নাট্যপর্যালোচনা
স্বপ্নদল-এর ‘ম্যাকবেথ’: মূকাভিনয়রীতির নিরীক্ষামূলক নাট্যপ্রযোজনা
ড. ইসলাম শফিক
প্রকাশিত: ১১:০৫ পিএম, ৭ জুন ২০২৪ শুক্রবার আপডেট: ১১:০৬ পিএম, ৮ জুন ২০২৪ শনিবার
নাট্যসংগঠন ‘স্বপ্নদল’ উইলিয়াম শেক্সপিয়রের রচনা The Tragedie of Macbeth অবলম্বনে ব্যতিক্রমী একটি প্রযোজনা ঢাকার নাট্যমঞ্চে নিয়মিত প্রদর্শনী করছে। প্রযোজনাটি ব্যতিক্রমী অভিধা আখ্যা প্রদানের কারণ হলো- বাংলাদেশের সমকালীন থিয়েটার চর্চায় নিয়মিত অনুশীলিত নাট্যপ্রযোজনা থেকে এটি ভিন্নতর। ‘ম্যাকবেথ’ গবেষণাগারে মূকাভিনয়রীতিতে মঞ্চবুনন হয়েছে এই দৃশ্যকাব্যের। কাহিনি পুনর্বিন্যাস করেছেন জুয়েনা শবনম; প্রযোজনাটির নির্দেশনা দিয়েছেন জাহিদ রিপন। ৫ জুন ২০২৪, বুধবার সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে এই মাইমোড্রামা ‘ম্যাকবেথ’-এর ১৪তম মঞ্চায়ন দেখার সুযোগ হলো। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের রচনা নিয়ে সারাবিশ্বে মঞ্চ, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনসহ আরও বিভিন্ন জনরায় নানামাত্রিক নিরীক্ষাধর্মী শিল্প তৈরি হয়েছে। তবে পূর্ণাঙ্গ মূকনাট্য বা মাইমোড্রামা হিসেবে স্বপ্নদলের এই ‘ম্যাকবেথ’ প্রযোজনটি ইতোমধ্যে অনন্য স্থান অর্জন করেছে।
সাহসী স্কটিশ জেনারেল ম্যাকবেথ ও তার সহকর্মী ব্যাঙ্কো যখন ফিরে আসছিলেন জন্মভূমি স্কটল্যান্ডে তখন এক ঊষর প্রান্তরে তাদের সঙ্গে দেখা হয় তিন ডাকিনীর। তিন জন ডাইনি ম্যাকবেথ ও ব্যাঙ্কোকে অভিবাদন জানিয়ে তিনটি ভবিষ্যৎবাণী উচ্চারণ করেন। ডাকিনীদের কাছ থেকে একটি ভবিষ্যদ্বাণী পান যে, একদিন তিনি স্কটল্যান্ডের রাজা হবেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষা গ্রাস করে ম্যাকবেথকে। স্ত্রী লেডি ম্যাকবেথ ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে ম্যাকবেথকে প্রলুব্ধ করে। ম্যাকবেথের আকাঙ্খা লেডি ম্যাকবেথের মনে উচ্চাকাঙ্খায় রুপ নেয়, উন্মত্ত হতে থাকে কখন সে ম্যাকবেথকে রাজার বেশে দেখবে। বীর বেশে ম্যাকবেথ ফিরে আসে প্রাসাদে। রাজা ডানকান নিজেই সরলতা ও উদারতা দেখিয়ে ম্যাকবেথের প্রাসাদে আতিথেয়তা গ্রহণের ও রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। ক্ষমতালিপ্সায় অন্ধ ম্যাকবেথ রাজা ডানকানকে হত্যা করে স্কটিশ সিংহাসন অধিগ্রহণ করে। সেনাপতি ম্যাকবেথ স্বার্থপরতা, ক্ষমতালিপ্সা ও অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে রাজ্যক্ষমতার স্থায়ী দখল ও শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটাতে থাকেন এবং পরিশেষে ম্যাকবেথকেও একই পরিণতির শিকার হতে হয়। ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে ক্ষমতার মোহে ম্যাকবেথ কর্তৃক রাজা ডানকানকে হত্যার ঘটনাটির সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। নির্দেশক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ম্যাকবেথ’র কাহিনির সাথে বাংলা ভূখণ্ডের নির্মম রক্তাক্ত ইতিহাসকে প্রাসঙ্গিকভাবে চিত্রিত করেছেন। ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের অন্যতম সম্পদ ভাষার ঐশ্বর্য ও কাব্যময়তা। মূকনাট্য উপস্থাপনায় তাল, লয় ও ছন্দে ও গতিভঙ্গিমায় সংগীত ও আলোর যুগপথ চলনে তৈরি হয়েছে এই নাটকের নির্দেশনাশৈলি; যা নাট্যঘটনা দর্শকের সাথে যোগাযোগে লাভে মোক্ষম শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কাহিনির মঞ্চউপস্থাপনা ও অভিনয়রীতিতে ‘গ্রন্থিক’ ও ‘শৌভিক’ পরিবেশনা কৌশলের সাথে ঐতিহ্যবাহী বাঙলা নাট্যের সাবলিল চলনের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নির্দেশক জাহিদ রিপন নির্মাণ করেছেন এই ট্র্যাজিক উপাখ্যান।
