জুলাই ট্র্যাজেডি-জুলাই বিপ্লব
বিষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন : আমাদের সংস্কৃতি ও শিক্ষা
ড. ইসলাম শফিক
প্রকাশিত: ০৬:০০ পিএম, ৭ আগস্ট ২০২৪ বুধবার আপডেট: ০৮:৫৪ পিএম, ১২ আগস্ট ২০২৪ সোমবার
২০২৪ সালের জুলাই মাস বাংলাদেশর ইতিহাসে চিহ্নিত হবে এক ট্র্যাজেডির মাস নামে! এই মাসে শুরু হওয়া আন্দোলনে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বীরোচিত আত্মদান ও সাড়ে চার শয়ের অধিক মানুষের তাজা প্রাণ বিসর্জনের শোকে বিহ্বল সমগ্র জুলাই মাস। আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে শাসকের বন্দুকের নলের সামনে বুক পেতে দিয়েছিল! এ কেমনতর বীর, এ কেমন বিবেকী সাহস! কালে কালে মহাকালে যাঁরা বীরত্বগাথা রচনা করেছেন! আবু সাঈদের নাম উচ্চারিত হোক সেইসব মহাবীরদের নামের সাথে! এই মাস ৩১তম দিবস পার হয়েও রূপকভাবে আগাস্টকেও গ্রাস করেছে! সময় সাক্ষী হয়ে অন্যরকম এক জুলাই মাস দেখলো ইতিহাস—৩২ জুলাই, ৩৩ জুলাই, ৩৪ জুলাই, ৩৫ জুলাই ও ৩৬ জুলাই এরূপ রূপক গণনা। পৃথিবীতে অধিকার আদায় আন্দোলনের ইতিহাসে এমন মাস গণনার দৃষ্টান্ত বিরল! এই মাস ছিল রূপকার্থে অন্যান্য মাস থেকে দীর্ঘ! জুলাইয়ের রাত সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদে প্রলম্বিত গভীর বিষাদ অন্ধকারের প্রতিধ্বনি! জুলাইয়ের আলোফোটা ভোর সন্তানহারা পিতার অশ্রুভেজা পবিত্রতা, জুলাইয়ের দুপুর স্বামীহারা স্ত্রীর গগণবিদারী আর্তনাদ, জুলাইয়ের বিকেল পিতাহারা শিশুর শূণ্য মরুভূমি! জুলাইয়ের সন্ধ্যা রক্তস্নাত গোধূলী, জুলাইয়ের সুর ট্র্যাজেডির, জুলাই বীর ও করুণ রসের যুগলবন্ধন! জুলাইয়ের রঙ কখনো লাল দ্রোহের, জুলাই মাস বিপ্লবের, জুলাইয়ের রঙ কখনো কালো শোকের, জুলাইয়ের রঙ কখনো সাদা শান্তির!
৩৫ দিনের আন্দোলনে নিহত হয়েছেন প্রায় সাড়ে চার শ’য়ের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ, গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন প্রায় দুই শতাধিক, আটক হয়েছে ১৪ হাজারের বেশি! ‘জুলাই ট্র্যাজেডি’ জাতির ইতিহাসে ছাত্রদের অধিকার আদায়ের জন্য দৃষ্টান্তমূলক এক আন্দোলন-সংগ্রামের নাম! সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১ জুলাই। ‘ব্লক রেইড’, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’, ‘মার্চ ফর জাস্টিস’, ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’, শিরোনামে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ জুলাই মাস জুড়ে আন্দোলন-কর্মসূচি পালন করে। ১৬ জুলাই মঙ্গলবার, রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটে নিহত হওয়ার দৃশ্য অন-ক্যামেরায় প্রত্যক্ষ করে জাতি ও বিশ্ববাসী। নিরস্ত্র এই শিক্ষার্থীর হত্যাদৃশ্য দেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছেন বাংলার মানুষ। এদিন সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে আরও পাঁচজন নিহত হয়। আবু সাঈদ-এর নিহত হওয়ার ঘটনায় সারাদেশে ছাত্র-জনতার মাঝে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে যায়।‘জেনারেশন জেড’ আধুনিক প্রযুক্তির ও চিন্তার ধারক-বাহক! জেড জেনারেশনের ভাষা ভিন্ন, চিন্তা ভিন্ন, দর্শন বিশ্ব মহাজাগতিক। এই ভাষা বুঝার জন্য প্রয়োজন সত্যিকার আধুনিক মনন ও উদারতা! এই প্রজন্ম বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের পূর্বতন রূপরেখা ও আদল আমূল বদলে দেয়!
