অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বিটিভি নাটকে মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের বিজয়

কাজল রিপন, বিটিভি কনটেন্ট গবেষক

প্রকাশিত: ০৮:১১ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ সোমবার   আপডেট: ১০:৩১ এএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ বুধবার

১৯৮৩ স্বাধীনতা দিবসের নাটক - `জীবনের অপর পাতায়` আসাদুজ্জামান নুর, ডালিয়া রহমান ও নুর হোসেন দিলু,

১৯৮৩ স্বাধীনতা দিবসের নাটক - `জীবনের অপর পাতায়` আসাদুজ্জামান নুর, ডালিয়া রহমান ও নুর হোসেন দিলু,

ইতিহাসে আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা। সেই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের টিভিনাটকে এসেছে যুগে যুগে বিভিন্নভাবে। কখনো সরাসরি যুদ্ধের গল্প, কখনো বীরমুক্তিযোদ্ধা ও বীরঙ্গনাদের ত্যাগের কাহিনী, সশস্রবাহিনীর এ্যাকশন, কখনো আশা আকাংখার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, কখনো স্বপ্নের প্রতিফলন, কখনোবা শ্রদ্ধাভরে স্মৃতিচারণ হিসেবে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হওয়া প্রথম নাটকটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, নাম 'বাংলা আমার বাংলা'। ড. ইনামুল হকের লেখা সেই নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। ১৯৭২ সালে “জনতার কাছে আমি” নামে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আরেকটা নাটক বেশ আলোচিত হয়। আমজাদ হোসেন রচিত ও মুস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত সেই নাটকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল নাটকীয়ভাবে। ১৯৭৩ সালে নাজমা জেসমিন চৌধুরীর লেখা ও আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমামের প্রযোজনায় মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে তৈরী 'প্রতিদ্বন্দ্বী' নাটকটাও দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে টিভি নাটকে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে বহুবার বহুরূপে।

আশির দশকেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ টিভি নাটক আমরা দেখেছি তখন দেশের একমাত্র টেলিভিশন বিটিভিতে। মুক্তিযুদ্ধের নাটক, স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে অনেক নাটক নির্মিত হতে থাকে তখন। প্রতিকূল পরিবেশে নানা প্রতিবন্ধতা, কারগরি সীমাবদ্ধতা ও কড়া নীতিমালার মধ্যেও অসাধারণ কিছু কাজ করেছেন বিটিভির প্রযোজকরা। তাদের সেই সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতামাখা কাজগুলোই গৌরবোজ্জোল ইতিহাস বহন করছে।

প্রথমেই উল্লখ করতে হয় হৃদয়স্পর্শী ঘটনা ও সংলাপ সমৃদ্ধ নাটক 'নয়ন সন্মুখে তুমি নাই'র কথা। ১৯৮০ সালে প্রচারিত আল মনসুর রচিত ও মুস্তাফিজুর রহমান প্রযোজিত সেই নাটকের শুরুতে আহসান আলী সিডনী ও দিলশাদ খানমের পরিচয়, প্রণয় এবং তারপর পরিণয়ের পালা। ঠিক তখনই দেশে শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতা যুদ্ধ। বিয়ে হয়না, মেয়েটি বাসরঘরে বসে থাকে অনন্ত অপেক্ষায়। দেশমাতার ডাকে যুদ্ধে চলে যান সিডনী। অপারেশন চলাকালীন গ্রামে দিলশাদদের বাড়ীতে আশ্রয় নেয় একদল মুক্তিযোদ্ধা। আহসান আলী সিডনীকে চিনে ফেলেন দিলশাদ ও তার বাড়ীর লোকজন। সেই অবস্থায়ই বিয়ের আয়োজন ঘটে। বীর মুক্তিযোদ্ধা সিডনী তার নববিবাহিতা স্ত্রী দিলশাদ খানমকে বাসর রাতে কিছু বুলেট ছাড়া কিছুই উপহার দিতে পারেন না !!! সেই করুণ হৃদয় বিদারক দৃশ্য দর্শক ভোলেনি আজো।

মমতাজউদদীন আহমদ রচিত ও আবদুল্লাহ আল মামুন প্রযোজিত অবিস্মরণীয় নাটকের নাম 'একটি যুদ্ধ এবং অন্য একটি মেয়ে'। ১৯৮২ সালের বিজয় দিবসে প্রচারিত এ নাটকে গ্রামের মেয়ে চম্পার ভালোবাসার মানুষ আফজাল হোসেন স্বাধীনতার ডাকে যুদ্ধে যায়, কথা দিয়ে যায়, ফিরে এসে স্বাধীনদেশে চম্পাকে বউ করে ঘরে তুলবে। যুদ্ধের ময়দানে আফজালের সাথে পরিচয় ঘটে শিক্ষিত তরুণ আল মনসুরের। আফজাল তাকে স্বপ্নের কথা বলে। কোন এক অপারেশনে গুলিবিদ্ধ সহযোদ্ধাকে ফেলে চলে যেতে বাধ্য হয় মনসুর। যুদ্ধে শেষে সবাই ফিরে আসে বিজয়ী যোদ্ধার বেশে, কিন্তু আফজাল ফেরে না। চম্পা পথের পানে চেয়ে চোখের জল ফেলে। কুচক্রী রাজাকার হানিফ সংকেত চম্পাকে জোর করে বিয়ে করতে চায়। সেই দুঃসময়ে, আফজালের মৃত্যুর খবর নিয়ে আসে তার সহযোদ্ধা মনসুর। চম্পার কষ্টের সাথী হতে চায়। একসময় চম্পার মন গলে যায়। ওরা বিয়ে করে। নতুনবউ নিয়ে আল মনসুর বেড়াতে যায়। পথে দেখা হয় একজন খোঁড়া পাগলের সাথে। ছোট ছোট বাচ্চারা যাকে পেছন থেকে ঢিল ছুড়ছিলো। চম্পা ও আল মনসুর তাকে দেখে আৎকে ওঠে। যুদ্ধে পায়ে গুলি লেগেছিলো, আফজাল মরেনি...। বিয়োগান্ত করুণ পরিণতির মাধ্যমে নাটকটা মানুষের মনে গাঁথা হয়ে থাকে।

১৯৮৪ সালে মমতাজ উদ্দীন আহমেদের রচনা ও মোস্তফা কামাল সৈয়দের প্রযোজনায় 'এই সেই কণ্ঠস্বর' নাটকটাও সুধীমহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। এ নাটকে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রেম দুটো বিষয়কেই সমান্তরালভাবে তুলে ধরা হয়। টিভি মিডিয়ার সেরা জুটি আফজাল হোসেন ও সুবর্ণা মুস্তাফা এই নাটকে অসাধারন অভিনয় প্রতীভার স্বাক্ষর রাখেন।

মোর্শেদ চৌধুরীর রচিত ও বরকত উল্লাহর প্রযোজিত 'এরা ছিল এধারে' এ সময়ে উল্লিখিত আরও একটি স্বর্ণোজ্জল নাটক। যুদ্ধ চলাকালীন ভার্সিটি বন্ধ হয়ে যায়। ফরীদি ঢাকায় আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। এ বাসার বাচ্চা ছেলেটিকে গান শেখান ফরীদি – বিচারপতি তোমার বিচার করতে পারে আজ জেগেছে সেই জনতা। বাচ্চা মেয়েটিকে নাচ শেখান এবং একটা লালশাড়ি কিনে দেন। এ বাসায় ফরীদির কাজিন লুবনা আহমেদ তাকে মন থেকে পছন্দ করে। ধীরে ধীরে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন ফরীদি, গোপনে। গেরিলা যোদ্ধা ফরীদি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও তথ্য সরবরাহ করেন। একসময় আলবদরদের দোসররা তাকে সেই লালশড়িটা দিয়ে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। পরে তার লাশ পাওয়া যায় চোখ বাঁধা অবস্থায়। অত্যন্ত মর্মস্পরশী ঘটনা নিয়ে তৈরি সেই নাটকটা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে দর্শকমনে।

