মৈমনসিংহ গীতিকার শতবছর
চাঁন মহুয়ার কিসসা: গীতিকাপালার মঞ্চভাস্য
ড. ইসলাম শফিক
প্রকাশিত: ১২:২০ পিএম, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩ শনিবার আপডেট: ১২:২৬ পিএম, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩ শনিবার
বাংলার মানুষের সাহিত্যের অন্যতম গৌরবের সম্পদ মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের শতবছর পূর্ণ হলো ২৪ নভেম্বর ২০২৩। মৈমনসিংহ গীতিকার শতবছর উদযাপন উপলক্ষ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ সম্প্রতি মঞ্চে এনেছে মৈমনসিংহ গীতিকা পালার গল্প অবলম্বনে নাট্যপ্রযোজনা ‘চাঁন মহুয়ার কিসসা’। ময়মনসিংহ অঞ্চলের শত শত বছর ধরে পরিবাহিত ‘মহুয়া’র কাহিনি অবলম্বনে নাট্যনির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক নির্দেশনা দিয়েছেন এই নাটকের। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে ০৫ ও ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় মঞ্চস্থ হয় ‘চাঁন মহুয়ার কিসসা’।
বেদের মেয়ে ও জমিদারের অমর প্রেমাখ্যানের দীনেশ চন্দ্র সেন ও চন্দ্র কুমার দে’র মৈমনসিংহ গীতিকা পালায় এই গল্প ‘মহুয়া পালা’ নামে সর্বজন পরিচিত। তবে পাঠভেদে এই কাহিনির বিভিন্ন ভার্সন পাওয়া যায়।পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য ও মোহাম্মদ সাইদুর প্রমুখের সংগ্রহ থেকে পাওয়া যায়- ‘বাইদ্যানীর গান’, ‘বাদ্যানীর গান’, ‘নদ্যার ঠাকুর ও বাদ্যাছেঁড়ি। তিনটি পাণ্ডুলিপির মিথস্ক্রিয়ায় একবিংশ শতকের নগরকেন্দ্রীক দর্শকমানস বিবেচনায় কাহিনির সমন্বিত মঞ্চরূপ দিয়েছেন নাট্যনির্দেশক। ডাকাত সর্দার বেদে- হুমরা বাইদ্যা। ১৬ বছর আগে ধনু নদীর পাড়ের কাঞ্চনপুর গ্রামের এক ব্রাহ্মণের ছয় মাসের কন্যাকে চুরি করে আনে সে। তাকে লালন-পালন করে বড় করে, বিভিন্ন কসরত শেখায় আর খেলা দেখিয়ে বেড়ায়। সে কন্যার বয়স এখন ১৬। অপরূপ সুন্দরী মহুয়া। বেদে দল যাযাবর জাতি। একবার বামনকান্দা গ্রামের ব্রাহ্মণ নদ্যার চান ঠাকুরের বাড়িতে খেলা দেখাতে যায় বাপ-বেটি। মহুয়ার কসরত দেখে সবাই মুগ্ধ হয়। মহুয়ার কসরত ও রূপে মুগ্ধ হয়ে নদ্যার ঠাকুর বেদে দলকে উলুইয়াকান্দা নামক স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেন।এক সন্ধ্যাবেলা জলের ঘাটে নদের চাঁদ ঠাকুরের সঙ্গে মহুয়ার মন দেয়া-নেয়া হয়। কিন্তু সমাজ বাস্তবতার নিরিখে শ্রেণিভেদ ও অসম অবস্থানের প্রেম নিয়ে হুমরা বাইদ্যার মনে জেগে ওঠে ভয় আর শঙ্কা। পরিস্থিতি এড়াতে সে গভীর রাতে মহুয়াকে আর দলবল নিয়ে পালিয়ে যায়। অকস্মাৎ মহুয়াকে হারিয়ে মহুয়ার বিরহে চাঁদ ঠাকুরের পাগলপ্রায় দশা। তীর্থের নামে সে বেরিয়ে পড়ে মহুয়ার খোঁজে। বহু দেশ ঘুরে অবশেষে কংসাই নদীর পাড়ে মহুয়ার সন্ধান পান তিনি। হুমরা বাইদ্যার এবার মহুয়ার হাতে তুলে দেয় বিশলক্ষের ছুরি। মহুয়ার নিখাদ প্রেম পিতার আদেশ পালনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সে হত্যা করতে পারে না চাঁদকে। তারা পালিয়ে যায়। পথে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী পার হয়ে তারা ওঠে সওদাগরের এক নৌকায়। কিন্তু সেখানে আরেক বিপদ। মহুয়ার রূপে মুগ্ধ হয়ে সওদাগর চাঁদকে নদীতে ফেলে দেয়। উপায়ান্তর না দেখে মহুয়া সওদাগরের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার ভান করে। তার কাছে থাকা পাহাড়ি তক্ষকের বিষ মিশিয়ে পান বানিয়ে খাওয়ায় ডিঙ্গার সবাইকে। সবাই অজ্ঞান হয়ে পড়লে পালিয়ে যায় সে। বাঘ, ভালুক, দৈত্য-দানবকে ভয় না করে সে খুঁজে বের করে মৃতপ্রায় চাঁদকে। এক সন্ন্যাসীর সাহায্যে মহুয়া চাঁদকে সুস্থ করে তোলেন। এভাবে ছয় মাস অতিবাহিত হয় তাদের। বনেই দিননিপাত করতে থাকেন তারা। একদিন সে বনেই হাজির হয় হুমরা বাইদ্যার দল। মহুয়ার হাতে বিষলক্ষার ছুরি তুলে দেয় হুমরা বাইদ্যা। চাঁদকে মারার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন তিনি। অসহায় মহুয়া সে ছুরি নিজের বুকেই বসিয়ে আত্মহহন করে, প্রাণপ্রিয় প্রেয়সী মহুয়ার আত্মবিসর্জনে চাঁদ তীব্র মনোকষ্টে বিষলক্ষার ছুরি নিজ হাতে তুলে নিয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়ে মহুয়ার সাথে অন্তিমকালের সহযাত্রী হয়। বিরহের ভেতরেই মিলন ঘটে দুই হতভাগ্য প্রেমিক-প্রেমিকার। এই ট্র্যাজিক লোকগল্প বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রেমকথা। যুগে যুগে মানুষের মনেপ্রাণে মিশে আছে সংস্কৃতির অংশ হয়ে।
‘চাঁন মহুয়ার কিসসা’ নামকরণ থেকেই আভাস পাওয়া যায় যে প্রযোজনাটির কিসসা বা পালানির্ভর। নির্দেশন অধ্যাপক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতির একজন গবেষক, তাত্ত্বিক ও একাধারে মঞ্চের একজন প্রায়োগিক শিল্পী। প্রযোজনাটি কিসসা কথন বা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী গল্পবলার ধরণকে ভিত্তিমূলে রেখে গীতল সংলাপ, বর্ণনা, সঙ্গীত, কোরিওগ্রাফ ও নৃত্য সহযোগে মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন চাঁন-মহুয়ার প্রেমবয়ান। ‘চাঁন মহুয়ার কিসসা’ এই মঞ্চভ্রমণ একটি সুর ও তালে গ্রন্থিত। নাট্যপরিবেশনার সাথে যুক্ত কলাকুশলীবৃন্দ নিপুণ দক্ষতায় সেই সুর ও তালকে অক্ষুণ্ন রেখে মঞ্চে বিচরণ করছেন অভিনয়শিল্পারা। গবেষক ও নাট্যনির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক এই অভিনয়রীতিকে ‘গাহনাভিনয়’ নাট্যপরিভাষায় ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন। অভিনয়রীতির এই আঙ্গিকটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যের প্রেরণালব্ধ আধুনিক বর্ণনাত্মক নাট্যাঙ্গিক। ‘গাহনাভিনয়’-এ চরিত্রাভিনয়ের ক্ষেত্রে এক ধরণের নিরীক্ষা রয়েছে; যেখানে চরিত্র নিজেই তদীয় মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা ও অবস্থানসহ নাট্যঘটনার নানাদিক বয়ান করে। গীতিনাট্য বা বর্ণনাত্মক নাট্যপরিবশেনার আঙ্গিক প্রেরণালব্ধ হলেও খানিক নিজস্বতা রয়েছে ‘গাহনাভিনয়’ পরিবেশনারীতিতে। এই পদ্ধতির অভিনয় রীতিতে গীতের প্রতাপেই চরিত্রগুলোর চরিত্রাভিনয়কে বিশেষায়িত করে তোলে। রস নিষ্পত্তির মূল অবলম্বন হিসেবে কাজ করে ‘গীত’।প্রযোজনাশৈলিতে গল্প, বর্ণনা ও গীতের সহযোগে পরিবেশনার জন্য এই প্রযোজনার নামকরণে কিসসা অভিধাটি গুরুত্ব পেয়েছে।
নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন কৃত মহুয়া পালার সুর ব্যবহার করেছেন নাট্যনির্দেশক। এছাড়া নির্দেশক নিজেও সুর করেছেন।আলোক পরিকল্পনা করেছেন অম্লান বিশ্বাস, পোশাক পরিকল্পনা খোন্দকার সাজিয়া আফরিন লুবনা, কোরিওগ্রাফ প্রান্তিক দেব, মঞ্চোপকরণ ও দ্রব্যসামগ্রী কৃষ্ণ চন্দ্র বর্মণ, মো. আমিন, চয়ন উদ্দীন, তৌহিদ মোস্তাক নীল, নাহিয়ান কাব্য। নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন-অন্তরা সাহা লাকি, কৃষ্ণ সজন পূজা, নীল সরকার, মোক্তাফী রওনক ঐতৃজা, সাজিদ উচ্ছাস, সামিউল হক ভূঁইয়া, শহিদ মৃধা, ইগিমি চাকমা, অর্ণব মল্লিক, জান্নাত তাসফিয়া বাঁধন, নারিন আফরোজ লিনসা, ঐন্দিলা মজুমদার, লাপোল কড়া, তৌহিদ মোস্তাক নীল, আয়েশা আক্তার কাঁকন, নাহিয়ান কাব্য, রাজিব আহমেদ ও নির্ঝর অধিকারী। নাটকের প্রতিটি সুর, বাদ্য ও আবহসঙ্গীত প্রযোজনার প্রাণভোমরা হিসেবে কাজ করেছে, প্রাণতুষ্টির পাশাপাশি সুরগুলো চিত্রকল্প হয়ে মঞ্চালোকের মতো অদৃশ্য থেকেও দৃশ্যমানতা পেয়েছে। পোশাক ও প্রপস পরিকল্পনা অদ্ভূত রকমের সুন্দর হয়েছে; চরিত্র, বয়স, সময়, কাল বিবেচনায় সমসাময়িক উপযোগি করার জন্য কিসসা পালার গল্পটিকে আজকের গল্প মনে হয়েছে। দর্শক নাট্যচরিত্রগুলোকে অনেক চেনা বা চিরচেনা ও আপন ভাবতে পেরেছে। অভিনয় এই প্রযোজনার প্রাণ। সবাই দারুণ অভিনয় করেছেন। সবার উচ্চারণ মানসম্পন্ন, প্রজেকশন চমৎকার। অভিনয় দুর্বলতা নিয়ে প্রায়শ বর্তমান থিয়েটারে প্রশ্ন শোনা যায়। ‘চাঁন মহুয়ার কিসসা’ প্রযোজনা একাডেমিক শিক্ষার্থীদের প্রযোজনা সত্ত্বেও সেই অভিনয় দুর্বলতা অভিযোগ থেকে অবধারিতভাবে মুক্ত বলা যায়।
সেট পরিবর্তে সওদাগরের নৌকার হুইলের সাহায্যে মঞ্চে প্রবেশের দৃশ্য আরোপিত মনে হয়। হুইলের শব্দ বিরক্তি তৈরি করে। নৌকার ঘুর্ণন থিয়েট্রিক্যাল নয়, জোর করে কষ্টসাধ্য কসরৎ মনে হয়েছে। তবে মুখোশের ব্যবহার আকর্ষণীয় ও বিষয়ের সঙ্গে অত্যন্ত গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। চৌকোণা নিরাভরণ খোলা মঞ্চ। সম্মুখভাগে গ্রামীণ নকশায় নানন্দিক আল্পনা মঞ্চের ডেপথ অফ ফিল্ড বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছি। গ্যালারীর আদলে তিনদিকে দর্শক বসার স্থান, একদিকে কালো সাইক্লোরামার সামনে অর্কেস্ট্রাদলের বসার স্থান। চমৎকার মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনা। অর্কেস্ট্রাদলের প্রায়োগিক নৈপুণ্যতা অসাধারণ কিন্ত গীতিনির্ভর প্রযোজনার জন্য হয়তোবা সঙ্গীতদলকে অভিনয়মঞ্চের আপস্টেজে সার্বক্ষণিক অবস্থান করতে দেখা যায়। সঙ্গীতদলের অভিনয়মঞ্চে সার্বক্ষণিক মঞ্চে দৃশ্যমান অবস্থানের কারণে সঙ্গীতদলের উপস্থিতি, বাদল, নানারকম মুভমেন্ট, রেখা, রঙ ও ছায়ার জন্য সম্মুখভাগের অভিনেতার চলন ও কম্পোজিশন দর্শক ভিস্যুয়ালি কোনো একক ইমেজ তৈরি করতে পারছেন না। বারবার ইলিউশন ভেঙ্গে যাচ্ছে। গাহনাভিনয়ে সঙ্গীতদল একটি সমন্বিত চরিত্র, সুর ও তাল লয় একটি চরিত্র কিন্তু নির্দেশককে ভাবতে হবে সার্বক্ষণিক অর্কেস্ট্রাটিমকে মঞ্চে দৃশ্যমান না রেখে কিভাবে পারফমন্সে সার্বক্ষণিক বর্তমান রাখা যায়।
নাট্যনির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক ‘গাহনাভিনয়’ নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা করেছেন তাতে তিনি সফলভাবে আরো একধাপ এগিয়ে গেলেন নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকসাহিত্যর আখ্যান নিয়ে মৈমনসিংহ গীতিকার শতবছর উদযাপনকে কেন্দ্র করে ‘চাঁন মহুয়ার কিসসা’ প্রযোজনাটি মঞ্চে আনার জন্য নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগকে সাধুবাদ জানাই। ঐতিহ্যবাহী লোকনাট্য প্রযোজনা নির্মাণে অর্থায়নের জন্য সাধুবাদ জানাই বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে। লোকসাহিত্য লোকসংস্কৃতির একটি জীবন্ত ধারা; একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিমণ্ডল ও সমাজমানসের কথা বলে। ধারণ করে পূর্ব পুরুষের নিজস্ব জীবনাচরণের ঐতিহ্য, আবেগ, চিন্তা ও মূল্যবোধকে। শেকড়ের সন্ধানে নিয়ে যায়; যোগাযোগ সেতু তৈরি করে বর্তমানের সাথে। বাঙলা ও বাঙালির নিজস্ব রুচি নির্মাণ ও মানসগঠনে ‘চাঁন মহুয়ার কিসসা’ প্রযোজনাটি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। একবিংশ শতকের নগরকেন্দ্রীক জীবন বাস্তবতায় তরুণ প্রজন্মের দর্শকের সাথে ঐতিহ্যের শেকড়ের পরিচয় করিয়ে দিতে আমাদের নাট্যমঞ্চে এধরণের প্রযোজনার নিয়মিত শো করা প্রয়োজন।
ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক, গবেষক ও নির্মাতা।