আদর্শিক নেতাকর্মী তৈরি আগে
কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ১১:১০ এএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ শনিবার আপডেট: ১১:১৬ এএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ শনিবার
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার সারাদেশের প্রতি ইউনিয়নে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের কথা জানিয়েছেন। শুক্রবার নওগাঁর এক অনুষ্ঠানে তিনি এই কথা জানান। অনুষ্ঠানটি ছিল ছাত্রলীগের। ওই অনুষ্ঠানে মন্ত্রী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে উপদেশমূলক অনেক কথা বলেছেন। বলেছেন, এই ভাস্কর্যগুলো রক্ষার দায়িত্ব ছাত্রলীগের। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের পাহারায় পুলিশ সদস্যদের পাহারা দেওয়ার প্রসঙ্গও এসেছে মন্ত্রীর বক্তব্যে। তার প্রশ্ন স্বাধীন দেশে কেন জাতির পিতার ভাস্কর্য পুলিশ পাহারা দেবে। এখানে ছাত্রলীগের যে দায়িত্ব আছে তিনি সেটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
মন্ত্রীর বক্তব্য নিঃসন্দেহে যৌক্তিক, কারণ সত্যি-সত্যি কেন জাতির পিতার ভাস্কর্য রক্ষার দায়িত্ব পুলিশ নেবে? এখানে জনতা, বিশেষত ছাত্রলীগের কি কোন দায়িত্ব থাকবে না? এখানে আবার এও প্রশ্ন করা যায় কেন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে রক্ষায় পাহারার ব্যবস্থা থাকবে? যে নেতার পুরো জীবন কেটেছে দেশ মাতৃকার জন্যে, সোনালী যৌবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন যিনি দেশের জন্যে তার স্মরণে স্থাপিত শৈল্পিক স্মারককে কেন রক্ষার নামে পাহারা থাকবে? ওই ভাস্কর্যের সম্মানে আর রক্ষণাবেক্ষণে যেখানে মানুষ থাকার কথা সেখানে কেন আসবে রক্ষার প্রশ্ন? এটা কি জাতির পিতার প্রতি অসম্মান নয়?
এই প্রশ্নগুলো স্বাভাবিক, এবং অন্য অনেককিছুর মত এরও উত্তর নেই। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো জাতির পিতার গড়া দেশে তিনি একশ্রেণির মানুষের দ্বারা অবমাননা ও অবমূল্যায়নের শিকার। এরা কারা সে আমরা জানি। এও জানি এরা কাদের আদর্শিক উত্তরাধিকার। তবে মিন মিন করে বললেও সমুচ্চ কণ্ঠে আমাদের অনেকেই এদেরকে ধিক্কার জানাতে পারি না পাছে কারও অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। অনুভূতির আঘাতের এই ব্যবসা, হয়রানি আদতে এই ক’বছর প্রবল হয়ে ওঠেছে। ধর্মীয় অনুভূতি নামের ব্যাখ্যাহীন এই প্রপঞ্চ আমাদের তলিয়ে দিচ্ছে মধ্যযুগীয় গোপন অলিন্দে। এখানে অনুভূতিপ্রবণ ‘লালসালুর মজিদ’-গোষ্ঠীর উপস্থিতিই কেবল একমাত্র নয়, প্রশাসন, সরকার আর রাজনৈতিক দলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা মানুষেরও সমর্থন আর প্রচ্ছন্ন সহযোগিতা আছে। ফলে বেপরোয়া তারা; আগেও, এখনও। এতে করে প্রগতিবিনাশী যে চক্র বেড়ে ওঠছে তারা ক্রমশ দখলে নিচ্ছে সব।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যেভাবে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে হুমকিধামকি দিয়েছে তাতে করে সরকার-প্রশাসন শুরুতে বিব্রত হয়েছে। ভাস্কর্য নির্মাণ হলে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার যে হুমকি দিয়েছিল তারা তার বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া শুরুটা ছিল কথিত পর্যবেক্ষণের, এরপর সারাদেশে কিছু বিক্ষোভ হয়েছে ঠিক তবে এরআগে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে অনেকটা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে তাদের আদর্শিক অনুসারীরা ঠিকই বঙ্গবন্ধুর একটা ভাস্কর্যে আঘাত হেনেছে। এরপর সারাদেশের নানা জায়গায় প্রতিবাদী কর্মসূচি পালিত হলেও সারাদেশে এই বার্তাও পৌঁছেছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তার হাতে গড়া রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকাকালেও ভেঙে দেওয়া সম্ভব!