জুলাইয়ে শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে পর্যায়ক্রমে আন্দোলন বড় হতে থাকে। ১১ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবার, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছে। এটি অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, শিক্ষার্থীরা ‘লিমিট ক্রস’ করে যাচ্ছেন! ১৩ জুলাই সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১৪ জুলাই, রোববার প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর পরবর্তী গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে কোটা আন্দোলন প্রসঙ্গে প্রশ্ন করেন সাংবাদিক ফারজানা রূপা ও সাংবাদিক প্রভাষ আমিন। এই সংবাদ সম্মেলনে পূর্বেও প্রমাণিত হয়েছে দলবাজি, তেলবাজির নগ্ন সংস্কৃতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করেছেন— সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু, সাংবাদিক ফারজানা রূপা ও সাংবাদিক প্রভাষ আমিন-এর দেয়া অতিমাত্রার তেলে ডুবে গেলেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা।’ এই প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’র ‘তৈল’ প্রবন্ধের কথা অবশ্যই সামনে আনতে হয়—‘বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য , যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য,তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্ধারা সিদ্ধ হইতে পারে।’
সাংবাদিকগণের তৈলময় সম্মেলন সংস্কৃতির জবাবে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া কোটা, মেধা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-পুতি, রাজাকারের নাতিপুতি এসব নিয়ে বক্তব্যকে ঘিরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মাঝে তৈরি হয় ভীষণ অসন্তোষ ও ক্ষোভ। শিক্ষার্থীরা একই দিনে পদযাত্রা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি প্রদান করে। আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরিতে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন। ১৫ জুলাই ২০২৪, সোমবার কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের রাজপথে মোকাবেলা করতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদেরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন! ছাত্রছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা পরিস্থিতিকে সহিংস করে তোলে। স্লোগান স্লোগানে প্রকম্পিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সহ পুরো দেশ। প্রথম দিকে স্লোগানে তৈরিতে ভুলভ্রান্তি থাকলেও, জেনারেশন জেড তা অল্পসময় পরেই শুধরিয়ে নেয় নিজেদের। তৈরি হয় শক্তিশালী কিছু স্লোগান, রক্ত আগুনলাগা স্লোগানে যোগ দেয়, বিভিন্ন বয়সী শ্রেণিপেশার মানুষ। গর্জন তোলে রাজপথে!—
এক. “চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার৷। তুমি বুবু স্বৈরাচার তাইতো আমরা রাজাকার।”
দুই. “আমি কে? তুমি কে? রাজাকার রাজাকার॥
কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার।”
তিন. “লাখো শহিদের রক্তে কেনা, দেশটা কারোর বাপের না॥ আমি হলে রাজাকার, তুমি তবে স্বৈরাচার।”
চার. “বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।”
পাঁচ. “আপোষ না সংগ্রাম? সংগ্রাম সংগ্রাম॥ দালালী না রাজপথ? রাজপথ রাজপথ।”
ছয়. “বুকের ভেতর অনেক ঝড়,
বুক পেতেছি গুলি কর।”
সাত. “পা চাটলেই সঙ্গী, না চাটলেই জঙ্গী।”
আট. “যদি তুমি নিউট্রাল থাকো, তবে তুমি বিলাই,
যদি তুমি আওয়াজ তোলো, বৃথা যাবে না জুলাই!”
