অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

কিংবদন্তি যাত্রাশিল্পী অমলেন্দু বিশ্বাসের শততম জন্মদিন

এন্টারটেইনমেন্ট ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৭:৫৮ পিএম, ২৯ মে ২০২৪ বুধবার  

অমলেন্দু বিশ্বাস

অমলেন্দু বিশ্বাস

অনন্যসাধারণ, কিংবদন্তি যাত্রাপ্রতিভা অমলেন্দু বিশ্বাস। আজ তার শততম জন্মদিন। ১৯২৫ সালের এই দিনে অমলেন্দু বিশ্বাস তৎকালীন বার্মা বর্তমানে মিয়ানমারে জন্মগ্রহণ করেন। 

অমলেন্দু বিশ্বাস ছিলেন একাধারে অভিনেতা, নির্দেশক, সংগঠক, প্রযোজক, যাত্রাপালাকার ও সংস্কারক। যাত্রার যাত্রাপথ কখনও ছিল না নির্বিঘ্ন। বহু সমস্যা-সংকটের মধ্যে এর পালাবদল ঘটেছে। ঔপনিবেশিক ও স্বৈরাচারী শাসনামলে যাত্রা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে বারবার; কিন্তু কখনও হারিয়ে যায়নি। যুগে যুগে এমন কিছু প্রতিভাদীপ্ত যাত্রাশিল্পীর সন্ধান আমরা পাই, যারা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে লোকায়ত জনপদে জনপ্রিয় ও সমৃদ্ধ করে গেছেন। তাদের পুরোভাগে ছিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস।

তার আগে ও পরে আরও অনেক গুণী শিল্পী ছিলেন। কিন্তু তাদের জনপ্রিয়তা ছিল মূলত অভিনয়কেন্দ্রিক। সমকালীন চিন্তা, চেতনা ও জীবনঘনিষ্ঠ উপলব্ধি না থাকার কারণে তারা কেউ তার মতো সমপর্যায়ের ব্যক্তিত্ব হতে পারেননি। গুণী শিল্পীদের মধ্যেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। এ ক্ষেত্রে অমলেন্দু বিশ্বাসের প্রতিভাকে আমরা ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্যের একটি ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারি- ‘মানস সরসে সরসকমলকুল বিকশিত যথা।

অমলেন্দু বিশ্বাসের পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার মসজিদিয়া গ্রামে। তিনি পিতার কর্মক্ষেত্র বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) ইয়াঙ্গুনে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সুরেন্দ্রলাল বিশ্বাস, তার মা জ্ঞানদা দেব। বাবা ইয়্ঙ্গুনে কাস্টমস বিভাগে চাকুরি করতেন। কিশোর বয়সে তিনি বাবার সঙ্গে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে চলে আসেন। ১৯৪১ খ্রীস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে প্রথমে কলকাতায় ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সে যোগ দিয়েছিলেন। পরে কিছু দিন পুলিশে কাজ করেন।

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে রবার্টসন কলেজ থেকে এফ, এ, পাস করেন। বাংলাদেশে চলে আসেন ১৯৪৭ সালে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে হিসাব বিভাগে চাকুরি পেলেন। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য তার বিরূদ্ধে পুলিশের হুলিয়া জারি হয়েছিল। তার স্ত্রী জ্যোৎস্না বিশ্বাস বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় যাত্রা অভিনেত্রী। অমলেন্দু বিশ্বাসের কন্যা অরুণা বিশ্বাস একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। অমলেন্দু বাল্যকালেই নাটকের প্রতি আগ্রহী হন। এ কারণে তার ভাগ্যে যথেষ্ট পারিবারিক নিগ্রহ জোটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মিত্রবাহিনীতে এবং যুদ্ধশেষে চট্টগ্রামে রেলের চাকুরিতে যোগ দেন। চাকুরি জীবনের পাশাপাশি নাটকে অভিনয় এবং গণসঙ্গীত চর্চা অব্যাহত রাখেন। ১৯৫০-এর দশকের সূচনায় তিনি তার কয়েকজন সতীর্থের উদ্যোগে ‘বাবুল থিয়েটার’ নামে একটি নাট্যদল গড়ে তোলেন। ১৯৫৪ সাল নাগাদ এই দলটিই ‘বাবুল অপেরা’য় পরিণত হয়। এরপর অমলেন্দু বিশ্বাস রেলের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে মুক্ত মঞ্চকেই তার শিল্পী জীবনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন। গ্রাম বাংলার চিরায়ত লোকনাট্যমাধ্যম যাত্রাশিল্পের বিকাশ সাধনই তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে। তার একান্ত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাতেই একদিন ‘বাবুল অপেরা’ জননন্দিত যাত্রাদলে পরিণত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অমলেন্দু বিশ্বাস ‘চারণিক যাত্রাসমাজ’ নামে একটি যাত্রাদলের গোড়াপত্তন করেন।

পরে এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘চারণিক নাট্যগোষ্ঠী’ দীর্ঘ সাতাশ বছর ধরে তিনি পেশাদার যাত্রামঞ্চকে নিজের প্রতিভাগুণে সমৃদ্ধ করতে থাকেন। সামগ্রিকভাবে যাত্রাশিল্প ও শিল্পীদের মর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রেও তার বিশেষ অবদান রয়েছে। অমলেন্দু বিশ্বাস অসংখ্য পৌরাণিক, ঐতিহাসিক ও সামাজিক পালার বিভিন্ন ধরনের চরিত্র রূপারোপে ও সেসবের নির্দেশনায় নিজেকে যেমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিশালী যাত্রাভিনেতা ও নির্দেশক হিসেবে প্রতিপন্ন করেন, তেমনি যাত্রাশিল্পে জীবনঘনিষ্ঠ পালা মঞ্চায়নেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

তার অভিনীত ও নির্দেশিত যাত্রাপালাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘মাইকেল মধুসূদন’, ‘একটি পয়সা’, ‘জানোয়ার’, ‘সম্রাট জাহান বাদশা’, ‘লেনিন’ ও ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ ইত্যাদি। এসব যাত্রাপালার প্রত্যেকটির নাম ভূমিকায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। ১৯৭৮-৭৯ সালে তার অভিনীত ও নির্দেশিত যাত্রাপালা ‘মাইকেল মধুসূদন’ বিপুলভাবে দর্শকনন্দিত ও প্রশংসিত হয়। ১৯৭৯-৮০ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত প্রথম ও দ্বিতীয় জাতীয় যাত্রা উৎসবে তিনি পরপর দু’বার ‘শ্রেষ্ঠ অভিনেতার’ সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেন। তিনি মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। ১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর এই কিংবদন্তি যাত্রাশিল্পী পরলোকগমন করেন।