মিডিয়ার শক্তি বা আসক্তি: ম্যাজিক বুলেটের বাকের ভাই ও বদি
রাজীব নন্দী, শিক্ষক ও গবেষক
প্রকাশিত: ০৯:৫৮ এএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ রোববার আপডেট: ১০:৪৭ এএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ রোববার
মিডিয়ার ফ্যান্টাসি কখনো কখনো বাস্তবের চেয়েও বড় বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বাস্তব জীবনের চাইতে আরো বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারে পর্দার রূপালী জীবন; তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যেন অভিনেতা আবদুল কাদের অভিনীত ‘কোথাও নেই নাটক’র ‘বদি’ চরিত্র। যে বদি চরিত্রের ওপর খেপে উঠেছিলো দেশের মানুষ। কারণ, হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা ‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিক নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি ঠেকাতে রাস্তায় নেমেছিলেন সাধারণ মানুষ। রমনা থানায় নিরাপত্তা চাইতে হয়েছিল নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ এবং এর প্রযোজককেও। এদিকে নাটকে বাকের ভাইয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যে সাক্ষী দিয়ে বাস্তব জীবনেও হেনস্তা হতে হয়েছিলো ‘বদি’কে।
বাংলাদেশের মিডিয়া ও/বা পপুলার কালচার রিসার্চে ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটি একটি মোক্ষম উদাহারণ। গণমাধ্যম অধ্যয়নের "Magic Bullet" থিওরি বা Hypodermic Needle থিওরির এমন বাস্তব উদাহরণ আর কোথায় আছে? ম্যাজিক বুলেট তত্ত্বটিতে বলা হয়, গণমাধ্যমের বার্তায় এমন কিছু মেশানো থাকে যে, তা দর্শক/ভোক্তাদের মনে ম্যাজিক বুলেটের মতো কাজ করে। মিডিয়ায় যা পরিবেশিত হবে, মানুষ উন্মাদের মতো সেভাবেই পরিচালিত হবে। ষাটের দশকের আগেও গণমাধ্যম বিশ্লেষণের অন্যতম তত্ত্ব ছিলো এই ম্যাজিক বুলেট তত্ত্ব। যেখানে বলা হয়, ‘মিডিয়ার এমন একটি ক্ষমতা রয়েছে যা সমাজে ম্যাজিক বুলেটের মতো কাজ করে। মিডিয়া যা বলবে, সমাজ, সমাজের মানুষ সেভাবেই কাজ করবে’। এই তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে- ‘The media (magic gun) fired the message directly into audience head without their own knowledge. The message cause the instant reaction from the audience mind without any hesitation is called “Magic Bullet Theory”. The media (needle) injects the message into audience mind and it cause changes in audience behavior and psyche towards the message.” (Communication Theory, Magic Bullet or Hypodermic Needle Theory of Communication in Mass Communication, Psychology, Behavioral and Social Science, link: https://bit.ly/2yvcB5r)।
‘ম্যাজিক’ ও ‘বুলেট’ এই দু’টি শব্দ নিজ ক্ষমতা ও কার্যকারিতায় শক্তিশালী। মাত্র দু’টি শব্দেই খেল খতম। ম্যাজিক বুলেট তত্ত্বের যারা আবিষ্কারক, তারা মিডিয়ার ক্ষমতাকে সুতীব্রভাবে দেখেছেন, তাই এই দু’টি শক্তিশালী শব্দকে একসঙ্গে ব্যবহার করছেন। তারা বলেছেন, ‘মিডিয়া’ নামের ‘বন্দুক’ থেকে যখন গুলি বের হয়, তখন তা সরাসরি (জাদুর মতো) দর্শক, পাঠক, শ্রোতা, ভোক্তার `মস্তিষ্কে` আঘাত করে। যদিও গণমাধ্যম পণ্ডিতদের দাবী ত্রিশের দশকের পরই ম্যাজিক বুলেট থিওরি বাতিল হয়ে গেছে। এরপর পৃথিবীতে এসেছে ‘টু স্টেপ ফ্লো’ থিওরি। অর্থাৎ মিডিয়া যা বলবে, তা সরাসরি মানুষ বিশ্বাস করবে না, ‘ওপিনিয়ন লিডার’ হয়ে তা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করবে।
