অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বিজ্ঞাপনের বুমেরাং তত্ত্ব : বিপর্যয়ের দায় কার!

ড. ইসলাম শফিক

প্রকাশিত: ১১:৪৭ পিএম, ১২ জুন ২০২৪ বুধবার   আপডেট: ১২:০৭ এএম, ১৩ জুন ২০২৪ বৃহস্পতিবার

গাজায় ইসরায়েলি হামলার জের ধরে কোমল পানীয় কোকাকোলা এবং পেপসি বয়কট শুরু হয় বিশ্বজুড়ে। ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোম্পানি ও পণ্য বয়কটের ঘোষণায় বিভিন্ন দেশে এমন সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্র্যান্ডকে। বয়কটের মুখে পড়ে বিক্রি কমে গেছে জনপ্রিয় পানীয় পেপসি ও কোকাকোলার। একদিকে চলছে লাগাতার বোমা হামলা আর অন্যদিকে চলছে পণ্য বয়কট রাজনীতি। গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার প্রতিবাদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোমল পানীয় কোকাকোলা এবং পেপসি বয়কটের ডাক ওঠে। এই পরিস্থিতিতে এই দুটি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন ও মার্কেটিং বিশেষজ্ঞগণ বেশ নড়েচড়ে বসেন। চলে নানারকম গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণ। দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজ্ঞাপন এজেন্সির ক্রিয়েটিভগণ নানারকম ট্র্যাটিজি ও আইডিয়া নিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন। অনেক প্রতীক্ষার পর গতকাল ০৯ জুন ২০২৪, ‘This is my coke’ কোকাকোলা বাংলাদেশ, নতুন একটি টেলিভিশন বিজ্ঞাপন (টিভিসি) প্রচার শুরু করেছে। অল্প সময়ে অধিক প্রচারের সুবিধা পাওয়ার জন্য T20 Cricket World Cup এর ভারত-পাকিস্তানের চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দর্শক উত্তেজনাপ্রিয় ম্যাচটির সময়সূচিকে বেছে নেয়া হয়েছে। এছাড়াও অনলাইন প্ল্যাটফর্মের সকল প্রকার নিউমিডিয়াতে প্রচার করা হচ্ছে।

কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে কোকাকোলার জন্য এই বিজ্ঞাপন নির্মাণ ও সম্প্রচার করা হচ্ছে, তা টার্গেট অডিয়েন্স ও ভোক্তাশ্রেণি গ্রহণ করেননি। কারণ বিজ্ঞাপনের গল্পটি সাধারণ মানুষের আবেগের বিপরীত মেরুতে তৈরি হয়েছে। কোকাকোলা’র বর্তমান বাজার পরিস্থিতি, ভোক্তার মনস্তত্ত্ব, পানীয় ক্রয়ের মানসিকতা, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধ, অন্যান্য প্রতিযোগী ব্র্যান্ডের সাথে বাজারের অস্থির পরিস্থিতি মোকাবেলা প্রভৃতি বিষয়ে গভীরভাবে গবেষণা না করে অতি সাধারণ মানের একটি গবেষণা ফলাফলের উপর নির্ভর করে এই বিজ্ঞাপনচিত্রটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে; যা কোকাকোলা ব্র্যান্ডকে বাংলাদেশের বাজারে নিশ্চিতভাবে আরো সংকটে ফেলে দিলো! বলা হয়ে থাকে- বিজ্ঞাপনের গরু আকাশে উড়ে! সেকেলের এই আদি বিজ্ঞাপন তত্ত্ব দিয়ে এখন আর ‘বাজার রাজত্ব’ করা যাবে না। পণ্যের বিক্রয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম এমন বাণিজ্যসফল কার্যকরী বিজ্ঞাপনের জন্য আদিতেই প্রযোজন একটি ভালো মানের কপি। আর কপিরাইটিংয়ের জন্য প্রয়োজন যথার্থ মার্কেটিং টিমের কৌশলগত ব্রিফ, প্রকৃত গবেষণাতথ্য ও বিষয়ভিত্তিক ভাবনা-চিন্তা, উদ্দিষ্ট দর্শক বা ভোক্তার চাহিদা ও জীবনদর্শন এবং নন্দনতাত্ত্বিক জ্ঞানকে বিজনেস পলিসিতে প্রয়োগ করার দক্ষতা। 

