মোদির চেয়ে বেশি ব্যবধানে জিতেছেন ২২৪ প্রার্থী
ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:৫৭ পিএম, ৭ জুন ২০২৪ শুক্রবার
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের ফল বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে কিন্তু তার সবকটিরই কেন্দ্রে থাকবেন নরেন্দ্র মোদি। তার কারণ, বিজেপি এই নির্বাচন তারই নামে লড়েছে।
উত্তরপ্রদেশের বারাণসী থেকে লাগাতার তৃতীয়বার জিতে তিনি সংসদে পৌঁছেছেন বটে কিন্তু ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ওই একই আসন থেকে লড়া তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রাপ্ত ভোটের সঙ্গে মোদির ঝুলিতে থাকা ভোটের ব্যবধান অন্যান্য বারের তুলনায় কম।
২০১৯ গত লোকসভা ভোটে তিনি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ৪ লক্ষ ৭৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন, যা এইবার কমে ১ লক্ষ ৫২ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এই লোকসভা নির্বাচনে বারাণসী থেকে মোদির বিপরীতে দাঁড়ানো কংগ্রেস প্রার্থী অজয় রাই পেয়েছেন ৪ লক্ষ ৬০ হাজার ৪৫৭টি ভোট। আর নরেন্দ্র মোদির ঝুলিতে রয়েছে ৬ লক্ষ ১২ হাজার ৯৭০টি ভোট।
ভোটের এই ব্যবধান এভাবেও বিশ্লেষণ করা যেতে পারে যে, লোকসভার ৫৪২টি (বাকি একটিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন বিজেপির মুকেশ কুমার চন্দ্রকান্ত দালাল) আসনের মধ্যে ২২৪টি আসনে জয়ী প্রার্থীরা প্রধানমন্ত্রী মোদির থেকেও আরও কতটা বেশি ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন।
মোদি বনাম বিরোধী প্রার্থীরা
এই ২২৪টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১১২টি এমন আসন রয়েছে যেখানে অন্য দলের প্রার্থীদের জয়ের ব্যবধান বারাণসীতে মোদির জয়ের মার্জিনের চেয়ে বেশি। আবার বিজেপিরও এমন ১১২ জন প্রার্থী রয়েছেন যারা নরেন্দ্র মোদির তুলনায় বড় ব্যবধানে নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।
এদিকে, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ৫২টি আসন পেলেও এইবার সেই সংখ্যা পৌঁছেছে ৯৯তে। দলের নেতা রাহুল গান্ধী উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলি এবং কেরালার ওয়েনাড থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এই দুটি আসনেই রাহুল গান্ধী তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে তিন লক্ষেরও বেশি ভোটে পরাজিত করেছেন।
বিরোধী দলের অনেক পরিচিত নেতাই আছেন যারা এই লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। জিতেছেন বড় ভোটের ব্যবধানেও। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর ভাইপো ও তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অভিষেক ব্যানার্জী ডায়মন্ড হারবার আসনে ৭ লক্ষ ১০ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। আসামের কংগ্রেস নেতা রকিবুল হুসেনও জিতেছে প্রায় দশ লক্ষ ভোটের ব্যবধানে।
এই একই তালিকায় রয়েছেন ডিএমকে নেতা এম কে কানিমোঝি, এআইএমআইএম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি, সমাজবাদী পার্টির সভাপতি অখিলেশ ইয়াদব, আম আদমি পার্টির নেতা গুরমিত সিং, ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির সুপ্রিয়া সুলে এবং কয়েকজন নির্দলীয় প্রার্থীও।
নরেন্দ্র মোদি বনাম বিজেপির অন্য প্রার্থীরা
গেরুয়া শিবিরের অন্দরেই এমন একাধিক নেতা রয়েছেন যারা নরেন্দ্র মোদির চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন এবং একই সঙ্গে তাদের নিকটতম প্রার্থীর চেয়ে ভোটের ব্যবধানও বড়। এই তালিকায় ১১২ জন বিজেপি প্রার্থী আছেন।
এই নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে নামটা চর্চায় রয়েছে সেটা হলো মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। তিনি ওই রাজ্যের বিদিশা আসন থেকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ৮ লক্ষ ২০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। বিজেপির আরেক হেভি ওয়েট প্রার্থী অমিত শাহ গুজরাটের গান্ধীনগর লোকসভা আসনে ৭ লক্ষ ৪৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন।
উত্তরপ্রদেশের গৌতম বুদ্ধ নগর আসনে ৫ লক্ষ ৫৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন মহেশ শর্মা। অন্যদিকে, মধ্যপ্রদেশের গুনা আসনে ৫ লক্ষ ৪০ হাজার ভোটে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়েছেন জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া।
গুজরাটের পোরবন্দর আসনে ৩ লক্ষ ৮৩ হাজার ভোটে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে হারিয়েছেন মনসুখ মাণ্ডভিয়া। আর মহারাষ্ট্রের মুম্বই উত্তর আসনে পীযূষ গোয়েল বিরোধী প্রার্থীকে ৩ লক্ষ ৫৭ হাজার ভোটে হারিয়ে জিতেছেন। হেমা মালিনী তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়েছেন ২ লক্ষ ৯৩ হাজার ভোটে। তিনি জিতেছেন উত্তরপ্রদেশের মথুরা আসন থেকে।
নরেন্দ্র মোদি বনাম সাবেক প্রধানমন্ত্রী
জওহরলাল নেহরু ছাড়া ভারতের আর কোনও প্রধানমন্ত্রী পরপর তিনবার নির্বাচনে জিততে পারেননি। ভারতে এখন পর্যন্ত ১৮টি লোকসভা নির্বাচন হয়েছে এবং নরেন্দ্র মোদিসহ ১৪ জন দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
জওহরলাল নেহরুই একমাত্র নেতা যিনি এই দেশে তিনবার প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন ছিলেন। ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও প্রায় ১২ বছর এই পদে ছিলেন। এছাড়া মনমোহন সিংও ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, জওহরলাল নেহরু যেবার তৃতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রী হন, সেই বছর নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের ফুলপুর লোকসভা আসনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে ৩৩.৪৫ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছিলেন।
এখানে জয়-পরাজয়ের ব্যবধান শতাংশের নিরিখে তুলনা করা হচ্ছে কারণ ভোটারের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েছে। যার অর্থ হলো জওহরলাল নেহরুর জমানায় একটা নির্বাচনী কেন্দ্রে যতজন ভোট দিতেন তার তুলনায় এখন একটা কেন্দ্রে বহুগুণ বেশি ভোটার রয়েছে।
১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধী তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হন। ওই লোকসভা নির্বাচনে তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের মেদক আসন থেকে ভোটে লড়েছিলেন। সেই সময় তিনি তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে ৪৯.৩৫ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন।
প্রসঙ্গত, বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীও তৃতীয়বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি জওহরলাল নেহরু বা নরেন্দ্র মোদির মতো পরপর তিনটি নির্বাচনে জিততে পারেননি।
যে বার তৃতীয় দফায় তিনি প্রধানমন্ত্রী হন, সেইবার অটলবিহারী বাজপেয়ী লক্ষ্ণৌ আসন থেকে লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীকে ১৬.৩৯ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে নির্বাচনে জিতেছিলেন তিনি।
এবার নরেন্দ্র মোদি এই লোকসভা নির্বাচনে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ১৩.৪৯ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন।
তবে এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন কংগ্রেসের রকিবুল হুসেন। আসামের ধুবড়ী আসন থেকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তথা অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের প্রার্থী বদরুদ্দিন আজমলকে ১০ লক্ষ ১২ হাজার ৪৭৬ ভোটে পরাজিত করেছেন।
এই প্রসঙ্গে একটা বিষয় উল্লেখ করতেই হয়, এবং সেটা হলো মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে জয়ী প্রার্থীর পর দুই নম্বরে রয়েছে 'নোটা' বা নান অফ দ্য অ্যাবাভ। এই আসনের ভোটে কংগ্রেস প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
এটিই দেশের একমাত্র আসন, যেখানে ২ লাখ ১৮ হাজার ৬৭৪ জন নোটার বোতাম ব্যবহার করেছেন। একজন ভোটার ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে নোটা-র বোতাম তখন ব্যবহার করেন যখন তিনি তার কেন্দ্রে যে প্রার্থীরা নির্বাচনে লড়ছেন তাদের একজনকেও ভোট দিতে চান না।
ইন্দোরে জয়ী প্রার্থী শঙ্কর লালওয়ানি এবং নোটার মধ্যে ব্যবধান ১০ লক্ষ ৮ হাজার ৭৭।
তবে যদি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কথা বলা হয়, তাহলে এই আসনে জয়ের ব্যবধান ১১ লক্ষ ৭৫ হাজার ৯২। কারণ বহুজনসমাজ পার্টির সঞ্জয় সোলাঙ্কি পেয়েছেন ৫১ হাজার ৬৫৯টি ভোট।
আর এই লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে কম জয়ের ব্যবধান ছিল মুম্বাই উত্তর পশ্চিম আসনে। শিবসেনার রবীন্দ্র ওয়াইকার তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী শিবসেনার (উদ্ধব ঠাকরে) অমল কীর্তিকরকে মাত্র ৪৮ ভোটে পরাজিত করেছেন।