নয়. “তুমি বুবু স্বৈরাচার তাইতো আমরা রাজাকার।”
দশ. “কোটার জন্য জীবন নিলি, বাঁচার জন্য কোটা দিলি॥ তোর কোটা তুই নে, লাশের ভিতরে জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে।”
১৭ জুলাই, বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিতাড়ন করে ‘রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস’ ঘোষণা করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী। ছুটির দিনেও ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রবিক্ষোভ, সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ থাকে। রাত সাড়ে সাতটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এই ভাষণেও সরাসরি কোনো সুরাহা ছিল না! বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করেন। শিক্ষার্থীরা এই ভাষণ প্রত্যাখ্যান করে। ১৮ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ অচল হয়ে যায়।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সারাদেশে মোতায়েন করা হয় বিজিবি। ১৯ জুলাই শুক্রবার, ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে রাজধানী ঢাকায় ব্যাপক সংঘর্ষ, হামলা, ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীরা ৯ দফা দাবি দেয়। আন্দোলন থামাতে সরকার সারাদেশে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়া হয় সারাদেশের ইন্টারনেট সেবা। এতে করে তরুণ প্রজন্ম বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
২১ জুলাই, রোববার, আদালতে জরুরি শুনানীর মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করে সর্বোচ্চ আদালতের রায় ঘোষণা করে। কোটাপ্রথা সংস্কার করে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী প্রজ্ঞাপন অনুমোদন দিয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তবুও আন্দোলন প্রত্যাহার না করে অন্যান্য দাবীগুলো আদায়েরে জন্য রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। এর মধ্যে কোটা আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের নিখোঁজ হয়। ২৭ জুলাই ২০২৪, শনিবার আরও দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার হেফাজতে নেয়। সমন্বয়কদের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়। ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ তখন তোপের মুখে খাবারের আপ্যায়নের ছবি প্রকাশ করেন।
২৮ জুলাই ২০২৪ রোববার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক-- নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসু ডিবির হেফাজতে থাকা অবস্থায় এক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা জানান। এসময় ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ককে তাঁর অফিসে খাবারের টেবিলের ছবি ও ভিডিও সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন। পূর্ব থেকেই বহু বিতর্কের জন্ম দিয়ে আলোচিত 'হারুনের ভাতের হোটেল' পুনরায় আলোচনায় আসে। ২৯ জুলাই সোমবার, ৬ সমন্বয়ক ডিবি হেফাজতে শুনানীতে হাইকোর্ট মন্তব্য করেন— ‘জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না।’ দীর্ঘদিন নানা ইস্যুতে আমাদের অসহায় জাতিকে 'হারুনের ভাতের হোটেল' সংস্কৃতি সহ্য করতে হয়েছে! ৩২ জুলাই ২০২৪ (১ আগস্ট ২০২৪) বৃহস্পতিবার, আন্দোলনের তুমুল চাপে ডিবি হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৬ সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়। একই দিনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। ঘুনেধরা নিজের মেরুদণ্ড মেরামত না করে সরকার বিপদ ডেকে আনা চরম ক্রান্তিলগ্নে!
৩৪ জুলাই (৩ আগস্ট ২০২৪), শনিবার সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সমাবেত হয় শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনতা। ৩৫ জুলাই (৪ আগস্ট ২০২৪) রোববার, গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ৬৬৬ কোটি টাকা কর দাবির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট খারিজ করে দেয় হাইকোর্ট। সরকার একসঙ্গে লেজেগুবরে পরিস্থিতি তৈরি করে বুমেরাং অস্ত্রকে স্বাগত জানায়!
অন্যদিকে, সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিনে সারাদেশে ১১৪ জনের মৃত্যু হয়! তন্মধ্যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ঢুকে ১৩ পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে বিক্ষুব্ধরা! এই ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মোরাল ভেঙ্গে যায়! ৫ আগস্ট ২০২৪, সোমবার, সারাদেশে পুনরায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে তিনদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। মধ্যরাত থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট সেবা! পরদিন ৩৬ জুলাই, সোমবার (৫ আগস্ট ২০২৪) সকাল থেকে উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, রামপুরা থেকে লাখো-জনতা কারফিউ নিয়ম ভেঙ্গে পায়ে হেঁটে শাহবাগ অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। মানুষের সাহসী পদযাত্রায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের মারমুখী শক্ত অবস্থান থেকে সরে আসে। রাজধানী ঢাকা দখল নেয় ছাত্র-জনতা! সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ে সরকারের প্রশাসনিক চেইন অব কমান্ড!