কুষ্টিয়া বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনাকে একজন মন্ত্রী ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে দাবি করলেও ওটা আদতে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না; ওটা ছিল অস্তিত্ব জানান দেওয়ার মিশন, শক্তি প্রদর্শন। এই শক্তি একদিনে পায়নি তারা। ক্ষমতার বলয়ে থাকতে-থাকতে অথবা বলা যায় ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে তারা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। দিনশেষে তারা আদতে বিচ্ছিন্ন এক জনগোষ্ঠী, কিন্তু স্রেফ ধর্মীয় অনুভূতির জিগির তুলে তারা আদতে মহীরুহ-প্রায়। সময়ে-সময়ে তারা শাসকদের কাছাকাছি গেছে, তাদের নানা দাবি নানা সময়ে পূরণ হয়েছে। নিজেদের পাঠ্য নয় যে সব পুস্তক সেগুলোর উপাদান নিয়ে দাবি তুলে তারা সেটা আদায় করেছে। লালনের ভাস্কর্য তারা উপড়ে দিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের সামনের জাস্টিসিয়া ভাস্কর্য অপসারণ করাতে পেরেছে, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ঘোষণা দিয়ে তারা ক্ষতিসাধন করেছে, এরপর এখন পর্যন্ত সর্বশেষ সেই কুষ্টিয়ায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী বাঘা যতীনের ভাস্কর্যের ওপরও হামলা করেছে। হোক না সেটা রাতের আঁধারে, তবু এই সাহস কিংবা ধৃষ্টতা প্রদর্শন যাই বলা হোক না কেন সেটাই করেছে তারা।
এই ঘটনাগুলোর প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক হবে বলে ধারণা করা হলেও আদতে সেটা হয়নি। সময় নিয়ে প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এই সময়ক্ষেপণে খোদ আওয়ামী লীগের লোকজনই বিভ্রান্ত হয়েছে। ভাস্কর্যবিরোধীরা ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়ে এটা ইসলামবিরোধী বলার পর আওয়ামী লীগের লোকজনই প্রথমে ‘ভাস্কর্য মূর্তি নয়’ বলে ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যকার পার্থক্য নিরূপণে ব্যস্ত সময় পার করেছে। এতে করে সমাজের একটা শ্রেণির মানুষের মধ্যে মূর্তির প্রতি নেতিবাচক ধারণাও জন্মেছে। এই মূর্তি এবং প্রতিমা আবার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য হওয়ায় মূর্তির বিরুদ্ধে একটা পক্ষও দাঁড়িয়ে গেছে। এই পক্ষের লোকজনের একটা পক্ষ পূজার সময়ে নানা জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুর করে, আরেক পক্ষ এই ভাঙচুরকেও প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সমর্থনও দেয় বলে আমরা দেখে আসছি।
ভাস্কর্য-আলোচনার এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আওয়ামী লীগ সমর্থক দাবিদার অনেককেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণকে ভালোভাবে নেয়নি বলে দৃশ্যমান হয়েছে। তারাও ধর্মব্যবসায়ী চক্রের ব্যাপক প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়েছে। এই বিভ্রান্তি মূলত তাদের আদর্শিক স্খলনের জায়গা থেকে বলে প্রতিভাত হয়েছে। তারা আদতে প্রগতি শব্দের অর্থোদ্ধারে ব্যর্থ। তারাও এই দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে অনাগ্রহী বলে মনে হয়েছে। সংখ্যায় এ সংখ্যা নেহায়েত কম না। অথচ এই ভূখণ্ডের ত্রিশ লক্ষ লোকের আত্মদান, দুই লক্ষ বীরাঙ্গনার জীবনের দাম এটা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া বাংলাদেশের মানুষের লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল তাই। অথচ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক দাবিদারদের এহেন অবস্থা অবাক করার মতই।
