আনসার বাহিনী নিয়ে বিভ্রান্তি
শাহ্ ইসকান্দার আলী
প্রকাশিত: ০২:০৩ পিএম, ৫ নভেম্বর ২০২৩ রোববার আপডেট: ১২:২৪ পিএম, ২৮ নভেম্বর ২০২৩ মঙ্গলবার
আনসার বাহিনীর মনোগ্রাম ও জেমস বুকানন
দেশের প্রাচীনতম নিরাপত্তা বাহিনী আনসারের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বাহিনী সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হয়েছে। ব্যাটালিয়ন আনসার বাহিনীকে (বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) গ্রেপ্তার ও আইন প্রয়োগের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে কেউ কেউ বাহিনীকে ‘প্রতিপক্ষ’ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন।
দেশভাগ-উত্তর উপমহাদেশে জননিরাপত্তা, দাঙ্গা প্রতিরোধ ও মোকাবিলা, আক্রান্ত এবং দুর্গত মানুষের সাহায্যার্থে ১৯৪৮ সালে আনসার বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জননিরাপত্তার নাজুক অবস্থা বিবেচনায় তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের পরিচালক ব্রিটিশ নাগরিক জেমস বুকাননকে আনসার বাহিনী গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেন। তিনি আনসার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক নিযুক্ত হন।
হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাকবলিত অঞ্চলে ইতোমধ্যে জননিরাপত্তায় দায়িত্বরত অভিজাত ও ধনাঢ্য পরিবারের যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক দল সদস্যও আমার পিতা শাহ্ মাহতাব আলীর নেতৃত্বে জেমস বুকাননের অধীনে সাভার প্যারেড গ্রাউন্ডে সামরিক প্রশিক্ষণে যোগ দেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা নিজ নিজ অঞ্চলে সদস্য সংগ্রহে নিয়োজিত হন। তাদের স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি সদ্য বিভাজিত দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। শাহ্ মাহতাব আলী তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমায় দায়িত্ব পালন করেন।
মানবিক সাহায্যের জন্য গঠিত স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর নামকরণ হয়েছিল মদিনার আনসার বাহিনী থেকে, যারা হজরত মুহাম্মদের (সা.) হিজরতের পর নিজেদের জানমাল নিয়ে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত অবৈতনিক এই আনসার বাহিনীই বর্তমানে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী নামে দেশ ও জাতির কল্যাণে ভূমিকা রাখছে।
প্রথমে স্বেচ্ছাসেবী হলেও পরবর্তী সময়ে সরকার আনসার বাহিনীর সদস্যদের ভাতা দিতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে তাদের বেতনভুক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অতঃপর বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন থেকে অফিসার নিয়োগের মাধ্যমে আনসার বাহিনীকে চৌকস নিরাপত্তা বাহিনীতে রূপান্তর করা হয়।
এটা ঐতিহাসিক সত্য, গঠনের শুরু থেকেই এ বাহিনীর ক্ষমতা ছিল গ্রেপ্তার করার। বিশেষ করে তদানীন্তন রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার কাজ সম্পন্ন করতেন আনসার বাহিনীর কর্মকর্তারা। অবশ্য গ্রেপ্তারকৃত আসামিকে পরবর্তী সময়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হতো।
১৯৪৮ সালে দাঙ্গা দমন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের প্রতিটি দুর্যোগে আনসার বাহিনী মাতৃভূমি ও মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত ১৯৭১ সালে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয় তারা। এ বাহিনীর ৪০ হাজার থ্রি নট থ্রি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার দিয়েছিল আনসার বাহিনীই।
দুঃখজনক হলেও সত্য, খোদ আনসার বাহিনীই নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সংরক্ষণ করেনি এবং তাদের পূর্বসূরি সংগঠক ও কর্মকর্তাদের মনে রাখেনি। যে কারণে আনসার বাহিনীর গৌরবজনক ইতিহাস সাধারণ মানুষও জানে না। তা ছাড়া আনসার (সাহায্যকারী) নামের কারণেও স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারগুলো এ বাহিনীকে অন্যান্য বাহিনীর ‘সাহায্যকারী শক্তি’ হিসেবেই ব্যবহার করেছে। এ নিয়ে আমার পিতা শাহ্ মাহতাব আলীর আমৃত্যু আক্ষেপ ছিল।
যখন আনসার বাহিনী নিয়ে নতুন করে কথা উঠেছে, এর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও অবদান নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি। এই বাহিনী নিয়ে দীর্ঘদিনের অবহেলায় গড়ে ওঠা ভুল ভাঙাতেই হবে।
শাহ্ ইসকান্দার আলী: আনসার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাকালীন সংগঠক শাহ্ মাহতাব আলীর সন্তান