শিল্পী অনুপম হুদা`র একক চিত্রপ্রদর্শনী
অনেক কথা যাও যে ব`লে কোনো কথা না বলি
ড. ইসলাম শফিক
প্রকাশিত: ১১:৫৩ এএম, ১৮ নভেম্বর ২০২৩ শনিবার আপডেট: ০২:৪৪ পিএম, ১৮ নভেম্বর ২০২৩ শনিবার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের শিক্ষক খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী রেজা আসাদ আল হুদা অনুপমের দ্বিতীয় একক চিত্রপ্রদর্শনী 'কাব্যচিত্র’ ১৭ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমণ্ডিতে অবস্থিত আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ-এ উদ্বোধন হলো। প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর হাশেম খান। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদান করেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক। মোট ২৬টি চিত্রকর্ম নিয়ে প্রদর্শনীর গ্যালারি সজ্জিত হয়েছে। সবগুলো ছবি ক্যানভাসের ওপরে অ্যাক্রেলিক রঙে আঁকা।
অনুপম হুদার চিত্রক্যানভাস রঙ, গঠন ও বুননের সংমিশ্রণে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে। করপোরেট ব্যস্ততা তাঁকে কাব্যচর্চা, লেখালেখি ও ছবি আঁকা থেকে দূরে সরাতে পারেনি। অনুপম হুদা আপাদমস্তক একজন নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী। তাঁর স্কেচ-কার্টুন ভিন্ন মাত্রার এক শিল্পকর্ম। এবারের ‘কাব্যচিত্র’ প্রদর্শনীর ছবির প্যাটার্ন ও বিষয়বস্তু অভিনব। অসাধারণ কাব্যময় শিরোনাম দেয়া হয়েছে প্রতিটি শিল্পকর্মের-বিষণ্ণ বিমুখতা, An evening in Lalbagh, Anguish, সবুজ শাড়ি, মলা, A day of Say Labourers, নিরালায়, The potter, লাল গামছা, Humming Couple, পত্রচিঠি, These two peacock make a heart, ফেলে আসা উদ্ভীন্ন কৈশোর, At the beginning of twilight, just after sunset, গোলাপি শাড়ি, An evening and the red feeling of love, The episode of the crow and the wall বৃষ্টিতে ভিজে যাবার দিন।
বহুমাত্রিক শিল্পী অনুপম হুদা একাধারে একজন শিক্ষক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী ও কবি। বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশনের ব্রডকাস্ট গ্রাফিক ডিজাইনের অগ্রগতির অন্যতম পুরোধা কারিগর। ইটিভি সম্প্রচারের শুরুর সময়কাল থেকে প্রায় দুই যুগ পেশাদার ব্রডকাস্ট গ্রাফিক ডিজাইন, সেট ডিজাইন, নিউজের গ্রাফিক, লোগো ডিজাইন, অ্যানিমেশন, টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের গ্রাফিক অর্থাৎ কমার্শিয়াল আর্টের সাথে তিনি অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত।
বাস্তববাদ, রূপক-সাংকেতিক, বিমূর্ত, প্রতিমূর্ত, পরাবাস্তবাদ, রিয়্যেলিজম, ম্যাজিক রিয়্যেলিজম, পোস্ট-মর্ডানিজম মতবাদের ভাবনাকে রঙ-তুলি-ক্যানভাসের ভাষায় কাব্যরূপ দিয়েছেন শিল্পী অনুপম হুদা। রঙ-রেখার অপূর্ব মেলবন্ধনে সৃষ্ট নান্দনিক কম্পোজিশনে বিষয়বস্তুর অপূর্ব প্রতিরূপায়ণ করেছেন শিল্পী।অনুপম হুদার চিত্রকর্মে ব্যবহৃত রঙ, রেখা, টেকচার, গতি, ছন্দ, পার্সপেক্টিভ, ক্ষেত্র গভীরতা, কম্পোজিশন, ফর্ম সবমিলিয়ে প্রত্যেকটি কাব্যচিত্র জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে ক্যানভাসে ! সাধারণ দৃষ্টিতে আঁকানো ছবি না ফটোগ্রাফ এই দুয়ে বিভ্রম তৈরি করে প্রথম দর্শনে! পরক্ষণেই দর্শনার্থীর ভ্রম ভাঙ্গে শিল্পীর নিপুণ ভাষায় শিল্পসৌকর্যে। ছবিতে গাঢ় রঙের দাপট যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে এ্যাম্পটি স্পেসের অসাধারণ প্রয়োগ। অতি সামান্যে বিস্তৃত বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন প্রতিটি শিল্পকর্মে। ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি’- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানের মতো করে এঁকেছেন অনুপম হুদা। গ্যালারীর নিয়ম মেনে একটার পর একটা ছবি দেখতে দেখতে মনে হবে যেন সত্যজিৎ রায়ের অনেকগুলো আর্টফিল্মের কোলাজ উপস্থাপন দেখছি। পরম মততায় আঁকা প্রতিটি ফ্রেম, প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি গল্প এঁকেছেন শিল্পী! প্রতিটি ছবির সামনে দাঁড়ালে আটকে থাকতে হয়। ছবিগুলো দর্শনার্থীকে অবচেতনেই কল্পনায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় গভীর বোধের অতল সমুদ্রে। দৃশ্যকল্প রচনার মধ্যদিয়ে চিত্রশিল্পী পথ দেখান কবিতার সাবলীল চলনে।
অনুপম হুদার আঁকা ছবি থেকে অতি সাধারণ দর্শকও অনায়েসে কাব্যরস ও শিল্পরস গ্রহণ করতে পারেন। ছবির বিষয় নির্বাচনে তিনি এনেছেন- নদীতে নৌকার ছইয়ের ভেতর নববধূ, শাড়ি, প্রেয়সীর মুখ, খেটে খাওয়া মানুষ, কবুতর, চড়ুই, শালিক, বৃষ্টিভেজা দিন, কাগজের নৌকা, ফুল, পাখি, মেলা, শৈশব, মৃৎশিল্পীর কারুকাজ প্রভৃতি সহজ করে প্রতিরূপায়ণ করেছেন রঙ-তুলির ভাষ্যে। কাব্য ও চিত্র এই দুই শব্দ মিলে কাব্যচিত্র। ইংরেজি অনুবাদে POETRY ও IMAGE এই দুই শব্দ মিলে POETRYIMAGE নামকরণ করা হয়েছে এবারের প্রদর্শনী। শিল্পী অনুপম হুদার ২য় একক প্রদর্শনীর শিরোনামের সাথে প্রতিটি ছবির নামকরণ ও বিষয়বস্তুর সাথে অসাধারণভাবে সার্থকতা লাভ করেছে। চিত্রশিল্পীর রঙ-তুলি-ক্যানভাসে কবিতা পাঠ করলাম। কবিতা চিত্রকল্প তৈরি করে, আবার শিল্পীর নৈপুণ্যে চিত্রকলার ভাষাও কাব্যময় হয়ে ওঠে। শিল্পী অনুপম হুদা এবার তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে আঁকা ছবি কবিতার ভাষায় অনুবাদ করেছেন। বহুমাত্রিক শিল্পী অনুপম হুদার আঁকা ‘কাব্যচিত্র’র প্রতিবেশ আর বৃষ্টিস্নাত অসাধারণ এক কাব্যিক সন্ধ্যাসময় দুয়ে মিলে এক স্বর্গীয় পরিবেশ রচিত হয়েছিল। শিল্পী অনুপম হুদা'র দ্বিতীয় একক চিত্রপ্রদর্শনীর সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।
ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক, গবেষক ও নির্মাতা।