কিন্তু বাকেরের প্রতি ভালোবাসা এবং বদির প্রতি ঘৃণা আমাদের বলছে- মানুষ এত সহজে ম্যাজিক বুলেট থিওরিকে বাতিল করেনি। আমরা জানি, ১৯৬৪ সালের শীতকালে পাক প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খানের উন্নয়ন প্রচারের কাজেই এই ভূখণ্ডে প্রথম টেলিভিশনের আবির্ভাব। তবুও দেশের প্রান্তিক দর্শক-শ্রোতার মধ্যে তথ্য-বিনোদন আর শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে বিটিভির প্রতি বাড়তে থাকে নির্ভরশীলতা। নব্বই দশকে একদিন হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন হুমায়ুন আজাদকে - `স্যার আমার একটি সিরিয়াল বিটিভিতে চলছে। এটা একটু দেখে মূল্যায়ন করবেন`। হুমায়ুন আজাদ জিজ্ঞেস করলেন- `কোন বারে সিরিয়াল দেখায়`। হুমায়ুন আহমেদের উত্তর `মঙ্গলবার`। `তাইতো বলি আমার কাজের মেয়েটা কেনো মঙ্গলবারে এতো ঘন ঘন টিভিরুমে যায়` হুমায়ুন আজাদের জবাব! হ্যাঁ, দর্শক-শ্রোতার কাছে টেলিভিশনের প্রভাব সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ বলেছেন- `পুরোনো কালের মানুষ যদি দৈবাৎ একটি টেলিভিশনের সামনে এসে পড়তো, তাহলে তাকে দেবতা মনে ক’রে পুজো করতো। আজো সেই পুজো চলতো।`
বিটিভির সাথে যুক্ত আমাদের শৈশব স্মৃতি। বিটিভির রাতের আটটার সংবাদ মানেই গ্রামে আমাদের ‘রাতের ভাত খাওয়ার বিরতি’। বিটিভি মানেই- `মানিক কী বাত্তি লাগাইলা`? বিটিভি মানেই ম্যাকগাইভার, দি অ্যাডভেঞ্চারস অব সিন্দবাদ। বিটিভির চোখে আমরা স্বপ্ন রচনা করেছিলাম হারকিউলিসের। বিটিভির তেমনিই অব্যর্থ এক একটি প্রডাকশন `কোথাও কেউ নেই`, `কোন কাননের ফুল`, ‘নক্ষেত্রের দিনরাত্রি’ বা ‘আজ রবিবার’। এসব ধারাবাহিক নাটকের জন্য শৈশব কৈশোরে আমরা অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম বিটিভির সামনে। বিটিভির উপর ভরসা থাকলেও বিদ্যুৎ বিভাগের উপর ভরসা ছিল না। তাই শুক্রবারের সিনেমার সময় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার আশঙ্কায় মাথাপিছু দুই টাকা করে দিয়ে ব্যাটারি ভাড়া করে আনার ঘটনাও ছিলো আমাদের কৈশোরিক উত্তেজনা পর্বে। বিটিভি মানেই যেমন ভিনদেশি আলিফ লায়লা, রোবকপ আর মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ড। তেমনি বিটিভি মানেই বাকের ভাই, বদি ও মুনা। যে বাকেরের জন্য ঢাকায় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন হয়েছে, ঢাকার বাইরেও মিছিল বের হয়েছিলো। গলিতে পাড়াতে স্লোগান উঠেছিলো- ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কেন, জবাব চাই- জবাব চাই’, ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে…’!
নাটকের পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই তার বাসা। সেই বাসার সামনে রোজ কয়েকশো লোকজন এসে জড়ো হয়, স্লোগান দেয়, সেইসব স্লোগানের মূল ভাবার্থ হচ্ছে, নাটকের শেষ পর্বে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি দেয়া যাবে না। কথিত আছে যে, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কোথাও কেউ নাটকের প্রযোজককে ফোন করে অনুরোধ করলেন- হুমায়ূন আহমেদকে বলুন, নাটকের শেষে বাকের ভাইকে বাঁচিয়ে রাখা যায় কিনা। হুমায়ূন আহমেদ রাজি হলেন না, কারণ তিনি স্বাধীনচেতা লেখক। তিনি বিশ্বাস করতেন লেখকের স্বাধীনতায়। তিনি স্ক্রিপ্টে যা ভেবে রেখেছেন সেটাই করবেন। দেশব্যাপী জনগনের আন্দোলন কিংবা প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধকে গ্রাহ্য করলেন না তিনি। সত্যিই, একটা সময় ছিলো আমাদের, ফেলে আসা বিটিভি যুগের। যে মিডিয়ার শক্তি আর আসক্তি দুটোই আজ ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে...’!
লেখক: *রাজীব নন্দী* সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ ভারতের গণমাধ্যম গবেষকদের প্ল্যাটফর্ম ‘ইন্দো-বাংলা মিডিয়া এডুকেটর্স নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক’ এবং দুই বাংলার গণমাধ্যম, গণপিটুনি এবং জনসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন। ইমেইল: [email protected]