুদক গড়ে তুলতে রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে, না হলে দুদক কার্যকর হবে না।