এই অবস্থার মূলে রয়েছে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাছে ক্রমশ আমাদের নতজানু হয়ে যাওয়া। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বইমেলায় বইপ্রকাশে প্রশাসনিক কড়াকড়ি রয়েছে, লেখালেখিতে ‘সীমা লঙ্ঘন’ না করার নসিহত রয়েছে, বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখে নানা কড়াকড়ি রয়েছে- এসব ঘটনাসহ আরও নানা ঘটনায় সাম্প্রদায়িক চক্র শক্তিশালী হয়েছে, হচ্ছেও। এরবাইরে আছে ওয়াজ মাহফিলে কিছু বক্তার বেপরোয়া বিদ্বেষমূলক বক্তব্য। এসব বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদানকারীদের তালিকা হয়েছে, হচ্ছে জানানো হলেও কখনই কারও বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তার ওপর রয়েছে চিহ্নিত কিছু বক্তার মাহফিলে সরকার-প্রশাসন-আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য দায়িত্বশীলের উপস্থিতি। এতে করে প্রান্তিক পর্যায়ে এর প্রভাব পড়েছে। ছাত্রলীগের যে নেতা, যে কর্মী শিক্ষা-শান্তি-প্রগতিকে ছাত্রলীগের মূলনীতি স্লোগানে একবার মাঠে নামে সেই নেতা-সেই কর্মী আবার প্রগতির পথের শক্র হিসেবে চিহ্নিত কোন প্রতিক্রিয়াশীলের মুরিদ-সম হয়ে পড়ছে।
ভাস্কর্য বা মূর্তি ইসলামবিরোধী এই রব ওঠার পর খোদ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মধ্যকার যে বিভ্রান্তি সেটা আদতে আদর্শিক অন্তঃসারশূন্যতার এক স্মারক হয়ে রয়েছে। যে আদর্শ অনুশীলনের সেটা অনুশীলনের পর্যায়ে না রেখে আদর্শের নামে বিএনপি ও জামায়াত বিরোধিতা আর ক্ষমতায় থাকার সিঁড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে ধীরে ঘুণে কাটছে তাদের, এবং আদর্শিক এই অবস্থার ফলাফল ভয়াবহ হতে যাচ্ছে।
আজ তাই মুজিব জন্ম শতবর্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য রক্ষায় পুলিশি প্রহরা বসাতে হয়। এখানে স্রেফ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকেই দায়ী করলে নিজেদের দায়িত্বকে অস্বীকার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের পর আওয়ামী লীগের যে জাগরণ শেষের দিকে দেখলাম আমরা সেটাকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা ও আদর্শিক জাগরণ ভাবার কারণ নাই, এটা মূলত সাংগঠনিক নির্দেশনা। সংশ্লিষ্ট নেতা বলেছেন তাই তারা রাজপথে মিছিল করেছে, স্লোগান দিয়েছে; নেতা না বললে এসবের কিছুই হতো না। এখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্মানের প্রতিবাদ মুখ্য ছিল না, মুখ্য ছিল সংশ্লিষ্ট নেতার নির্দেশনা ও আত্মপ্রচার।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার নওগাঁয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে যথার্থই বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য যে ভাবনা ভেবেছিলেন, সেই ভাবনা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বুকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। ছাত্রলীগকে এমন শক্তিশালী হতে হবে, যাতে ছাত্রলীগের হাতে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার পতাকা সুরক্ষিত থাকে।’ কিন্তু আদর্শিক সে অবস্থা কি ছাত্রলীগের আছে? এই সময়ের ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের ক’জন নেতাকর্মী রাষ্ট্রধর্মের ধারণার বাইরে এসে বাহাত্তরে সংবিধানে ফিরে যাওয়া দাবি জানাতে পারবে? সে সংখ্যা খুব বেশি হবে বলে মনে তো হয় না!
ওই অনুষ্ঠানে মন্ত্রী দেশের প্রতি ইউনিয়নে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের কথা বলেছেন। আমার ধারণা এটা অতি-আবেগি কথন এক। কারণ প্রতি ইউনিয়নে ভাস্কর্য নির্মাণ শেষে সেটা রক্ষা করার অবস্থায় দেশ এখন আর নেই। মৌলবাদের উল্লম্ফনে ক্ষতবিক্ষত দেশে খোদ আওয়ামী লীগের সমর্থকরাই যেখানে বিভ্রান্তির বেড়াজালে প্রবলভাবে কথিত অনুভূতিশীল সেখানে তাদের কেউ কেউ আবার রাতের আঁধারে হাতুড়ি চালাতে যাবে না সে নিশ্চয়তা কে দেবে? এরজন্যে দরকার ছিল যে আদর্শিক অনুশীলন আর দৃঢ়তা সে ধারাবাহিকতা রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে দল। তাই এখানে অতি-আবেগী না হয়ে বাস্তবতাকে মাথায় রেখে স্খলনের বিপরীতে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। সাংস্কৃতিক জাগরণের পথকে উন্মুক্ত করে দিয়ে সেখান দিয়ে গড়তে হবে আদর্শিক সৌধ।