'সাত আসমানের সিঁড়ি' – ৭১ এর পটভূমিতে নির্মিত অদ্ভূত সুন্দর এবং দর্শকমনে চিরভাস্বর একটা নাটক। খ্যাতিমান নাট্যকার কাজী মাহমুদুর রহমানের লেখা এবং স্বনামধন্য প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমানের কালজয়ী সৃষ্টি। যুদ্ধে জয়লাভ করে আহত অবস্থায় ফিরে আসে সৎ সাহসী বীর মুক্তিসেনা হুমায়ুন ফরীদি। এরই মধ্যে তার পছন্দের মানসী সুবর্না মুস্তাফাকে জোরপূর্বক বিয়ে করে এবং সম্পতি ভোগদখল করে রাজাকার ভয়ংকর ভিলেনরূপী সৈয়দ আহসান আলী সিডনী। সাত আসমানের সিড়িতে দাঁড়িয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে রাজাকার। আর জীবন যুদ্ধে হেরে যায় একজন মুক্তিযোদ্ধা ফরীদি, পিঠে কুঁজ নিয়ে হেটে বেড়ায় শহরের পথে পথে।

৫২র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ১৯ বছরব্যাপী শাসন শোষণ অত্যাচার নির্যাতন আন্দোলনের বিশাল ক্যানভাসে নির্মিত মাইলফলক নাটকের নাম 'খোলা দুয়ার'। নাট্যপ্রাণ মামুনুর রশীদ রচিত এবং স্বনামধন্য নির্মাতা মুস্তাফিজুর রহমান প্রযোজিত সেই অনন্য সাধারন নাটক প্রচরিত হয় ১৯৮৩ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি। স্মরণীয় অভিনয় করেছিলেন সৈয়দ আহসান আলী সিডনী, চম্পা, রাইসুল ইসলাম আসাদ, আলেয়া ফেরদৌসী, মেহফুজ, শাহরে বানু, আবুল হায়াত প্রমুখ। নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুর করা কালজয়ী গান – 'সবকটা জানালা খুলে দাও না...' এই নাটকেই প্রথম শোনা যায়।

হাবিবুল হাসানের রচনা ও আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় “আমার দ্যাশের ল্যাগি’ নাটকটা দর্শকদেরকে মুগ্ধ করেছে ১৯৮৪র স্বাধীনতা দিবসে। বিশেষ করে আল মনসুরের প্রাণবন্ত অভিনয় ভোলার নয়। সেই নাটকে তার খুরধার সংলাপ আজো এক ইতিহাস – “দেশের জন্য আমি শহীদ হইয়া যাইবো, দেশের মাটির সাথে পানির সাথে মিশিয়া যাইবো”।

সৈয়দ শামসুল হক রচিত, আবদুল্লাহ আল মামুন নির্দেশিত ও মোস্তফা কামাল সৈয়দ প্রযোজিত থিয়েটার পরিবেশিত কালজয়ী নাটক 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' বিটিভিতে প্রদর্শিত হয় ১৯৮৩ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে, সেটা আজীবন ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।

কখনো রূপকভাবে মুক্তিযুদ্ধের আশা আকাংখা ও স্বপ্নের প্রতিফলন ঘটেছে নাটকে। ড. রাজীব হুমায়ুন রচিত ও খ ম হারূন প্রযোজিত তেমনি একটা কালজয়ী নাটক 'নীলপানিয়া'। এখানে সাইক্লোন রূপক অর্থে মুক্তিযুদ্ধকে বোঝানো হয়েছে। তৎকালীন সামরিক সরকারের আমলে এটা ছিলো একটা চ্যালেন্জিং নাটক। সন্ধীপের মানুষের জীবন সংগ্রাম, প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ নিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত এ নাটকে অভিনয় করেছিলেন – লাকি ইনাম, খালেদ খান, ড. ইনামুল হক, আতাউর রহমান প্রমুখ। নাটকটা দর্শকমহলে ব্যাপক আলোড়িত ও প্রশংসিত হয়েছিলো বিধায় বহুবার টিভিতে প্রদর্শিত হয়।

১৯৮৯ সালে জুবাইদা গুলশনারা রচিত এবং শেখ রিয়াজদ্দিন বাদশা প্রযোজিত 'সাগর সেচার সাধ' নাটকে যুদ্ধ ফেরত একজন নির্ভীক সৎসাহসী মুক্তিযোদ্ধর জীবন সংগ্রামের অসাধারণ চিত্র ফুটে উঠেছে।

জিয়া আনসারীর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি 'জীবনের অপর পাতায়'। একজন বীরঙ্গনার এমন করুণ মর্মস্পর্শী কাহিনী আর দেখিনি। মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। যুদ্ধের শেষ প্রান্তে, পাকবাহিনীয় ভয়াবহ তান্ডবলীলায় একটা গ্রাম ছারখার হয়ে যায়। গণহত্যা, চরম বর্বরতা, অগ্নিসংযোগ, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি শেষে রাজাকারদের সহযোগিতায় এক তরুনীকে তুলে নিয়ে যায় মিলিটারি ক্যাম্পে। ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে স্বাধীন দেশে মেয়েটি গ্রামে ফিরে আসে। কিন্তু হায়! সমাজ তাকে মেনে নেয় না। যার ইজ্জতের বিনিময়ে দেশের মানুষ স্বাধীনতার ফল ভোগ করছে, তার ঠাঁই নেই সমাজে। সেখানেও সে লাঞ্ছিত হয় দেশের মানুষের দ্বারা। সেই চরম দুঃসময়ে বজ্রপাতের মতন একটা দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। মেয়েটি অন্তঃসত্তা! নিরুপায় হয়ে অবশেষে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় মেয়েটি। সেই বীরঙ্গনার চরিত্রে তারানা হালিম যে অভূতপূর্ব অভিনয় করেছেন, সেটা ইতিহাস হয়ে থাকবে।

সুনির্মিত এবং প্রশংসিত আরেকটা নাটকের নাম 'স্বর্ণতোরণ'। ১৯৮৯ সালে প্রাচারিত কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত ও আতিকুল হক চৌধুরী প্রযোজিত সেই নাটকটা ছিলো গদবাঁধা গল্পের বাইরে। এখানে ঘটনা, আবহ, চরিত্রসমূহ ব্রিটিশ আমলের শেষভাগে, পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এক বৃদ্ধার অতীত ও বর্তমান সময়ের সকল জীবন যন্ত্রণা। তার স্বামী পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি ছিলেন বৃটিশ আমলে দারোগা, স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের হত্যাকারী, পাকিস্তান আমলের এস পি, সকল রাজনৈতিক আন্দোলন প্রতিহতকারী এবং '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিহানাদার বাহিনীর অন্যতম সহযোগী। নিজের বাড়ির গৃহকর্মীকে মুক্তিযুদ্ধে গোপণে অংশ গ্রহণের দায়ে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন, জীবনভর স্ত্রীকে মানসিক নির্যাতনের শিকারে পরিণত করেছিলেন। অথচ স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার অবদান ও আত্মত্যাগের বানোয়াট কাহিনী লিখে তিনিই হলেন পুরস্কৃত। এইসব নিয়ে তার স্ত্রীর মৌন প্রতিবাদ, আত্মত্যাগ ও স্বপ্নের অপমৃত্যু নিয়ে 'স্বর্ণতোরণ' নাটক। আমার চোখে সেই নাটক আজো এক বিস্ময়!

মাহবুব জামিল রচিত ও খ ম হারূন প্রযোজিত মর্মস্পর্শী ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছিলো নাটক 'হৃদয়ে যাতনা যখন'। পাকবাহিনীর হাতে বন্দী, মুক্তিযোদ্ধা স্বামীকে নির্যাতন থেকে বাঁচাতে তার স্ত্রী অবলীলায় নিজের সম্মানকে আত্মাহুতি দেয় হানাদার বাহিনীর মেজরের কাছে। দেশ স্বাধীন হবার পর স্বামী ফিরে আসে কিন্তু স্ত্রী ততক্ষণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সে। সেই বীরঙ্গনা নারী চরিত্রে তারানা হালিম যে অভূতপূর্ব অভিনয় করেছেন, তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

মাহবুব জামিল রচিত ও খ ম হারূন প্রযোজিত আরেকটা নাটকের কথা মনে পড়ে, নাম 'অচেনা বন্দর'। ১৯৯১ সালের বিজয়দিবসে প্রচারিত সেই নাটকে একজন প্রকৌশলীর যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং ফিরে এসে স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়ে নিঃস্ব জীবন যিপনের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। 'স্মৃতি বর্তমান' নামে শহীদ বুদ্ধিজীবি পরিবারের ভিন্ন ভিন্ন কাহিনী যোগ করে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধারার একটা বিশেষ নাটক উপহার দিয়েছিলেন খ ম হারূন। যেটা আজো করুণ স্মৃতি বহন করে।

১৯৮৫ সলে বেগম মমতাজ হোসেন রচিত ও খ ম হারূন প্রযোজিত মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত প্রথম সিরিজ নাটক 'শুকতারা' ছিলো বৈরীপরিবেশে এক দুঃসাহসিক অভিযান। সিরিজ নাটকে সেই প্রথম রাজাকার রূপে ড. ইনামুল হকের চরিত্র, তার কুকর্ম, তার প্রতি জনতার ধিক্কার! সেই সময়ে সত্যি অকল্পনীয়! নাটকে এমন সব সত্য বিষয় ছিলো যা সে সময়ে উচ্চারণ করা যেতো না। ঐ ধারাবাহিকটির কারনে প্রযোজকের চাকরি পর্যন্ত হুমকির সন্মুখীন হয়েছিলো কিন্তু সততা, আন্তরিকতা এবং কিছু সৎলোকের সহযোগিতায় নাটকটি চুড়ান্ত পরিণতি পায়। অথচ তারও অনেকদিন পর, ১৯৮৮ সালে হুমায়ুন আহমেদ রচিত ও নওয়াজীশ আলী খান প্রযোজিত 'বহুব্রীহি' নাটকে ‘রাজাকার’ শব্দটা ময়নাপাখির মুখে বলানো হয়েছে, মানুষের মুখে বলার সাহস পায়নি।

৯০ দশকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরওকিছু ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হয়। যেমন সাইফুল বারীর লেখা ও জিয়া আনসারীর প্রযোজনায় 'জোনাকী জ্বলে' এবং আমজাদ হোসেনের লেখা ও জিয়া আনসারীর প্রযোজনায় 'উঠোন' এবং 'জন্মভূমি'। এর মধ্যে “উঠোন” অসমাপ্ত থকে যায়।

১৯৮৯ সালে আহমেদ মুসা রচিত ও আতিকুল হক চৌধুরী প্রযোজিত মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পটভূমিতে রচিত একটা মাইলফলক নাটকের নাম 'চানমিয়ার নেগেটিভ পজিটিভ'। নামভূমিকায় হুমায়ুন ফরীদি, চরিত্র ছিল এক ছিচঁকে চোরের, যে নানা কারণে চুরি ছেড়ে দিলেও কাউকে তা বিশ্বাস করাতে পারছিল না, “কালো খাতা” থেকে নাম কাটাতে পারছিল না। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা চানমিয়াকে ধরে চরম শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চানমিয়া অনেক বলে-কয়ে আত্মরক্ষা পাওয়ার পর জীবন দেশের কাজে উৎসর্গের সিদ্ধান্ত নেয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে চানমিয়া। অপারেশন থেকে ফেরার পথে নৌকা ডুবে গেলেও সে একাই তার লিডারকে কাঁধে নিয়ে সাতরে নদী পার হয়। যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধে করে, স্বাধীন দেশে সে সুস্থ জীবন ফিরে পায়নি। বড় চোরেরা তখন গিলে খাচ্ছে ছোট চোরদের – বড়মাছের যেমন খেয়ে ফেলে ছোট মাছগুলোকে।

৯০'র দশকের সামান্যকিছু আগে পরে আরো কিছু মানসম্পন্ন মুক্তিযুদ্ধের নাটক প্রচারিত হয়। যেমন 'শীতের পাখি' মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় নিয়ে লেখা অন্যতম সেরা টিভি নাটক। আখতার ফেরদৌস রানা রচিত ও আলীমুজ্জামান প্রযোজিত এ নাটকের সেরা সম্পদ ভিন্নধরনের গল্প, সমৃদ্ধ সংলাপ সর্বোপরি হুমায়ূন ফরীদির অভিনয়। নাটকে আরও ছিলেন গোলাম মুস্তাফা, ফেরদৌসি মজুমদার, খালেদ খান এবং শম্পা রেজা। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারা এক ব্যার্থ তরুণের ভেতরে জমে থাকা কষ্টের অসধারন বহিঃপ্রকাশ ঘটান হুমায়ুন ফরীদি। যারা একবার দেখেছেন সেই নাটক, কখনো ভুলতে পারবেন না।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত আখতার ফেরদৌস রানার লেখা নাটকগুলো ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। যেমন 'শীতের পাখি', 'জীবন ঘষে আগুন', 'আমি শিমুলের কাছে', 'একটি নীল জামা', 'বিহঙ্গ', 'হরফ', 'বাঙলা', 'চোর না ডাকাত' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

২১ নভেম্বর ১৯৮৮ সালে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে বিটিভি আয়োজিত বিশেষ অনুষ্ঠানে মেজর আখতার ফেরদৌস রানা রচিত এবং শেখ রিয়াজউদ্দীন বাদশার প্রযোজিত নাটক 'দিন বদলের দিন' নাটকটাও স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর ভিত্তি করে এমন বস্তুনিষ্ঠি এবং বৈচিত্র্যময় গল্পের অবতারনা খুব বেশি হয়নি। দেশের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার বীরদর্পে শহীদ হওয়ার মর্মস্পর্শী কাহিনী, একাত্তরের সেইদিনগুলোর দুঃসহ স্মৃতি জীবন্ত করে তুলেছে। অভিনয়ে ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি, ডালিয়া রহমান, রওশন জামিল প্রমুখ।

বিটিভিতে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধের নাটকের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য কিছু নাম যুগে যুগে স্মরণীয়। যেমন কাজী মাহমুদুর রহমান রচিত ও শেখ রিয়াজউদ্দিন বাদশা প্রযোজিত নাটক 'সন্ধান', আবদুল্লাহ আল মামুন রচিত ও প্রযোজিত 'আয়নায় বন্ধুর মুখ'. মামুনুর রশীদ রচিত ও আবদুল্লাহ আল মামুন প্রযোজিত 'আদম সুরত' আজিজ মিসির রচিত ও জিয়া আনসারী প্রযোজিত সিরিজ 'কোনো এক কুলসুম', আতিকুল হক চৌধুরী রচিত ও প্রযোজিত 'কম্পাস', 'পটভূমি পরিচিতি', 'নীল নকশার সন্ধনে', সেলিনা হোসেন রচিত ও জিয়া আনসারী প্রযোজিত 'যাপিত জীবন', আরেফিন বাদল রচিত ও আলী ইমাম প্রযোজিত 'ঐ আসে আমীর আলী', মামুনুর রশীদ রচিত ও মুস্তাফিজুর রহমান প্রযোজিত 'ধল প্রহর', সেলিনা হোসেনের 'মীর আজিমের দূর্দিন', আহমেদ ইউসুফ সাবেরের 'ঘরের চাবি', মইনুল আহসান সাবেরের 'কবেজ লেঠেল', রাবেয়া খাতুনের 'বাগানের নাম মালনীছড়া', খ ম হারূনের 'ভয়ংকর সুন্দরদিন', সেলিনা হোসেনের 'আত্মাহুতির পালা' এবং রাজিয়া মজিদের 'জোৎস্নায় শূন্য মাঠ'সহ আরো অনেক। এছাড়াও বহুনাটকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রভাব পড়েছে পরোক্ষভাবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের নাটককে সমৃদ্ধ করেছে। এর উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছে মাটি আর মানুষের গন্ধমাখা কাহিনীচিত্র। বহুবছর পার হয়ে গেছে কিন্তু সেইসব স্বর্ণালী নাটকের আবেশ আজও দর্শকদের মনে দেদ্বীপ্যমান। সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি সেই অনন্যসাধারন অনুষ্ঠান তৈরির দক্ষ্য কারিগর চিরসবুজ টিভি প্রযোজক, মেধাবী রচয়িতা, ক্যামেরার সামনে ও পেছনের সকল কলাকুশলীদের।