গভীরভাবে বয়কট খাদে নিমজ্জিত ব্র্যান্ড পণ্যের জন্য এক মিনিট ব্যাপ্তিতে খুব হালকা মেজাজের গল্পকাঠামোতো এই বিজ্ঞাপনচিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’- এই গানটিকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে মুদি দোকানদার বাবলু মিয়ার মোবাইলে ইউটিউব দেখার মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি কোক স্টুডিওর জন্য নির্মিত গান। নিজেদের তৈরিকৃত এই গানটি জোড়পূর্বক বিজ্ঞাপনচিত্রের শুরুতে ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন ছিল না। আরোপিত গানের কথা বা বাণী পণ্য প্রমোশনে কোনোভাবেই সাহায্যে আসেনি বরং আন্তর্জাতিক আগ্রাসী ধর্মব্যবসার সাথে একেবারে সাংঘর্ষিক অবস্থান এই গানের মর্মকথা! বিজ্ঞাপনের গল্পে দেখা যায়-গরমে ক্লান্ত সোহেল নামের একজন তরুণ একটি মুদি দোকানে এসে দাঁড়ায়। দোকানী বাবলু মিয়া তার দোকানের টেবিল ফ্যানটি আগত সোহেলের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাসে তাকে ক্লান্তিমুক্ত করতে চায়। মুদি দোকানদার বাবলু বলে-কী সোহেল, কোক দিমু নাকি একটা?
প্রত্যুত্তরে সোহেল বলে- না বাবলু ভাই, এই জিনিস এখন আর খাচ্ছি না!
-বাবলু : ক্যান কি হৈলো আবার?
-সোহেল : শোনেন নাই, এইডাতো ঐ জায়গার!
এই সংলাপের পর দোকানদার বাবলু মিয়া টেবিল ফ্যানের বাতাস সোহেলের দিক থেকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়! 
এই কথোপকথনের মাধ্যমে কোকাকোলা ব্র্যান্ডের বাংলাদেশের বাজারে চলমান বয়কট পরিস্থিতিতে বর্তমানের নাকাল ও বেহাল অবস্থার করুণচিত্র ফুটে ওঠেছে; যা বিজ্ঞাপনটির গল্পগাঁথনির অত্যন্ত দুর্বল দিক। পরবর্তীতে পুরো গল্পে মুদি দোকানদার বাবলু কোকাকোলার লোকাল অ্যাম্বাসেডর হয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যান -‘কোকাকোলা পণ্যটি বয়কট খাদে নিমজ্জিত হয়ে মরিয়াও বাঁচিয়া রহিয়াছে’। আইসিইউতে কোমা সজ্জায় মুমূর্ষু ব্র্যান্ডকে বাঁচাতে দোকানদার বাবলু নিজের দোকান ছেড়ে চুলকাটার দোকানে যান, কোকের বয়কট ইতিহাসের নেপথ্য সত্য উদঘাটন করতে এবং হাঁটে-বাটে, পথে-ঘাটে গিয়ে প্রমাণ করতে চান এসব অপ্রচার, ভিত্তিহীন। শোনা কথায় কান দিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছেন বয়কটকারীগণ! ভোক্তাদের বিশ্বাস ফেরানোর জন্য অনেকগুলো তথ্যউপাত্ত উপস্থাপন করেন মুদি বাবলু। তাতে আরো হিতে বিপরীত হয়েছে! সুলতান সুলেমানকে রূপকভাবে ব্যঙ্গ করার বিষয়টি দর্শক ভালোভাবে নেয়নি। "আরে মিঞারা, কোক মোটেও ঐ জায়গার না"-এই সংলাপের মিঞারা’ সম্বোধনও শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ইঙ্গিত করে! বিজ্ঞাপনচিত্রে কোক বয়কটকারী বা গুজব ছড়ানো কাজে যারা সম্পৃক্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে সেসব নামগুলো হলো- সোহেল, সুলতান সোলেমান, বাশার ও আকাশ। উল্লিখিত নামগুলোও একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে! নামকরণের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে অত্যন্ত সন্তর্পণে! গল্পের বন্ধু চরিত্রগুলোর নামকরণের ক্ষেত্রে অন্যান্য ধর্মের প্রচলিত কমন নামগুলোও আনা যেতো। গল্পবুনন ও চরিত্রের নামকরণের ক্ষেত্রে কপিরাইটার অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন!

কোকাকোলা ব্র্যান্ডের পক্ষে দোকানদার বাবলু মিয়ার অযাচিত অতি দায়িত্ববোধ দর্শককে বিমোহিত না করে বরং হতাশ করেছে! মুদি দোকানী বাবলু মিয়ার শেষ সংলাপ- “কোকে একটা ঢোক দেন, তারপর একটা সার্চ দেন”। এই উপদেশ সংলাপে দর্শক চরম বিরক্ত হচ্ছেন! দর্শক সরাসরি উপদেশ পছন্দ করেন না। সংলাপে আবার সরাসবি প্রোডাক্ট ব্যবহারে নির্দেশও রয়েছে! এসব কপিরাইটিং কৌশল বিজ্ঞাপন শিল্পের প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ! নিমজ্জিত একটা ব্র্যান্ডের চ্যালেঞ্জিং সময়ে প্রমোশন করার জন্য বিজ্ঞাপন নির্মাণে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন ছিল।

বিপণন ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞাপনশিল্পের এই ধরনের নির্মাণ উচ্চতা দিয়ে পণ্য বা সার্ভিসের প্রমোশন সফলতা তো আসবেই না; বরং বিজ্ঞাপনের বুমেরাং শক্তি ব্র্যান্ডের ইমেজকে চমরভাবে দীর্ঘসময়ের জন্য বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিতে ফেলবে! বিজ্ঞাপনের শক্তি ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে পণ্যের বিক্রয় বৃদ্ধি ও ব্র্যান্ডের ইমেজ তৈরি করা হয়। অপরদিকে বিজ্ঞাপনে ভাষার সঠিক ব্যবহার না করতে পারলে বুমেরাং হয়ে আঘাত করবে আপন গৃহে! 

ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক, গবেষক ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব।