১২ বছরের ছেলেটির সামনে দিয়ে বাবা সেই যে বেরিয়ে গেলেন আর ফেরেননি!
ইকবাল হাসান, কবি ও কথাসাহিত্যিক
প্রকাশিত: ০৫:৫৫ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ রোববার আপডেট: ০৪:২৬ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ সোমবার
দরোজা খুলে বেরুতেই দেখি, বাইরে তুমুল বৃষ্টি। টরন্টোর আবহাওয়া খুবই অস্থির চিত্তের। ছিল মেঘলা দিন, বৃষ্টির উল্লেখ ছিল না, তবু সেই সন্ধ্যা থেকে অঝোর ধারা। সঙ্গে প্রচণ্ড বাতাস, ছোটখাট ঘূর্ণিঝড় যেন। প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাবার মতো। মনে হয় না থামবে সহসা। বাতাস ও বৃষ্টি মিলে রাতের শুরুতেই যে এলোমেলো একটা অবস্থা, তার ভেতর বের হবো কি হবো না- ভাবতে না ভাবতেই দেখলাম সৈয়দ ইকবাল, আমার দীর্ঘদিনের (প্রায় ৩৫ বছরের) বন্ধু, গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে অনেকটা নির্দেশের স্বরে বলল, ‘ফলো মি’।
আমরা দু’জনেই ইকবাল, তবে ওর নামের প্রথম বর্ণত্রয় আভিজাত্যময় ‘সৈয়দ’ এবং আমার নামের শেষের সাদামাটা আভিজাত্যহীন ‘হাসান’। এই দুই শব্দ আমাদের দু’জনকে দু’জন থেকে আলাদা করলেও মনের দিক থেকে আমরা এখনো নানা মিল-অমিল সমেত একে অপরের বেশ কাছাকাছি। থাকি এক শহরে। সৈয়দ ইকবাল সুপরিচিত চিত্রকর, গল্পকার ও উপন্যাসিক। সম্প্রতি ওর ১২তম একক চিত্র প্রদর্শনী হ’য়ে গেল টরন্টোতে। আর প্রদর্শনীর সাফল্য, বিক্রয় ইত্যাদি মিলিয়ে হাই গিয়ারে থাকা আমার বন্ধুটির কাছে এই ঝড়-বৃষ্টি যেন কোন ব্যাপারই নয়, পুনরায় ফলো করার কথা বললে আমি আমার গাড়িতে উঠে বসি।
সেটা ২০০৯’র মে। আগে থেকেই ঠিক ছিল, আড্ডা হবে মিশুক ও মঞ্জুলির বাসায়, ওদের অ্যাপার্টমেন্টে। চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের এক ঘন্টার ডক্যুমেন্টারি ‘মুক্তির কথা’ ও ১৫ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ ছবি ‘নরসুন্দর’-এর প্রদর্শণী টরন্টোতে কিভাবে আয়োজন করা যায় তা নিয়েও কথা হবে আড্ডায়।
ইকবালকে ফলো করে যখন মিশুকদের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে দাঁড়ালাম, দূর্বিনীত বাতাস ও বৃষ্টির দাপট একটুও কমেনি, বরং লাগামহীন রাগী ষাঁড়ের মতো তাড়া করলে আমাদের অবস্থা তখন বৃষ্টি ভেজা কাকের মতো।
মিশুক-মঞ্জুলি দম্পতির সঙ্গে দেখা হ’ল বহুদিন পর। আগে আমরা যখন কাছাকাছি ছিলাম, বারদুই ওঁদের ওখানে গিয়েছি। তারপর দেখা হয়নি দীর্ঘদিন। ব্যস্ত মানুষ মিশুক মুনীর, কখনো ওয়াশিংটন, কখনো কান্দাহার, কখনো ঢাকা। এবারের টরন্টো আসা কয়েক সপ্তাহের জন্যে মাত্র।
খুবই সজ্জন এই দম্পতি, আসা মাত্র আর্জেন্টিনার ‘মাইস্ত্রো’ (রেড ওয়াইন) আর ঢাকার ‘স্পেশাল চানাচুর’ এলো টেবিলে। আমরা গোল হ’য়ে বসলাম ফ্লোরে। অতল, খোকন, সৈয়দ ইকবাল, মঞ্জুলি, মিশুক ও আমি। অতল বিশিষ্ট্য শিল্পী মুকতাদির সাহেবের ছেলে, মিশুকের কাজিন, পড়াশুনা করছে কমপিউটার ইনজিনিয়ারিংয়ে।খোকন বাংলাদেশের সর্ট ফিল্মের অন্যতম উদ্দ্যোক্তা, বিভিন্ন ফিল্ম ফেষ্টিবল ও সুস্থ চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মঞ্জুলি মিশুকের স্ত্রী, টরন্টোতে নানা ধরনের অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। আর মিশুক মুনীর মুলত নিউজ মিডিয়ার লোক, হ’লেও বেশ কিছু স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ ছবিতে কাজ করেছেন। নিউজ ও ডক্যুমেন্টারি ক্যামেরাম্যান হিসেবে এর আগে কাজ করেছেন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, এআরডি১, ফক্স ও স্টার টিভিতে। একুশে টিভির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শুরু থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন প্রায় দশ বছর, ব্রডকাস্ট জার্নালিজম পড়াতেন। এখন কাজ করছেন ওয়েভ নির্ভর নিউজ মিডিয়া রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্কে। সম্পূর্ন এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট এই নিউজ নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা দু’বার জেমিনাই এ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত কেনেডিয়ান ডক্যুমেন্টারি ফিল্ম মেকার পল জে’।
উল্লেখ্য, কেনেডিয়ান ব্রডকাষ্টিং করপোরেশন সিবিসি’র জনপ্রিয় বিতর্ক অনুষ্ঠান ‘কাউন্টার স্পিনে’র তিনি ছিলেন এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার। সিবিসির ডক্যুমেন্টারি ‘রিটার্ন টু কান্দাহার’ এ মার্টিন ডাকওয়ার্থের সঙ্গে ক্যামেরার কাজ করার সময় মিশুকের পরিচয় হয় পল জে’র সঙ্গে। সেই পরিচয় সূত্রে মিশুক এখন রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্কে। ‘রিটার্ন টু কান্দাহার’ এ মিশুক ক্যামেরার পাশাপাশি লোকেশন সাউন্ডেও কাজ করেছেন। এর আগে চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’ ও ‘নরসুন্দর’ নামে যে ছবি দু’টির কথা বল্লাম- দু’টোরই ক্যামেরার কাজ মিশুক মুনীরের। এছাড়া তারেকের মুক্তি প্রতীক্ষিত পূর্ণ দৈর্ঘ ছায়াছবি ‘রানওয়ে’র ক্যামেরাম্যানের কাজও করেছেন তিনি।
টিভি ক্যামেরাম্যান মিশুক লেন্সের ভিতর পথ দিয়ে চতুষ্কোন ফ্রেমের মধ্যে তুলে নিয়ে আসেন জীবন। সে জীবন কখনো ঘন কুয়াশায় ঢাকা, কখনো অমাবস্যার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন, কখনো আলোময় শরতের শুভ্র একখন্ড- উদাস আকাশ যেন। কখনো বোমা বারুদ আর ধোঁয়ায় একাকার। নিউজ মিডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে তার মনে এই ধারনা বদ্ধমুল হয়েছে যে, সেলুলয়েডের ফিতেয় ধরা জীবন মোটেই নয়। প্রায়শ হিংস্র, নিষ্ঠুর ও বেদনার চালচিত্র। কোনো কোনো ঘটনা যেন বিস্ময়ের মতো। মনে হয়, এ কী তুলে নিয়ে এলাম!
আড্ডার এক পর্যায় কথা উঠলো, সাংবাদিকরা সর্ম্পূণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে কিনা। মিশুকের মতে, সম্ভব। একজন সাংবাদিক ইচ্ছে করলে এমবেডেড সাংবাদিক হিসেবে যেমন কাজ করতে পারেন, ঠিক তেমনি আবার স্বাধীনভাবে কাজ করাও তার জন্যে কঠিন কিছু নয়। তবে সিদ্ধান্তটি সব সময় সাংবাদিকের উপর নির্ভর করে না বরং নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের উপর যে প্রতিষ্ঠানের জন্যে তিনি কাজ করছেন। ইরাক যুদ্ধের সময় বিষয়টি বেশ পরিষ্কার হ’য়ে গেছে বিশ্ববাসীর সামনে। বিশেষ করে সিএনএন, এবিসি, এনবিসি, সিবিএস ও ফক্স নেটওয়ার্কের এমবেডেড সাংবাদিকরা মার্কিন সেনাদের সংগে থেকে ইরাক যুদ্ধের যে চিত্রটি তুলে ধরেছেন তা শুধু একতরফাই নয়, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে রীতিমত ‘শেমলেস অ্যাক্ট’। কারন, তারা যুদ্ধের ভয়াবহতা ও সত্যিকার চিত্রটি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন।
প্রসঙ্গত বলা যায়, আমাদের দেশের অবস্থাটা একটু ভিন্ন প্রকৃতির, আমাদের দেশে সংবাদপত্র কখনো স্বাধীন ছিল না। এখনো নয়। খোলা চোখে দেখা না গেলেও অদৃশ্য সেন্সরশিপ আগেও যেমন ছিল এখনো তেমনি আছে। দেশে গণতন্ত্রহীনতার সুযোগ নিয়ে, এমনও অনেক সময় গেছে যখন বিশেষ একটি গোয়েন্দাসংস্থার দায়িত্ব হ’য়ে পড়েছে কালকের কাগজে কোন সংবাদটি যাবে আর কোন সংবাদটি যাবে না তা নিশ্চিত করার। স্বাধীন দেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এ ধরনের অসভ্যতা মেনে নিয়েই আমাদের দেশের সাংবাদিকদের কাজ করতে হয়। অবশ্য মাঝেমধ্যেই আমরা প্রত্যক্ষ করি, ঘন কালো মেঘের ভিতর সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার হিরন্ময় বিদ্যুৎ ঝিলিক।
আমরা যখন যুদ্ধ, এমবেডেড সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলছি, তখন টেবলের ওপাশে মজ্ঞুলি সৈয়দ ইকবাল, অতল, খোকনের সঙ্গে ইতোমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছে কবে কখন কোথায় তারেক মাসুদের ছবি দু’টি দেখানো হবে। স্থান ঠিক হ’ল, রায়ারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তন। জুনের ২০, শনিবার। দুপুর দুটোয়। প্রদর্শণীর শুরুতে ছবি দু’টো নিয়ে দু’চার লাইন কথাবার্তা বলার জন্যে এমন একজনকে খুঁজে বের করতে হবে যার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সম্পৃক্ততা রয়েছে । শুনেই আমি লেখক, সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও অনুবাদক আফসান চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করলে সবাই রাজি হয়। ঠিক হয়, দ্বিতীয় প্রদর্শণীর উপস্থাপক হবেন সৈয়দ ইকবাল।
ভেতরে আমরা যখন সাংবাদিকতা, প্রদর্শণী, মাইস্ত্রো নিয়ে ডুবে আছি বাইরে তখন প্রচন্ড- ঝড়বৃষ্টি, মাতাল প্রকৃতির উদ্দামতা। মজ্ঞুলি বললেন, আমরা লেক অন্টারিও’র খুব কাছে থাকি বলেই ঝড়বৃষ্টির সময় এমন হয়।
মিশুক মুনির শহীদ বুুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর সন্তান।
খুব দ্বিধায় ছিলাম, ১৪ ডিসেম্বরের সেই ভয়াবহ নিষ্ঠুর বেদনাদায়ক দুপুরের কথা আজকের এই আড্ডায় তোলা ঠিক হবে কিনা। দ্বিধা কেটে গেল মিশুুক নিজেই যখন বাবার সঙ্গে রকেট স্টিমারে বরিশাল যাবার কথা উঠালো। বাবার একটা বক্তৃতা ছিল বি.এম কলেজে। অই প্রথম আমার রকেট স্টিমার ও কির্তণখোলা দেখা। বাবার কাছে সবাই যা পায় আমি তা পাইনি। কারণ আমি খুব ছোট ছিলাম।
ভ্রমণ-প্রিয় মিশুকের মধ্যে ভ্রমণের নেশা সঞ্চারিত হয়েছিল অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাবার ফলে।
’কিছু না পেলেও যেটুকু পেয়েছিলাম তাইবা কম কিসে! আমি ছোট ছিলাম বলে হয়তো বাবা যেখানেই যেতেন আমাকে সঙ্গে নিতেন।’
’বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে কিংবা সাহিত্য সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য তিনি যখন বাইরে যেতেন সঙ্গী হতাম আমি। ওই থেকে আমার মধ্যে ভ্রমণের নেশা ও মানুষের প্রতি একটা আগ্রহ তৈরি হয়। সেই ছোটবেলায় বাবা আমাকে প্রথম ব্রহ্মপুত্র দেখান, বলতেই থাকেন মিশুক মুনির। একটি ভ্রমণের গল্পও শোনালেন।
”আমার আজো মনে আছে, একবার হরলাল রায়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ট্রেনে করে। রাতে বাবাকে ঘিরে বসলো গানের আসর। আর আমি গান শুনতে শুনতে সতরঞ্জির উপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কাছাকাছি আর একটা বনেদি বাড়ি ছিল, পরদিন সন্ধ্যায় একা একা গিয়েছিলাম, ওই বাড়িতে অদ্ভুত একটা সিঁড়ি ছিল প্যাঁচানো, ভৌতিক। অন্ধকারে, ঘোরের মতো ওই সিঁড়ি দিয়ে শুধুই নিচের দিকে নেমে যাওয়া..., কী যে ভয় পেয়েছিলাম সেদিন!
...আমার দাদা ছিলেন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট, হ্যান্ডসাম, সুফি টাইপের কঠিন মানুষ। খুবই ধর্ম পরায়ন, মিশুক মুনিরের গল্প শেষ হয় না। বললেন, কমিউনিষ্ট পার্টি করার কারণে আমার বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন দাদা। দীর্ঘদিন পর তাঁদের মধ্যে হালকা পাতলা সম্পর্ক তৈরি হ’লে বাবা সেন্ট্রাল রোডে দাদার বাসায় যাতায়াত শুরু করেন। মনে পড়ে, আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে থাকতাম ৬৮/৬৯ সালের দিকে। বাবা নতুন গাড়ি কিনেছেন, টয়োটা, ঢাকা-গ ৯৩৯। প্রতি শুক্রবার দাদার বাসায় যেতেন বাবা, দাদাকে নিয়ে আসতেন পরীবাগ মসজিদে। বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করতাম বাবা আর আমি। দাদা জুম্মার নামাজ পড়ে ফিরে এলে তাঁকে বাবা পৌঁছে দিতেন সেন্ট্রাল রোডে। আমরা দাদাকে হারাই ৭০-এ আর বাবাকে ৭১-এ।
- আর আপনার মা?
মা এখনো বেঁচে আছেন। আমাদের তিন ভাইকে নিয়ে মা কঠিন স্ট্রাগল করেছেন সারজীবন, আমরা তিন ভাই তিন ক্যারেকটার নিয়ে বড় হয়েছি। আর আমাদের এই বেড়ে ওঠার পেছনে মা ছাড়া অন্য কারো কোনো অবদান নেই, কখনো ছিল না। ৭১’এর পরের দু’তিনটি বছর মা প্রায় বিধ্বস্ত ছিলেন। সারা পৃথিবীর উপর রাগ ও ক্ষোভ ছিল তাঁর।
এক পর্যায় মিশুককে বললাম, একদিক থেকে আপনি কিন্তু খুব ভাগ্যবান। আপনি শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তান। স্মিত হেসে মিশুক বললেন, বটগাছের নীচে যেমন চারাগাছ বড় হ’তে পারে না আমার অবস্থা অনেকটা সেরকম। আমি মুনীর চৌধুরীর ছেলে হিসেবেই বড় হ’য়েছি। আর এজন্যে বিড়ম্বনাও সহ্য করতে হ’য়েছে অনেক। একটু উল্টাপাল্টা জীবন যাপন করলেই সবাই বলেন, ছিঃ মিশুক, তোমার কাছে তো এটা আশা করিনি। তুমি না মুনীর চৌধুরীর ছেলে! আর যখন ভালো কিছু করে ফেলি, তখন সবাই বলে দেখতে হবে না কার ছেলে!
ঠিক এসময় মিশুককে প্রশ্নটি করলাম আমি। যেদিন আপনার বাবাকে ওরা আপনার সামনে থেকে ধরে নিয়ে যায়...
আমাকে থামিয়ে দিয়ে, যেন তিনি জানতেন এই অবধারিত প্রশ্নটির কথা, মিশুক বললেন, ১৪ ডিসেম্বরের মধ্য দুপুর। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার ছেড়ে সেন্ট্রাল রোডে দাদীর বাসায়, আমার বয়স তখন ১২, ক্লাস সেভেনে পড়ি। বেলা সাড়ে বারোটার দিকে একটি বাস ও একটি জিপ তালাবন্ধ গেটের বাইরে এসে দাঁড়ায়। বাসটির সব ক’টি গ্লাস কাগজ দিয়ে মোড়ানো। শমসের চাচা ও আমি বাসার সামনে। একটি ছেলে জিপ থেকে নেমে এসে বিনীত স্বরে জানতে চাইলো, স্যার বাসায় আছেন কিনা। শমসের চাচা জানতে চাইলেন, কোন স্যার?
ছেলেটি বল্লো, মুনীর স্যার। স্যারের সঙ্গে একটু কথা বলবো।
শমসের চাচা বাবাকে ডাকলেন। বাবা জাস্ট গোসল শেষ করে বেরিয়েছেন, খেতে বসবেন।
লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে বাবা নেমে এলেন না খেয়ে।
ছেলেটি বললো, স্যার একটু আসেন। আমাদের স্যার আপনার সঙ্গে একটু কথা বলবে।
শমসের চাচা আর আমার সামনে দিয়ে ছেলেটির সঙ্গে সেই যে বাবা চলে গেলেন আর কোনোদিন ফিরে এলেন না। চিরদিনের মতো এইভাবে হারিয়ে গেলেন আমাদের বাবা।
শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মৃতদেহ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি, রায়ের বাজার ও মিরপুর বদ্ধভূমিতেও নয়। যে মানুষ একদা ‘কবর’ এর মতো অসাধারণ নাটক লিখেছিলেন, আজ বাংলাদেশের ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রতি ইঞ্চি জমি তন্নতন্ন করে খুঁড়ে দেখলে মুনীর চৌধুরীকে পাওয়া যাবে না। পৈশাচিক, হিংস্র আল-বদর, আল শামস মুসলিম নামধারী নিষ্ঠুর দানবরা তাঁকে এভাবেই নিশ্চিহ্ন করেছেন।
গভীর রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে আমি ভাবি সেই নিষ্ঠুরতার কথা। ‘স্যার বাসায় আছেন’?
বৃষ্টি ও বাতাসের বেগ কমেনি এতটুকু, গাড়ির ভেতর হালকা ভাবে বেজে যাচ্ছে ফজলুর রহমান বাবু ও কৃষ্ণকলির গান। এই বৃষ্টি বাতাস গান আর মুনীর স্যারের চলে যাওয়া সব কিছু মিলিয়ে যেন ভারী হ’য়ে এলো চোখের পাতা। হঠাৎ বহুদিন পর মনে পড়ে গেল, সৈয়দ শামসুল হকের ‘অন্তর্গত’ উপন্যাসের অসাধারন পংতির কথা, চোখ ভিজে যায়, চোখ ভেসে যায় জলে।