মাইমোড্রামার মাধ্যমে একটি বিদেশী নাটকের মঞ্চে উপস্থাপনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সংলাপবিহীন এই অভিনয়ে সাধারণ দর্শকের কাছে নাট্যকাহিনিকে যোগাযোগ সক্ষম করে বোধগম্য করে তোলা এবং নাট্যচরিত্রের নাম, স্থান-কাল-পাত্রের পরিচয়, কাহিনির দার্শনিক অভিপ্রায় ও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। মূকাভিনয়ের মাধ্যমে নির্দেশক এমন সব দৃশ্যনির্মাণ করেছেন যা গল্পের প্রতিটি অনুক্ষণ দর্শককে চিত্রকল্পের জগতে প্রবেশ করিয়ে দেয়। কোরিওগ্রাফি পরিকল্পনায় নির্দেশককে সহায়তা করছেন হাসানুজ্জামান। কোরিওগ্রাফ ও অভিনয় অভিব্যক্তির সরস গুণে সংলাপহীনতা কীহিনির গতিপ্রকৃতি বোধগম্যতায় দর্শকের কোনো সমস্যা হয়নি। আবহসঙ্গীত এই নাটকের প্রাণস্পন্দন। এই নাটকে আবহসঙ্গীত থিয়েট্রিক্যাল ক্যারেক্টার হিসেবে অন্যতম রোল প্লে করেছে। বিষয়ানুগ আবহ তৈরিতে ষড়যন্ত্র, হত্যা, যুদ্ধ, লোভ, ভয়, আতংক, উচ্চাশা প্রভৃতি রস নিষ্পত্তিতে ব্যাকগ্রউন্ড মিউজিকের সুনিপুণ ব্যবহার ভীষণভাবে সহায়তা করেছে প্রযোজনাকে। আবহসঙ্গীত পরিকল্পক শাখাওয়াত শ্যামল ও মিজাউল ইসলাম খান-এর শব্দচিত্রকল্প অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে!
প্রযোজনাটির মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা করেছেন ফজলে রাব্বি সুকর্ন। পুরো মঞ্চটিকে তিনি অভিনয়ভূমি হিসেবে চিন্তা করে সেট পরিকল্পনা করেছেন। নাট্যকাহিনির ট্র্যাজিক রসের গল্পকথনে থিম কালার হিসেবে সাইড উইংস ও সাইক্লোরামায় কালো রঙ ব্যবহার করা হয়েছে, এমনকি মঞ্চভূমিকে অভিনয় সহায়ক করে করার জন্য কালো রঙের বিশেষ ম্যাট ব্যবহার করা হয়েছে। মঞ্চভূমির উপর এক ফুট উঁচু মাত্র তিনটি কালো রঙের চাকাযুক্ত মুভেব্যল প্ল্যাটফর্ম পুরো সেটের প্রাণশক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। নির্দেশক তিনটি প্ল্যাটফর্ম নানামাত্রিকতায় ব্যবহার করেছেন। কখনো রাজদরবার, কখনো শয়নকক্ষ, কখনোবা যুদ্ধক্ষেত্র অথবা ডাকিনীদের আবাসস্থল তৈরি করেছেন নিমিষেই। নিরাভরণ মঞ্চে মূকাভিনয়, কম্পোজিশন ও দলীয় এক্সপ্রেশনের উপর নির্দেশক অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পক ফজলে রাব্বি সুকর্ন মঞ্চে আলো ব্যবহারে অত্যন্ত পরিমিতির সাথে চিত্রশিল্পীর ভূমিকা পালন করেছেন। ডাকিনীদের আগমন প্রস্থানের ধুম্রজাল সৃজন, যুদ্ধ ও হত্যাদৃশ্য, চরিত্রের মনস্তাস্ত্বিক পরিবর্তনে আলোর রঙের অসাধারণ প্রয়োগ বিন্যাসে দর্শককে প্রতিটি সময়ে নাট্যঘটনার স্থানে পরিভ্রমণ করিয়েছে। আলো কখনো আলো হয়ে ধরা দেয় নি এই প্রযোজনার আলোক পরিকল্পনায়, মঞ্চক্যানভাসে চলমান পেইন্টিংস্ বলা যায় আলোচ্য আলোক প্রক্ষেপণকে।
নাট্যকার ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের আখ্যানভাগটি গ্রহণ করেছিলেন ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের ইতিহাস-সংক্রান্ত হলিনশেড’স ক্রনিকলস নামক একটি গ্রন্থে উল্লিখিত স্কটিশ রাজা ম্যাকবেথ, ম্যাকডাফ ও ডানকানের বিবরণ থেকে। সময়কাল ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি। ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের পোশাক পরিকল্পনা অত্যন্ত জটিল ও গবেষণামূলক একটি কাজ। নাট্যঘটনার সময়কাল, চরিত্র, বয়স, আবহাওয়া প্রভৃতি বিষয় বিচার বিশ্লেষণপূর্বক মাইমোড্রামার জন্য পারফরমেন্স সহায়ক পোশাক পরিকল্পনা করেছেন জুয়েনা শবনম, হাসানুজ্জামান ও সুমাইয়া শিশির। একজন অভিনেতা একাধিক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সেক্ষেত্রে দ্রুত পরির্তন সম্ভব এবং পূর্বে অভিনেয় চরিত্র থেকে ভিন্ন করে এমন অসাধারণ কিছু কৌশল ব্যবহার করে প্রযোজনার গতিকে বেগবান করেছে। পোশাকে ব্যবহৃত রঙ, বুনন, উপাদান দর্শকবৃন্দকে ঘটনার সাথে একাত্ম করে ষোড়শ শতকের স্কটল্যান্ড-এর রাজ প্রতিবেশে নিয়ে যায়। দর্শককে সংলাপবিহীন অভিনেয় চরিত্রগুলোকে খুব সহজে চিনতে সহায়তা করে এই প্রযোজনার পোশাক। প্রত্যেক অভিনয়শিল্পীদের হাতে পরিধেয় সাদা গ্লাভস্ ও পায়ে পরিহিত সাদা মোজা মাইমোড্রামার আবহকে শক্তিশালী রূপে প্রতিষ্ঠা করেছে। মেকআপের ক্ষেত্রে মাইমোড্রামায় অতি সাধারণভাবে ব্যবহৃক অভিনয়শিল্পীদের পুরো মুখমণ্ডলে সাদা রঙের মেকআপ পরিহার করার পরিকল্পনার জন্য নির্দেশেক জাহিদ রিপনকে সাধুবাদ জানাই।
প্রযোজনার গ্রন্থিকগণ- জুয়েনা শবনম, হাসানুজ্জামান. সুমাইয়া শিশির। শৌভিকগণ- প্রথম ডাকিনী: সুমাইয়া শিশির, সোনালী রহমান, দ্বিতীয় ডাকিনী: হাসানুজ্জামান, তৃতীয় ডাকিনী- জুয়েনা শবনম, ম্যাকবেথ চরিত্রে-তারেক আজিজ নিশক, ব্যাংকো চরিত্রে- শিশির শিকদার, ব্যাংকোর পুত্র ফ্লিয়ান্স চরিত্রে- অনিন্দ্য অন্তরিক্ষ, লেডি ম্যাকবেথ চরিত্রে- জেবুন নেছা, রাজা ডানকান চরিত্রে- শাখাওয়াত শ্যামল, ম্যালকম চরিত্রে- সোনালী রহমান, ম্যাকডাফ চরিত্রে-অর্ক অপু, লেডি ম্যাকডাফ চরিত্রে- সুমাইয়া শিশির, ম্যাকডাফের পুত্র চরিত্রে-শফিকুল ইসলাম, প্রহরী চরিত্রে- অনিন্দ্য অন্তরিক্ষ, খাইরুল ইসলাম রানা, শফিকুল ইসলাম, সৈন্যদল চরিত্রে- অনিন্দ্য অন্তরিক্ষ, সোনালী রহমান, শাখাওয়াত শ্যামল, শফিকুল ইসলাম, খাইরুল ইসলাম রানা, শিশির শিকদার, অর্ক অপু, জনগণ: সোনালী রহমান, অনিন্দ্য অন্তরিক্ষ, খাইরুল ইসলাম রানা, শফিকুল ইসলাম, শাখাওয়াত শ্যামল, অর্ক অপু, সুমাইয়া শিশির, জুয়েনা শবনম, হাসানুজ্জামান প্রমুখ। প্রযোজনা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছেন শাখাওয়াত শ্যামল।
স্বপ্নদলের মাইমোড্রামা ‘ম্যাকবেথ’ বিশ্বপ্রেক্ষাপটে বাঙলা মূকাভিনয়ের অন্যতম আধুনিক উপস্থাপন। প্রযোজনাদলের অভিনয় এনার্জি দর্শককে মুগ্ধ করেছে। সংলাপহীন হওয়া সত্ত্বেও বিরতিহীন এক ঘন্টা ব্যাপ্তির প্রযোজনাটি কোথাও ক্লান্তিকর মনে হয়নি বা ঝুলে যায়নি। টানটান পরিপূর্ণ উত্তেজনায় একটার পর একটা দৃশ্যের মঞ্চভাষার ট্র্যাজিক রসের চিত্রায়ণ হৃদয়াঙ্গম করেছে মিলনায়তনে উপস্থিত দর্শকবৃন্দ। প্রত্যাশা করছি- স্বপ্নদলের মূকনাট্য ‘ম্যাকবেথ’ নাট্যপ্রযোজনা বিশ্ব রঙ্গমঞ্চ আলোকিত করে বাংলাদেশের থিয়েটার শিল্পকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মাথা উঁচু করে অধিষ্ঠিত করবে।
ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক, গবেষক ও অনুষ্ঠান নির্মাতা।