‘পণ্ডিত স্যার’
কিংবদন্তী শিক্ষাবিদের মহাপ্রস্থান
ড. ইসলাম শফিক
প্রকাশিত: ১১:৪৩ পিএম, ৮ মে ২০২৪ বুধবার আপডেট: ১১:৪৯ পিএম, ৮ মে ২০২৪ বুধবার
ভারতের সীমান্তবর্তী জেলার শেরপুর গারো পাহাড়ের পাদদেশের উপজেলা নালিতাবাড়ীর বিগত ছয় দশকের কিংবদন্তী শিক্ষক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বিশেষ করে বাংলা ব্যাকরণের পণ্ডিত শিক্ষাবিদ শ্রী নিশিকান্ত ভাদুড়ি স্যার বাঘবেড় ইউনিয়নের বামুনপাড়া গ্রামে নিজ বাড়ীতে আজ ০৮ মে ২০২৪, বুধবার রাত ৯ টা ২৭ মিনিটে পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিন প্রায় ৯০ বছর। শ্রী নিশিকান্ত ভাদুড়ি স্যার বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের একজন প্রবীণ দার্শনিক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ। সকলেই তাঁকে ‘পণ্ডিত স্যার’ উপাধিতে চিনতেন এবং সম্বোধন করে থাকেন। তিনি আমার সরাসরি শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাগুরু। এমন বিনয় স্বভাবের সৌম্য ব্যক্তিত্ব্ প্রমিত শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণের শিক্ষক আমার দেখা দ্বিতীয় কেউ নেই! গৌর গাত্রবর্ণের পণ্ডিত স্যারকে সাদা ধুতি ও সাদা পাঞ্জাবিতে দেখতে দেবদূতের মতো লাগতো। স্যারকে দেখা মাত্র সকলেই মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতেন। দারিদ্রপীড়িত খুব সাধারণ সহজ সরলভাবে জীবনযাপন করেছেন। সম্ভবত যাকে বলে- Less is more. বা ভিন্ন প্রবাদে-Simple living high thinking. এসব উক্তি মনে হয় এই মহান ব্যক্তিত্বের বেলাতেই শুধু প্রযোজ্য।
শ্রী নিশিকান্ত ভাদুড়ি ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে তদানিন্তন পূর্ববাংলার শেরপুরের নালিতাবাড়ীর বাঘবেড়ের ব্রাহ্মণপাড়া নামক অজপাড়াগাঁয়ে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রমণীকান্ত ভাদুড়ি ও মাতার নাম সৌদামিনী দেব্যা। তিনি বাঘবের ফ্রি প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করেন। ১৯৪৯ সালে তারাগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় হতে তিনি মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬২ সালে ময়মনসিংহ দুর্গাবাড়ী চতুষ্পাঠী (বাংলাদেশে সংস্কৃতি এন্ড পালি এডুকেশন বোর্ড) হতে ব্যাকরণে ‘তীর্থ উপাধি’লাভ করেন বাবু নিশিকান্ত ভাদুড়ি। ১৯৬৪ সালে তিনি পেশাজীবনে প্রবেশ করেন। শিক্ষকতার মহান ব্রত নিয়ে তারাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে একটানা ৩০ বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৯৪ সালে অবসরের পরে আরো ৫ বছর চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকতা করেন। তারপর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কোচিং সেন্টারে এমনকি ব্যাচ করে প্রাইভেট পড়িয়ে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন তিনি। আমৃত্যু তিনি শিক্ষকতা করেছেন। প্রায় ৬০ বছর নিরলস পরিশ্রম করে তিনি অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তৈরি করেছেন, যাঁরা দেশে-বিদেশী আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি থিয়েটারে অভিনয় করতেন, করেছেন যাত্রাপালা। সনাতন ধর্মের শাস্ত্রীয় জ্ঞান, পূজা পার্বণের পঞ্জিকা জ্ঞানে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। মহাভারত, রামায়ণ, গীতা, পৌরাণিক জ্ঞানে তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এমন মহান একজন পণ্ডিত শিক্ষকের শিষ্য হতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি এবং আমার মতো বহুজন আশা করি তাই জ্ঞান করেন।
শ্রী নিশিকান্ত ভাদুড়ি ১৯৫৮ সালে জোৎস্না ভাদুড়ির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পত্তির ছয়জন মেয়ে ও দুইজন পুত্র সন্তান নিয়ে আলোকিত পরিবার। জেষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে- অনিমা চক্রবর্তী, প্রতীমা চক্রবর্তী, লতা চক্রবর্তী, প্রীতি ভট্টাচার্য, অরুণা ভট্টাচার্য, নিরঞ্জন ভাদুড়ি, আশীষ ভাদুড়ি অতস ও অপর্ণা ব্যানার্জী। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, সন্তান, নাতি-নাতনী ও অসংখ্যা পুত্রকন্যাসম শিক্ষার্থী রেখে গেছেন।
মহান শিক্ষাগুরুর মহাপ্রস্থানে গভীর শোক ও বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর বিদেহী আত্মার পরলোকগত শান্তি কামনা করছি।