চীনের গুয়াংদং প্রদেশের রুইউয়ান ইয়াও স্বায়ত্তশাসিত কাউন্টি ভ্রমণ
মো: এনামুল হক
প্রকাশিত: ১২:২৭ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ শুক্রবার আপডেট: ১২:৩৬ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ শুক্রবার
পাহাড়, নদী আর বিস্তৃর্ণ সবুজ প্রকৃতি আমাকে সবসময়ই টানে। শহর থেকে দূরে কোনো পাহাড় বা নতুন এলাকায় ঘুরতে যাওয়া, নতুন মানুষ, ভিন্ন সংস্কৃতি, নতুন পরিবেশের সাথে পরিচিত হওয়া আমার কাছে বেশ আনন্দের।
কিছু দিন আগে চীনের গুয়াংদং ইউনিভার্সটি অব ফরেন স্টাডিজের একটি প্রতিনিধিদল গ্রামীন উন্নয়নের কার্যকলাপ পরির্দশনের জন্য রুইউয়ান ইয়াও স্বায়ত্তশাসিত কাউন্টিতে যান। এই দলের একজন সদস্য হিসেবে আমারও সেখানে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো।
আমাদের লক্ষ্য ছিলো সেখানে ইয়াওজাতির লোকজনের জীবনযাপন, তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা, পর্যটন এবং কৃষিকাজের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা।
আমরা যেদিন রুইউয়ানে যাত্রা শুরু করি সেদিন মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছিল, অর্থাত্ রোদ-বৃষ্টির মধ্য দিয়েই আমাদেরকে যেতে হয়েছিলো। আমাদের গাড়ি যখন গুয়াংঝৌ শহর পার হলো তখন থেকেই মূলত শুরু হলো প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন। রাস্তার দুই পাশে ঢেউ খেলানো ছোট বড় অসংখ্য পাহাড়। দেখে মনে হলো রাস্তাগুলো তৈরি করা হয়েছে মূলত পাহাড় কেটে। যেখানে পাহাড় কাটা সম্ভব হয়নি সেখান রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের নিচ দিয়ে সুরঙ্গের ভিতর দিয়ে।
রুইউয়ান ইয়াও স্বায়ত্তশাসিত কাউন্টি হল চীনের গুয়াংদং প্রদেশের শাওগুয়ান সিটির প্রশাসনের অধীনে একটি কাউন্টি। এই কাউন্টির গুইতো টাউনের একটি গ্রাম হলো ইয়াংপি। আমরা প্রথমে এই ইয়াংপি গ্রামটি পরিদর্শন করি।
গুয়াংদং ইউনিভার্সটি অব ফরেন স্টাডিজ, গুয়াংদং প্রদেশের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অফিসের সাথে যৌথভাবে প্রদেশের বিভিন্ন গ্রাম উন্নয়নে সহযোগিতা করছে। তাদের সহযোগিতায় দরিদ্র গ্রামবাসীরা দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হচ্ছে।
ইয়াংপি গ্রাম মূলত পাহাড়, নদী আর সবুজ প্রকৃতির একটি গ্রাম। নদীর পরিষ্কার পানি আর বয়ে যাওয়ার শব্দ মনকে ব্যাকুল করে তোলে। সেই সাথে দারিদ্রবিমোচনে গ্রামবাসীদের নেওয়া নানা পদক্ষেপ নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
একটি গ্রামকে কিভাবে পর্যটন এবং কৃষিকাজের মাধ্যমে উন্নয়ন করা যায় তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলো ইয়াংপি গ্রাম।
উন্নয়নের জন্য ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ। চীনের রাস্তাঘাট দেখলে বোঝা যায় এই দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা কতটা উন্নত এবং আধুনিক।
ইয়াংপি গ্রামে দারিদ্রবিমোচনে বিভিন্ন কোম্পানির সহযোগিতায় অনেক রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়েছে, তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন পর্যটনকেন্দ্র। এসব পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে দেশ-বিদেশের অসংখ্য লোক প্রতিদিন ঘুরতে আসেন। মূলত পর্যটকদের আগমন গ্রামবাসীদের আর্থিক অবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন বয়ে এনেছে। কারণ পর্যটকরা এসব জায়গা থেকে স্থানীয় অনেক জিনিস ক্রয় করেন, নানা ধরনের সুস্বাদু খাবার খান, হোটেলে রাত্রি যাপন করেন, এছাড়া, স্থানীয় অনেক লোক গাইড হিসেবেও কাজ করেন। এভাবে স্থানীয় লোকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এবং তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠে।
এছাড়া, গ্রামের বয়স্ক নারী ও পুরুষদের হাতের কাজ করতে এবং কর্মসংস্থানের জন্য কিছু ছোট কারখানা যেমন এমব্রয়ডারি করতে উত্সাহিত করা হয়।
এছাড়া, সাউথ চায়না এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি শাকসবজি থেকে শুরু করে ধান চাষের জন্য গ্রামটির কৃষিজমি ব্যবহার করে।
সাউথ চায়না এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা ছোট জাতের টমেটো চাষের জন্য এখানকার কৃষি জমি ব্যবহার করেছিল এবং এখন তারা ৯০ একর জমিতে নতুন জাতের ধান চাষ করার চেষ্টা করছে। এসব উদ্যোগ গ্রামের দারিদ্রবিমোচনে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
এছাড়া, গ্রামের প্রতিটির বাড়ির আঙিনায় নানা ধরনের শাকসবজি চাষ করা হয়, এসব শাকসবজি নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি তারা বিক্রিও করে থাকেন। তাছাড়া, প্রতিটি বাড়িতে প্রচুর ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। এসব ফল বিক্রি করেও তারা অনেক টাকা আয় করতে পারেন।
ইয়াংপি গ্রাম পরিদর্শন শেষে পরেরদিন আমরা রুইউয়ান ইয়াও স্বায়ত্তশাসিত কাউন্টিতে ইয়াও জাতির গ্রাম পরিদর্শন করি।
আসলে বর্তমানে চীনে মোট ৫৬টি জাতি আছে। ইয়াও জাতি চীনের একটি প্রাচীন সংখ্যালঘু জাতি । দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরানো ঐতিহ্যের এ জাতির লোকজন দক্ষিণ চীনের কুয়াংসি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, হুনান, গুয়াংদং, ইউননান, কুইচৌ ও চিয়াংসি- এই প্রদেশগুলোতে বাস করে।
ইয়াও জাতির অধিকাংশ মানুষের বাস সাবট্রপিকাল রেইনফরেস্ট অঞ্চলে। একসময় ইয়াও জাতির মানুষ পাহাড়ে বাস করতো। চীনে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণনীতি চালু হবার পর, ইয়াও জাতির মানুষ পাহাড় থেকে নেমে ইটের ভবনে বাস করতে শুরু করে।
আচার ব্যবহার এবং পোষাক পরিচ্ছদের ব্যবধানের কারণে ইয়াও জাতিকে হোং ইয়াও, পাই খু ইয়াও ও ফাং ইয়াওসহ কয়েকটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত করা যায় ।
ইয়াও জাতির মানুষ ভালো শিকারী ছিল। যখন কৃষিকাজ থাকতো না, তখন তারা দলে দলে শিকারে বের হতো। রুইউয়ান ইয়াও স্বায়ত্তশাসিত কাউন্টিতে বসবাসকারী ইয়াও জাতির মানুষও এমন শিকারে বের হতো।
ইয়াও জাতির অনেক ঐতিহাসিক উৎসব রয়েছে। তাদের সবচেয়ে বড় উত্সব হল 'ভান ওয়াং উৎসব'। এ উৎসবে তারা জাতির প্রথম পূর্বপুরুষ, ভান ওয়াং নামের একজন মানুষ-দেবতার পূজা করে থাকে। গান গাওয়া ইয়াও জাতির মানুষের অভ্যাস। তারা যে-কোনো বিষয় নিয়ে গান গাইতে পারে। তাছাড়া, ইয়াও জাতির মুখে মুখে প্রচারিত লোকসাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ।
রুইউয়ানে ইয়াওজাতির গ্রাম আমাকে মুগ্ধ করেছে। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে তৈরি করা রাস্তা-ঘাট এক কথায় অসাধারণ। আমরা সবাই পাহাড় বেয়ে গ্রামটির উপরে উঠে যাই। সেখান থেকে পুরো গ্রামের দৃশ্য উপভোগ করি। পাহাড়ের উপর থেকে পুরো গ্রামটিকে ছবির মতো সুন্দর মনে হয়।
মো: এনামুল হক: প্রভাষক, গুয়াংদং ইউনিভার্সিটি অফ ফরেন স্টাডিজ, গুয়াংঝৌ, চীন।