নামহীন স্টেশনে...
মালেকা পারভীন
প্রকাশিত: ০৬:২৭ পিএম, ৩০ আগস্ট ২০২০ রোববার আপডেট: ০৭:৪৪ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০২০ রোববার
মোবাইলের পর্দায় ভেসে উঠলো চারটা ডিজিট। এরপর কয়েকটা ডট চিহ্ন। গোটা নাম্বারটি দেখা গেলোনা। ঘরের আবছা আলোয় অদ্ভুত নাম্বারটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম এ সময় এখানে কে আমাকে ফোন করতে পারে। ওরা, পরিবারের বাকি সদস্যরা, বেশ কিছুক্ষণ আগে ট্রেন স্টেশনে গেছে। শেষ মুহূর্তে টিকিটের খোঁজ নিতে। আমি ভিনদেশের এক শহরে দু’কামরার এক ফ্ল্যাটে একা। একদম নিজের সাথে একাএকা।
আমরা কয়েকদিনের জন্য ইউরোপ ঘুরতে বেড়িয়েছি। এ মুহূর্তে রোম শহরে আছি। একদিনের মধ্যে এই ঐতিহাসিক শহরের যতটুকু দেখা সম্ভব, দেখেছি। বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত কলোসিয়াম অ্যাম্ফিথিয়েটারের কাছেই দুই রুমের একটা স্টুডিও ভাড়া করেছিলাম। দুই রাত একদিনের জন্য। বুকিংডটকম এ অনেক দেখেশুনে। ইতালির মেস্ত্রে আর ভেনিস শহর ঘুরে রোমের জন্য বরাদ্দকৃত মাত্র একটা দিন যখন প্রায় শেষ হতে চললো, তখন কী কারণে আমাদের নতুন করে ট্রেনের টিকিটের খোঁজ করা প্রয়োজন হলো আমার এখন আর মনে পড়ছেনা।
কোথাও বেড়াতে যাবার আগে প্লেন-বাস-ট্রেন এর টিকেট কাটা, হোটেল রিজার্ভেশন দেওয়া সংক্রান্ত সব কাজ সাধারণত আমিই করে থাকি। এবারের পুরো ভ্রমণটাও আমার পরিকল্পনায় করা। অথচ ব্যাখ্যাতীত কারণে সেদিনের সেই সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামার মুহূর্তে নিজেকে আমি আবিষ্কার করলাম দুই রুমের এই স্টুডিওবাড়ির বড় কামরার বিছানায়। কিছুটা আধ শোয়া অবস্থায় বালিশে হেলান দিয়ে। কয়েকদিনের ভ্রমণের ধকলে শরীরটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। চোখ বন্ধ করে কী ভাবছিলাম মনে নেই। তারপর আচমকা ঘরে কম্পন তুলে এই ফোনের বেজে ওঠা।
বড় রাস্তার গা ঘেঁষে অনেকগুলো দালান। রাস্তার নাম কার্লো এমানুয়েল। কার্লো এমানুয়েল নামের রাস্তার ঠিক মাঝামাঝি যে ভবনটা তার নিচের তোলার অল ফারনিশড ফ্ল্যাটটায় আমরা উঠেছি। দুই রাতের জন্য এই ঢের। এখন এই একাকী মুহূর্তে যখন আমি অবসাদে বেশ ক্লান্ত, তখনই চারপাশের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে মোবাইলটা বেজে উঠলো। কিছুক্ষণ বাজার পর, যে সময় আমি আতিপাতি করে মনে করতে চাইলাম ফোনটা কে করতে পারে, ধরতে গিয়ে শেষ মুহূর্তে লাইনটা কেটে গেলো। অদ্ভুত নাম্বারটা আমাকে আরও বেশি দ্বিধাগ্রস্ত করে ফেললো।
এই বিদেশ-বিভূঁইয়ে, যখন আমি পরিবারের সাথে বাইরে এবং যে শহরে আমার পরিচিত বেশ কজন বন্ধু/আত্মীয় থাকলেও যাদের কেউই আমার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে অবগত নয় যেহেতু আমার স্বল্পকালীন অবস্থানের তথ্য আমি তাদের জানানো দরকার মনে করিনি, কারো পক্ষেই আমার মোবাইল নাম্বারটি জানা সম্ভব নয়। নাম্বারটি কন্টিনেন্টাল ইউরোপের আরেকটি দেশের যে দেশের রাজধানী শহরে আমরা গত কয়েক বছর ধরে বাস করছি কর্মসূত্রে।
নাম্বারটি এখন রোমিং হয়ে আছে। রোমিং ফোন কল বা রিসিভ করলে দুটাতেই পয়সা কাটে বলে খুব সাবধানে থাকি। যেদিন থেকে ঘুরতে বেরিয়েছি এখন পর্যন্ত পরিচিত/অপরিচিত কারো কাছ থেকেই কোন ফোন আসেনি। টেলিফোনে কথা বলার মতো লোকের তালিকা আমার সবসময়ই নাতিদীর্ঘ। এই রোম শহরে এখন কেবল একজন রোমান নাগরিকের কাছেই আমার ফোন নাম্বারটি আছে। নামে তার ভালেন্তিনো। সে এই স্টুডিওর মালিক। তার ইমেইল অনুসারে এটি অবশ্য অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট।
ভালেন্তিনোর সাথে অবশ্য আমার চাক্ষুষ দেখা হবার সুযোগ নেই। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কিছু ইউরো তার একাউন্টে পে করে প্রি-বুকিং করেছি। বাকিটা আগামীকাল রোম ছাড়ার আগে আগে শোধ করে দিতে হবে একই প্রক্রিয়ায়। এমনটাই ব্যবস্থা। মন্দ নয়। এর আগে কোথাও কোথাও হোটেল রুমে বা স্টুডিও টাইপের বাড়িতে চেক ইন করার আগেই পুরো ভাড়া পরিশোধ করে ঢুকতে হয়েছে।
কিন্ত এটা তো ভালেন্তিনোর নাম্বারও নয়। কেমন অদ্ভুত একটা ফোন কল। অর্ধেক নাম্বার দেখাই যাচ্ছেনা। কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে শুনি দরজায় বেল বাজার শব্দ। ওরা তাহলে ফিরে এসেছে। আসার সময় স্টেশন থেকে গরম পিৎসা আনার কথা। ওটা দিয়েই রাতের ডিনার সেরে ফেলবো এই আমাদের ইচ্ছা।
যখন দরজা খুললাম, সবাই বেশ ক্লান্ত মুখে ঘরে ঢুকলো। টিকিটের ব্যবস্থা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে সবাই একসাথে মাথা একদিকে কাত করলো। তারপর একজন বাথরুমের দিকে আর দুজন দুই রুমের দিকে পা বাড়ালো। আমি হাসানের পেছন পেছন গেলাম। সে জুতা খোলার জন্য চেয়ারে বসতে বসতে যা বললো তা শুনে আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল এখন আর মনে করতে পারছিনা।
‘স্টেশনে তোমার পরিচিত একজনের সাথে দেখা হলো। মনে হয়, তোমার পুরানো প্রেমিকদের একজন।’ এতোটুকু বলে সে আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন মনে হলো আমি একজন দাগী আসামি। পুরনো প্রেমের ইতিহাস প্রকাশ হয়ে যাবার অপরাধে আমাকে যেকোন মেয়াদের শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। আপাতত সে আমাকে তার চোখের অগ্নিবানে ভস্মীভূত করতে চাইলো। আমার কাছ থেকে কোন কিছু না শুনতে পেয়ে সে আবার মুখ খুললো।
‘দেখা হলো না বলে মন খারাপ করোনা। আমরা তোমার মোবাইল নাম্বার তাকে দিয়ে এসেছি। এর মধ্যে তো তোমাকে তার ফোন করার কথা। খুব ব্যাকুল হয়ে তোমার নাম্বারটা চাইলো। আমাদেরও দেখে খারাপ লাগলো। ওদের জিগ্গেস করে দেখো। বেচারা এখনো তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে মনে হলো।’
হাসানের বলা সব কথাগুলো আমি ঠিকমতো শুনেছি কিনা বলতে পারবো না। আমাদের দুই সন্তান, যাদের বয়স পনের আর এগার, এর সামনে এমন একটি নাটক ঘটেছে, তাও আবার এই ভিনদেশে, এটা ভেবে আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করছিল না। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দুর্বোধ্য লাগছিল হাসানের কথা।
‘আমি তো তোমার কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছিনা।’ শুধু এতোটুকুই বলতে পারলাম।
ততক্ষণে বড় মেয়ে শুভ্রা আমাদের রুমের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। পেছনে ছোটটা। দুজনের হাতে দুটো বড় সাইজের পিৎসার প্যাকেট। ঘরে ঢোকার পর থেকে হাসানের অদ্ভুত কথা আর চাহনির চোটে পিৎসার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। অথচ কিছুক্ষণ আগেও গরমগরম ইতালীয় পিৎসা খাবার জন্য জিবে পানি এসে জমা হচ্ছিল আপ্সে। যাক।
‘শুভ্রা, তোমার মাকে স্টেশনে দেখা ওই অদ্ভুত লোকটার কথা বলো। সে মনে হয় আমার কথা বিশ্বাস করছে না।’ বলে হাসান চেয়ারের ওপর ঝোলানো তোয়ালেটা নিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো। আমার হতভম্ব দৃষ্টি মেয়ের ওপর পড়তে টের পেলাম, সে এতোক্ষণ ধরে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ওর চোখে অবোধগম্যতার বিস্ময়। জানিনা, তার বাবার কথার জবাবে সে আমাকে কী বলতে যাচ্ছে।
আমি শুভ্রার কাছে গিয়ে ওর হাত থেকে পিৎসার প্যাকেটটা নিয়ে পাশে টেবিলটার ওপর রাখলাম। ছোটটার, যার নাম রেখেছি পুষ্পা, হাত থেকেও প্যাকেটটা নিয়ে রেখে দিলাম। পুষ্পাকে পাশের ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতে বললাম। আব্বু বাথরুম থেকে বের হলে সবাই মিলে একসাথে পিৎসা খাবো। তারপর শুভ্রার হাত ধরে সামনে থাকা চেয়ারে বসালাম। আমি বসলাম ওর সামনে সিঙ্গেল বেডটার কিনার ঘেঁষে।
‘আমাকে খুলে বল তো স্টেশনে কী ঘটেছে। এখানে কার সাথে তোদের দেখা হয়েছে। তোর বাবা এমন অদ্ভুতভাবে কথা বলছে আর আমার দিকে তাকাচ্ছে যে আমি মনে হয় বিরাট কোন অপরাধ করে ফেলেছি। অবশ্য, আমি তার চোখে সবসময়ই অপরাধী। এটা এমন নতুন কিছু না। এখন বল, কী হয়েছে।’
আমার বড় মেয়েটা এমনিতে চুপচাপ, কথা বলে কম। নিজের মতো থাকে। জিজ্ঞাসা না করলে আগ বাড়িয়ে নিজের থেকে কখনো কিছু বলবে না বা চাইবে না। ছোটটা, পুষ্পা, শুভ্রার সম্পূর্ণ বিপরীত। স্কুলের বাইরে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যতক্ষণ বাসায় থাকে, একাই সবাইকে তটস্থ রাখে।
কিন্তু এখন শুভ্রার কথা শুনে আমার শরীরে বিদ্যুতের চমক খেলে গেলো। চট করে কিছুক্ষণ আগে আসা অদ্ভুত ফোনকলটার কথা মনে পড়লো। হাসানের অদ্ভুত ব্যবহারে ওটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ফোনকলটার কথা আবার মনে পড়তেই শিরদাঁড়ায় এক শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে গেলো। শুভ্রা জানতে চাইলো, ‘আম্মু তোমাকে কি কেউ ফোন করেছিল যখন আমরা বাইরে মানে স্টেশনে ছিলাম? একজন বাংলাদেশি লোকের সাথে আমাদের দেখা হলো। টিকেট কাউন্টারের সামনে। লোকটা দেখতে একটু কেমন যেন। চোখগুলো টকটকে লাল। গায়ে একটা ময়লা কোট। মনে হলো অসুস্থ। আব্বুর সাথে কথা বলছিল আর কিছুক্ষণ পরপর কাশছিল। আমরা ওদের সব কথা বুঝতে পারিনি। শুধু একবার শুনলাম, লোকটা বলছে, এখান থেকে ট্রেনে করে যশোর পর্যন্ত যাবে। যশোর কোথায়, আম্মু?’
শুভ্রার কথা শুনতে শুনতে আমার ভেতরে একটা পরিবর্তন টের পেলাম। ওর কথার জবাব না দিয়ে ওকে পুষ্পার কাছে গিয়ে বসতে বললাম। অনুভব করতে থাকলাম শরীর আর মন অবশ করে দিতে থাকা এক তীব্র অস্বস্তি। বাইরে রাতের অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। লম্বা পর্দা ঝোলানো জানালা দিয়ে যতটা সম্ভব রাস্তার বাতিগুলোর আলো ঘরের মধ্যে এসে পড়বার চেষ্টা করছে। ছোট্ট একটা সবুজ ডিম লাইটে প্রায় অন্ধকার হয়ে থাকা ঘরটায় রাস্তা থেকে ঠিকরে পড়া আলো কেমন এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি করেছে। সময়টা যদি আমার আর হাসানের বিয়ের পরপর দিকের হতো তাহলে হয়তো এরকম মুহূর্তে আমরা দুজন বিছানায় রোমান্টিকতায় বুঁদ হয়ে থাকতাম! কিন্তু তা নয়। আমাকে এখন রোমের রোমা তিবুরতিনা ট্রেন স্টেশন থেকে হাজার মাইল দূরের যশোর স্টেশনের দূরত্ব মাপতে হচ্ছে !
পাশের ঘরে দুই বোন টিভি খুলে বসেছে। হাসান আমাকে এভয়েড করার জন্যই কিনা কে জানে বাথরুম থেকে বের হতে দেরি করছে। হয়তো সে শাওয়ার নিচ্ছে। আমি শুভ্রার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে জানালাটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাইরে ইউরোপের এপ্রিলের এক সন্ধ্যা বা রাত। মেয়েদের স্কুলে ইস্টার হলিডে। সেই ছুটিতে অনেক প্ল্যান করে আমরা ঘুরতে বেড়িয়েছি। আর এখন আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এক দুর্বোধ্য ধাঁধা।
আমার মনের ভেতর অনেক দূরের এক অতীত এসে হামলে পড়ছে। অসংখ্য স্মৃতিরাশির সুনামি ঢেউয়ের তলায় তলিয়ে যেতে থাকলাম। এর মধ্যে টের পেলাম শুভ্রা একবার এসে দরজার কাছে দাঁড়ালো। আমাকে এভাবে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কী বুঝলো কে জানে। কিছু জিজ্ঞাসা না করে আবার পাশের ঘরে চলে গেলো।
আগামীকাল সকালে আমাদের ট্রেন। অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছিনা আমরা কোথায় যাবো। শুভ্রা শুনেছে লোকটা যশোর পর্যন্ত যাবে বলেছে। রোম থেকে যশোর ? মানে কি! আমার বাচ্চা দু’টার জন্ম দেশের বাইরে। বড় হয়েছে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে। বাংলাদেশে ঢাকা, আর দাদা বাড়ি-নানাবাড়ি টাঙ্গাইল এর নাম জানে। মেয়েটা ভেবেছে, যশোর ইউরোপেরই কোন একটা ছোট শহর।
এর আগে আমরা যখন লম্বা ট্রেন জার্নিতে ঘুরতে বেড়িয়েছি, দ্য হেগ থেকে বার্লিন অথবা স্ট্রাসবুর্গ থেকে জেনেভা অথবা প্যারিস থেকে সুইস ইনটারলাকেন, ট্রেনগুলো যখন অপরিচিত কোন স্টেশনে দাঁড়াতো কিছু সময়ের জন্য, হয়তো একজন বা তিনজন যাত্রী উঠবে বা নামবে, আমি আমার নোটবয়ে ওই স্টেশনটার নাম টুকে নিতাম। পরে আমার কাছ থেকে বড় মেয়েটা এই অভ্যাস রপ্ত করেছে।
‘আম্মু, স্টেশনের নাম লিখে রাখো কেন?’
‘পরে কোন এক সময় যদি সুযোগ হয়, এখানটায় বেড়াতে আসতে চাই সে জন্য। এই স্টেশন থেকে বের হলেই ছোট্ট একটা ছবির মত শহর আছে অন্য পাশে। পরিস্কার ঝকঝকে রাস্তায় সামারের রোদ আছড়ে পড়ছে, অদ্ভুত সুন্দর নামের কোন কফিশপের টেরাসে বসে লোকজন গা এলিয়ে কফি খাচ্ছে এসব দৃশ্য কল্পনা করতে আমার ভালো লাগে।’
মেয়ে আমার কথা শুনে মিষ্টি করে হাসে। বড় মেয়েটা আমার চেয়েও ভাবুক।
‘ঠিক আছে, আম্মু। এরপর থেকে আমিও এরকম স্টেশনের নাম লিখে রাখবো। তারপর আমরা ম্যাপ থেকে এগুলোর লোকেশন খুঁজে বের করবো। খুব মজা হবে।’ বলতে বলতে দেখি তার বড় বড় চোখের তারায় সেই অচেনা স্টেশন লাগোয়া ছোট্ট শহরের এক অপূর্ব রোদ ঝলমলে ছবি ভেসে উঠেছে। কী কাণ্ড!