গভীর সঙ্কট অত্যাসন্ন বুঝতে পেরে ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট ২০২৪) সোমবার, শেখ হাসিনা দুপুর আড়াইটায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে সামরিক একটি উড়োযানে তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে যান। বর্তমানে তিনি দিল্লীতে অবস্থান করছেন।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পরপরই পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। সরকার পতনের পরপর দুপুর পৌনে তিনটায় গণভবনের ভেতরে প্রবেশ করে বিক্ষোভকারীরা। বাধাহীনভাবে নির্বিচারে অসংখ্য উৎসুক মানুষ ঢুকে যায় গণ ভবনে, সংসদ ভবনে ও প্রধানমন্ত্রীর তেজগাঁও অফিসে। যে যা পেরেছে গণভবনে ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টকৃত ছবি ও ভিডিও রিলসে দেখা যায়— আনন্দ-হাসি ও উৎসাহ নিয়ে গণভবনের ছাগল, হাঁস-মুরগি, গরু, চেয়ার, সোফা, টেবিল ফ্যান, কম্বল, টেলিভিশন, পানির ফিল্টার, মাইক্রোওয়েভ, ওভেন, রেফ্রিজেরেটর, এয়ার কন্ডিশনের ইনডোর আউটডোর যন্ত্র, বেশিন, পানির কল, পানির ট্যাঙ্ক এমনকি টয়লেটের প্যানও খুলে নিয়ে গেছে। ভিডিওতে দেখা যায় পিতলের অক্ষরে নির্মিত ‘গণ ভবন’ লেখা সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে যাচ্ছে একজন রিক্সায় করে। নিয়ে যেতে দেখা যায়— শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ব্যবহৃত শাড়ি, ব্লাউজ, অলংকার এমনি অন্তর্বাস পর্যন্ত! নির্লজ্জ এসব ছবি ও ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল! আমি বিশ্বাস করি— এই অসুস্থ সামাজিক মূল্যবোধ ও বোধ-বিবেচনার সংস্কৃতি আমার না, আমাদের না! এসব কর্মকাণ্ড ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে তরুণ প্রজন্ম। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে তরুণ প্রজন্ম উদ্যোগ গ্রহণ করেছে গণভবনের লুটের জিনিসপত্র ফেরত দেয়ার জন্য। অনেকেই ইতোমধ্যে বেশ কিছু জিনিস ফেরত দিয়ে গেছেন।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে আগুন দেয়, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয় ও ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে অবস্থিত শেখ হাসিনার বাড়ি ‘সুধা সদন’। সারাদেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, শুরু হয় লুটপাট ও প্রতিহিংসার আগুন। ৫ আগস্ট ২০২৪, সোমবার সংঘাতে সারাদেশে নিহত হয় ১০৮ জনের অধিক। বিকেলে জাতীয় সংসদ ভবনে জনতার আনন্দ ও বিকৃত উচ্ছ্বাস করতে দেখা যায়, ব্যাপক ভাঙচুর করে ও লুটপাট করে নিয়ে যায় ভেতরের মূল্যবান সব জিনিসপত্র।
দুস্কৃতিকারীরা কেউ কেউ সংসদ ভবনের ভেতরে অধিবেশনের আসনে বসে বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করে। কাউকে কাউকে এ সময় ধূমপান করতেও দেখা যায়! তেজগাও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ভাঙচুর ও লুটপাট করে। রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে সড়কে অবস্থিত বাংলাদেশের জন্মইতিহাসের ঐতিহাসিক দলিল ৬৭৭ নম্বর বাড়ী বঙ্গবন্ধু ভবন ও জাদুঘর বিকেল পৌনে ৪টার দিকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। পুড়ে গেলো বাংলার শেকড়ের ইতিহাস! সরকারের পতন পরবর্তী গণভবনের লুটপাট, জাতীয় স্থাপনার প্রতি অসম্মান করার কর্মকাণ্ড ও অগ্নিসংযোগের ভয়াবহ অস্থিরতার সংস্কৃতি বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। বিশ্ববাসীতো বটেই নিজের কাছেই নিজেকে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগছে! মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছে আমাদের! অপরদিকে, সংসদ ভবনের নিরাপত্তাকর্মীদের কাছ থেকে লুট হওয়া ৪০টি অস্ত্র শিক্ষার্থীরা ফিরিয়ে দিয়েছেন। এমনকি লুট করে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় ৫৫ লাখ টাকা উদ্ধার করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয় শিক্ষার্থীরা। এ যেন অনেক অন্ধকারে নিমজ্জিত এক নতুর আলোর প্রজন্ম!
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারাদেশের স্থাপিত প্রায় সমস্ত ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হচ্ছে। হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে, রশি দিয়ে টেনে, এক্সকেভেটর দিয়ে টেনে নিকৃষ্টভাবে এসব কাজ করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে তৈরি ভাস্কর্যটি ভাঙচুর করা হয়েছে। ভেঙ্গে ফেলা হয় মেহেরপুর মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের সবকটি ভাস্কর্য। ভাঙ্গা থেকে বাদ যায়নি— ভাষাশহিদ, মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরশ্রেষ্ঠ, রবি ঠাকুর, শিল্পাচার্য জয়নুল ও লালনের ভাস্কর্য। হামলা ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে সংগীতশিল্পী রাহুল আনন্দের বাসায় বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহশালায়! ময়মনসিংহের শশীলজের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গ্রিকদেবী ভেনাসের স্নানরত ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। একি আমাদের বাঙালি জাতিসত্ত্বার সাংস্কৃতিক পরিচয়!