দুই মেয়ের কথা শুনতে পাই পাশের ঘর থেকে। অনেকক্ষণ হলো ওরা বাইরে থেকে এসেছে। গরম পিৎসাগুলো এতক্ষণে মনে হয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ওদের বলেছিলাম, ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে ফেলতে। খুব সকালে আমাদের ট্রেন। কিন্তু এখন মনেই করতে পারছিনা আমাদের এরপরের গন্তব্য কোথায়। মেস্ত্রে শহর থেকেই ভেনিস ঘুরে আসা হয়েছে। ভেনিস থেকে প্রায় ছয় ঘন্টার ট্রেন জার্নি শেষে রোম। এরপর কি আমাদের বাই এয়ারে বাড়ি ফিরে যাবার কথা? নাকি আমরা এখান থেকে মিলান বা ফ্লোরেন্স যেতে চেয়েছি? কিছুই মনে পড়ছে না।
কিছুক্ষণ পরে হাসানের গলা শুনতে পেলাম। মেয়েদের সাথে কথা বলছে। আমার ঘরে আর আসেনি। স্টেশন থেকে ফিরে কীরকম অদ্ভুত আচরণ করছে আমার সাথে। ওর এই এক বদ অভ্যাস। কোন কারণে আমার ওপর মেজাজ খারাপ হলে কিছু না বলে কথা বন্ধ করে দেয়। আরো বদ অভ্যাস আছে। কিন্তু এটি সবচেয়ে জঘন্য। বিয়ের প্রথম দিকে বুঝতেই পারতাম না হঠাৎ কী এমন হলো যে কথা বলছে না। ধীরে ধীরে তার স্বভাবের নানা দিকের সাথে এই বিষয়টির সাথেও পরিচিত হলাম। কিন্তু আজ সতের বছরেও অভ্যস্ত হতে পারিনি। কী করে হবো?
রক্ত-মানুষের একটা মানুষের ভালো-মন্দ সবই থাকে। তার একটা অতীতও থাকে যেখানে দাম্পত্য জীবন শুরু করার আগের জীবনের নানা ঘটন-অঘটন থাকে। আমি যদি তার অতীতের সবকিছুসহ তাকে মেনে নিতে পারি, নিদেনপক্ষে মেনে নেওয়ার চেষ্টা বা অভিনয় করে যেতে পারি, তাহলে সে মানে হাসান কেন পারেনা এই প্রশ্নের কোন জবাব আমি খুঁজে পাইনা।
আর ভীষণরকম সন্দেহপ্রবণ সে। তার সন্দেহের সাথে কোন ঘটনা মিলে গেলে তো কথাই নেই। যেবার তার ভয়ানক সন্দেহগ্রস্ততার দোষে বাজে মেয়ের খেতাব পেলাম, সেবারই প্রথম ওথেলো সিনড্রোম কাকে বলে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলাম। শুধু তীব্র সন্দেহের বশবর্তী হয়ে যে প্রিয়তমা স্ত্রীকে খুন করে ফেলা যায়, ওথেলো তা প্রমাণ করে গেছে বহু দিন আগেই। আর হাসান যেদিন একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে ধারণা করে নিলো যে আমি আমার জনৈক প্রেমিকের সাথে হোটেলে গোপন অভিসারে গেছি, সেদিনই বুঝে গেলাম যে আমাদের সম্পর্কের দফা-রফা। মেয়েদু’টির মুখের দিকে তাকিয়ে আমি তার সরব এবং নীরব সব ধরনের অপমান আর উপেক্ষা সহ্য করে নিতে থাকলাম।
এভাবে দিন যেতে যেতে শারীরিক দূরত্বের পাশাপাশি আমাদের মানসিক ব্যবধান তৈরি হলো যোজন যোজন। মানুষ অভ্যাসের দাস এই কঠিন সত্যকে হজম করে একটা সময় সবকিছু মেনে নিতে শুরু করলাম। এখন নিয়মমাফিক এক বিছানায় ঘুমালেও ভালোবাসার কোন গাঢ় বা হাল্কা স্পর্শ আমাদের আর ছুঁয়ে যায়না। কেবল মেয়েরা যখন বায়না ধরে স্কুল ছুটির অবকাশে কোথাও বেড়াতে যেতে, তখন মনেমনে প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরা নানারকম প্ল্যান করতে আর পয়সার হিসাব কষতে শুরু করি, কোন নতুন জায়গায় কোন মোটামুটি মানের হোটেলে গিয়ে ওঠা যায় ইত্যাদি। বাস-ট্রেন-প্লেন এর টিকেট করা,অনলাইনে হোটেল বুকিং দেওয়া এসব কাজে মাসটারলি দক্ষতা অর্জন করেছি বলে এখনও এসব আমাকেই করতে হয়। পয়সাটা আমরা দুজনেই শেয়ার করি। বাচ্চাদের সব আবদার মেটাতে চেষ্টা করি যাতে ওরা কোনভাবেই বাবা-মার বর্তমান সম্পর্কের এই বেহাল দশা বুঝতে না পারে।
অবশ্য, ইদানিং মনে হয়, বড় মেয়েটা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। মাঝেমাঝে খেয়াল করেছি সে আমার দিকে যেন কেমন করে তাকায়। কিছু অনুমান করতে চেষ্টা করে হয়তো। সে যখন স্টেশনে দেখা অপরিচিত লোকটার কথা বলছিল, আমার ওপর ফেলা ওর দৃষ্টির ভাষা ছিল অন্যরকম। কিন্তু আমি কিছুতেই মেয়ের সামনে ধরা পড়তে চাইছিলাম না।
আমি তো একবারেই বুঝতে পেরেছি,স্টেশনে কার সাথে ওদের দেখা হয়েছে। বড় মেয়ের এই বয়সেই তো তার সাথে আমার পরিচয়। পৃথিবীর আরেক প্রান্তে অনেক দূরের এক ছোট্ট শহরে। আমাদের প্রথম দৃষ্টি বিনিময় সেই ছোট্ট শহরের এক ট্রেন স্টেশনে।
নানাবাড়ি থেকে ঘুরে আম্মা ফিরছিল রংপুর থেকে। প্রতি বছরের মতো সেবার শীতে আমাদের সবার বেড়াতে যাওয়া হয়নি। নানার শরীর খারাপের খবর পেয়ে আম্মা একাই ট্রেনে উঠে বসেছিল। প্রায় দেড় মাস পরে যখন ফিরে এলো, আমরা সব ভাইবোন মিলে তাকে রিসিভ করতে গেলাম। আর সেখানেই সে এলো আমাকে প্রথমবারের মতো দেখতে।
তারপর, কয়েক বছর পরে, আরেকবার সেই স্টেশনে আমাদের দেখা করবার কথা ছিল। বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম। তার হাত ধরে অন্য কোথাও হারিয়ে যাবো বলে। হারিয়ে যেতে পারিনি। আমি পারলেও আমার ভীরু প্রেমিক তার বাড়ির মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এতো মা- ন্যাওটা ছেলে! কথা দিয়েও শেষ পর্যন্ত সে আসেনি। ক্ষুধার্ত পেটে এবং তৃষ্ণার্ত নয়নে প্রায় সারাদিন অপেক্ষা করে বসেছিলাম আমাদের প্রিয় সেই ছোট্ট শহরের ট্রেন স্টেশনের এক কাঠের বেঞ্চে। কতরকম নোংরা দৃষ্টি আর মন্তব্য উপেক্ষা করে। সে আসেনি বলে সে সন্ধায় আমি ফিরে এসেছিলাম নিজের কাছে।
তারপর থেকে ট্রেন স্টেশন ঘিরে আমার এই ঘোর, আমার এই বিভ্রান্তি, যখন-তখন যেখানে-সেখানে চেতনের সবকিছু নাড়িয়ে দেওয়া এই ওলট পালট করা বিভ্রম। তারপর থেকে আমার সবসময় মনে হয়, পৃথিবীর ট্রেন স্টেশনগুলো যেন একেকটা প্রেমকাহিনী অথবা বিরহগাঁথার সূতিকাগার। জতুগৃহ গল্পটার কথা মনে আছে? আর ওই যে আনা কারেনিনা যে কিনা স্টেশনেই চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লো !
এখন মনে হচ্ছে, এই ঘটনার পর আমার গল্পটাও ওরকম তালিকায় যোগ হয়ে যাবে। যাক।