সেনাবাহিনীর প্রধান অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠনের লক্ষ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন-এর সঙ্গে শীর্ষ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, পেশাজীবী ও ছাত্র প্রতিনিধিসহ অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ে রদবদল করা হয়েছে। সারাদেশে পুলিশ স্টেশনে নেই কোনো পুলিশ। পুলিশ স্টেশনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও রাজধানী ঢাকা শহরের ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের সাময়িক দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আনসার ব্যাটেলিয়নকে। পুলিশের শীর্ষ পদে রদবদল চলছে, আইজিপি পদত্যাগ করেছেন। র্যাবে নতুন মহাপরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গতকাল ৬ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ জন সমন্বয়কের বৈঠক শেষে জানানো হয়— দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে।
চলমান সংকট উত্তরণ না করে, আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতির সময়ে পরিকল্পনাবিহীন দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে জুলাইয়ের ০৩.তারিখ থেকে শুরু হয়েছিল ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন কার্যক্রম। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ জুলাই ২০২৪, মঙ্গলবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল থেকে সকল পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের চলছে এইচএসসি পরীক্ষা আর মাধ্যমিক পর্যায়ে চলছে ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন।
আগামী ১১ আগস্টের অনুষ্ঠিতব্য এইচএসসি পরীক্ষা প্রশ্নপত্র পুড়ে গেছে তাই হচ্ছে না পরীক্ষা! মাধ্যমিক স্কুলের ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের পরীক্ষার রুটিন নেই! বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকগণের কাছে নেই কোনো নির্দেশনা। গতকাল সচিবালয় ছিল আতংকের আরেক নাম। বেশিরভাগ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা অফিসে আসেননি। মন্ত্রণালয়ে ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে পরিকল্পনা ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগ্রহণকারী কর্তাব্যক্তিরা অনুপস্থিত! তাই দিকভ্রান্ত জাহাজের মতো হয়ে আছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো!
পূর্বতন ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগপন্থী শিক্ষক কর্মকর্তা, কর্মচারী ও দলীয় শিক্ষার্থীরা আতংকিত, কেউ কেউ পলাতক। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে ক্ষমতাসীনদের পদত্যাগের হিড়িক। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রো-উপাচার্য, ট্রেজারার, অনুষদ ডিন, প্রক্টর, হল প্রভোস্ট, টিএসসি উপদেষ্টা, রেজিস্ট্রার অর্থাৎ রাজনীতি ও দলীয় বিবেচনায় নিযুক্ত শিক্ষকগণ ও কর্মকর্তাগণ ক্যাম্পাসে নেই! কট্টরবাদী ক্ষমতা চর্চাকারী দলীয় শিক্ষকগণও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরতে পারবেন বলে মনে হয় না! কারণ তাঁরা গবেষণা ও ক্লাসে পাঠদানের মধ্যদিয়ে প্রকৃষ্ট শিক্ষক না হয়ে, হয়ে উঠেছেন বিতর্কিত রাজনৈতিক ব্যক্তি! এই পরিবেশে ক্যাম্পাস খুলে অফিস সময় চালু রাখা যায় কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার পরিবেশ তৈরি আদৌ সম্ভব নয়! বাংলাদেশের জনসংখ্যা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অতিমাত্রায় উচ্চশিক্ষার পরিবর্তে প্রযুক্তি, প্রায়োগিক বিজ্ঞান ও কারিগরী শিক্ষায় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে পারে এমন বিভাগ ও সিলেবাস নিশ্চিত করতে হবে। আমরা শত শত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের মাধ্যমে বেকার সমাজ তৈরি করতে আর চাই না। চাই শিক্ষাপদ্ধতির ও ব্যবস্থাপনার নবতর সংস্কার! এমন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হোক ‘সরকারি চাকরি নামক সোনার হরিণের’ পেছনে আর যেন তরুণদের ছুটতে না হয়! পাশাপাশি সরকার পরিচালনার জন্য দুর্নীতিমুক্ত পরিসেবামূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। ‘জুলাই বিপ্লব’-এর ইতিহাস নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক গবেষণা হবে, চুলচেরা বিশ্লেষণে রচিত হবে ইতিহাসসত্য। নতুনের আহবানে জাগ্রত সমাজের প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে গঠিতব্য অন্তর্বতীকালীন সরকার আমাদের স্বপ্নের নতুন সূর্য এনে দেবেন!
ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক, গবেষক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব।