ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১০
প্রকাশিত: ০৪:২৮ পিএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার আপডেট: ১০:০৪ পিএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার
শঙ্কিত পদযাত্রা
ধারাবাহিক আত্মকথা
। খ ম হারূন ।
খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।
[পর্ব-১০]
মিয়া আব্দুল মতিন। সম্পর্কে আমার নানা। ভরাট কন্ঠে কবিতা আবৃত্তি করতেন, আমাকেও শেখাতেন। অসাধারন প্রতিভাবান একজন মানুষ। ১৯৭১ এ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে কর্মরত ছিলেন ডিএসপি হিসেবে। ২৫ মার্চ এর প্রতিরোধ সংগ্রামে তাঁর ছিলো সাহসী ভূমিকা। এরপর পুরো একাত্তরে ছিলেন নিঁখোজ। যশোরের ঘোপে আগুনে পুড়ে যাওয়া নিজ গৃহে ফিরে এসেছিলেন দশ মাস পর। তারপর অনেক কষ্টে আবার সেই গৃহকে বাসযোগ্য করে তোলেন। বাকি জীবনটা সেখানেই কাটান। ছোটোবেলায় তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধ হতাম। শাহ্জাহান, কালিন্দী, বিজয়নগর- এই নাটকগুলির কথা মনে পরে। শাহ্জাহান নাটকে ঔরঙ্গজেব ও শাহ্জাহান, ভিন্ন এই দুটি চরিত্রেই তাঁর অভিনয় দেখেছি। যারা তাঁকে চিনতেন তারা জানেন কতো বিশাল মাপের মানুষ ছিলেন তিনি। ১৯৭০, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে তার বাসাতেই উঠেছিলাম। তাঁর সব ছেলেরাই বাবার নাট্যপ্রতিভা পেয়েছিলেন। এক ছেলেতো এখন স্বনামধন্য অভিনেতা, পরিচালক ও নাট্য অধ্যাপক কামালউদ্দিন নীলু। বড় ছেলে অকাল প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক শামসুদ্দিন টগর। আমার আরেক নানা (আম্মার মামা) আবু বকর সিদ্দিীক, তিনিও ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ অফিসার। আবু বকর নানার মেয়ে লায়লা খালার সাথে যার বিয়ে হয়েছিলো তিনি ছিলেন একজন সামরিক অফিসার, বীর মুক্তিযোদ্ধা, পরবর্তীতে সেনাপ্রধান। আমাদের বৃহৎ পরিবারে আরেকজনের কথা মনে পরে, যিনি ছিলেন আম্মার নানার ছোটো ভাই, আম্মা-খালাদের খোরশেদ নানা। আমরাও বলতাম নানা। খুলনা শহরে একসময় সবাই তাকে চিনতো খোরশেদ দারোগা নামে। সম্ভবত তিনি বৃটিশ আমলেই চাকুরী হতে অবসরগ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘদেহ, ছয়ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা আর বিশাল গোঁফ দেখে সবাই তার থেকে দশ হাত দূরে থাকতো। তবে আমরা ছোটোরা ছিলাম তার খুব আদরের।
১৯৭১ এর মার্চ উত্তাল ঢাকা। প্রতিদিন মিছিলে যাই। জয় বাংলা, পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা- এই সব শ্লোগান শুনি আর সেই সাথে গুলির শব্দ। ১ মার্চ হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলন থেকে বের হয়ে আসেন। ছাত্র-জনতার মাঝ থেকে তাঁর বক্তব্য শুনি। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের সময় উপস্থিত থাকি। ছাত্রনেতাদের গগনবিদারী শ্লোগানে কন্ঠ মেলাই। এরপর প্রতিদিন এক একটি ইতিহাসের মধ্যদিয়ে হাঁটতে থাকি। ৭ মার্চ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বন্ধুসহ রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হই। তিনি ঐ সভায় যে কথা উচ্চারণ করেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তার থেকে বড় আর কোনো ঘোষনা হতে পারেনা। সম্ভবও নয়। আবেগে তাড়িত হই। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর জনসভা। সেখানেও উপস্থিত হই। মশিউর রহমান যাদু মিয়ার বক্তব্যের পর ভাসানী তার দরাজ কন্ঠে বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘মুজিব আমার ছেলে, তাকে আমি অনেক ভালোবাসি। সাতই মার্চ সে যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে, তার প্রতি আমার ও আমার দলের শতভাগ সমর্থন ঘোষনা করছি।’ মওলানা ভাসানী এই সভা থেকে মুজিবের জন্য দোয়া করেন এবং মুজিবের নেতৃত্বে সবাইকে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেবার আহবান জানান। এরমধ্যে বন্ধুরা ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে। সবার মুখে একই কথা, যার যার অঞ্চলে গিয়ে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এইসব ঐতিহাসিক ঘটনাগুলিতে উপস্থিত থাকতে পেরে নিজের মাঝে একধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করি। সে সময়ে আমি থাকতাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল ইসলাম হলে বন্ধু আখতার এর রুমে। আখতার তখন চরম বামপন্থী আন্দোলনের একজন সক্রিয় ছাত্রনেতা। সে একাই ছিলো এক রুমে। অতিরিক্ত একটি বেডও ছিলো। তবে আখতার ঐ সময়ে হলে থাকা আর নিরাপদ মনে করছিলো না।
১০ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা ছাড়ি। পকেটে টাকা পয়সা তেমন একটা নেই। ট্রেনে ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাই। সেখানে আমার বড়বোন ছিলো। তার কাছ থেকে দশটা টাকা চেয়ে নেই। যদি পিরোজপুর পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারি তাহলে টাকাটা কাজে লাগবে।
এর দু’দিন পর চাঁদপুর থেকে স্টিমারে পিরোজপুরের পথে যাত্রা করি। সে সময় ঢাকা-খুলনা রুটটি ছিলো ঢাকা থেকে চাঁদপুর, তারপর বরিশাল, ঝালকাঠি হয়ে হুলারহাট। তারপর খুলনা। পিরোজপুরের নদীবন্দর হলো হুলারহাট। সে সময়ে শীত তেমন একটা নেই। তবে স্টিমারে রাতটি ছিলো বেশ ঠান্ডা। রাতে স্টিমারের ডেকে এককোণায় দুহাত মুড়ে বসা অবস্থায় হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে পাই। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। মহসিন হলে থাকতেন। লেখক হিসেবে তখনো পরিচিতি পাননি। স্টিমারে হুমায়ূন আহমেদ এর সংগে কোনো গরম কাপড় নেই। আমার কাছে সোয়েটার আর একটি গরম চাঁদর ছিলো। আমি চাঁদরটি হুমায়ূন ভাইকে দেই। তিনি প্রথমে ইতস্তত: করলেও পরে হাসিমুখে সেটি নেন। ভোররাতে হুলারহাটে স্টিমার পৌঁছে। যে যার মতো নেমে যাই। রিকশা করে বাসায় আসতে আসতে সকাল। বাবা, মা, ছোটোবোন লিপি সবার মুখ দেখে বুঝতে পারি তারা অনেক দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। অনেকদিন কোনো খবর পাঠাতে পারিনি। সবার ভিতর উৎকন্ঠা। এই প্রথম আম্মাকে কাঁদতে দেখি। দুপুরের পর বাসা থেকে বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছি পিরোজপুর টাউনের অবস্থা দেখার জন্য, সে সময় একজন কনেস্টবল বাসায় এসে ঐ চাঁদরটি দিয়ে যায়, যেটি গত রাতে হুমায়ূন ভাইকে দিয়েছিলাম।
বাসা হতে বের হয়ে এসডিও অফিস পার হতে হতে পিরোজপুরের অবস্থা বুঝে ফেলি। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ছাত্ররা সবাই জড়ো হয়েছে পিরোজপুর সরকারী স্কুল মাঠে। ট্রেনিং চলছে। লাঠি আর নকল বন্দুক সাথে নিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং। একদল ট্রেনিং শুরু করেছে, আরেকদল ট্রেনিং এর জন্য নাম লেখাচ্ছে। আমিও নাম লিখিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করলাম।
দিনরাত প্রশিক্ষণ চলছে। সে সময় আমাদের সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসেন পিরোজপুরের আওয়ামি লীগ নেতা ১৯৭০ সালে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য এ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল, ন্যাপ নেতা আলী হায়দার খান, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আব্দুল মান্নান সহ আরো অনেকে। একদিন বিকেলে প্রশিক্ষণ শেষে মাঠ থেকে বের হবার সাথে সাথে দেখি কে যেনো আমার পিঠে হাত দিয়ে আমাকে থামালেন। তাকিয়ে দেখি পুলিশ অফিসার ফয়েজুর রহমান (হুমায়ূন আহমেদের পিতা) আর তার পাশে দাড়িয়ে হাসছেন তরুন ম্যজিস্ট্রেট সাঈফ মিজানুর রহমান। সে সময়ে ফয়েজুর রহমান চাচার বয়স ৫০ বছর আর সাঈফ মিজানুর রহমানের বয়স মাত্র ২৭। পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এই দুজনের ভূমিকা ছিলো অসাধারন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এসবই হচ্ছে ২৫ মার্চ এর আগের কথা।
২৫ মার্চ হতে পাকিস্তান আর্মি যখন সারাদেশে বাঙালি নিধন শুরু করে পিরোজপুরের মুক্তিযাদ্ধারা তখন বালেশ্বর ও কচা নদীর পাড়ে সশস্ত্র পাহাড়া দিতে শুরু করে। কোনো প্রতিরোধ ছাড়া যেনো পাক আর্মি পিরোজপুর দখল করতে না পারে। প্রত্যেক বাড়ী, অফিস, স্কুল, কলেজ সব স্থানে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। পিরোজপুরের অবাঙালি এসডিও মুহিবুল্লাহ শাহ্ এর মধ্যে কোনো একসময় পালিয়ে পিরোজপুর ত্যাগ করে ঢাকা হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান চলে যান। পিরোজপুরের বেসামরিক প্রশাসন তখন ভারপ্রাপ্ত এসডিও আব্দুর রাজ্জাক, এসডিপিও ফয়েজুর রহমান ও ম্যজিস্ট্রেট সাঈফ মিজানুর রহমানের হাতে। মনে আছে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় যখন অপারেশন শুরু হয়, পিরোজপুরে সে খবর সাথে সাথে পৌঁছে যায়। আকাশবাণী কলকাতা হতে ভারী কন্ঠে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার জানাতে থাকেন পাকিস্তানি আর্মি ও বাঙালিদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এই খবর। এরমধ্যে মুক্তিযাদ্ধারা পিরোজপুর ট্রেজারী বিল্ডিং ঘেরাও করে। পুলিশ অফিসার ফয়েজুর রহমান ও ম্যজিস্ট্রেট সাঈফ মিজানুর রহমান ট্রেজারী হতে অস্ত্র গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিলেন। সুশৃঙ্খলভাবে সব কিছু হলো। কারন যুদ্ধের জন্য কঠিন শৃঙ্খলা দরকার। সকলে লাইনে দাড়িয়ে শপথ গ্রহণ করলো। শপথ পরিচালনা করলেন লেফটেন্যান্ট জিয়া। মধ্য মার্চেই জিয়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দেশে চলে আসেন, এসেই পিরোজপুরের সন্তান জিয়া প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিজের হাতে তুলে নেন। মে মাসের ৫ তারিখ পাকিস্তান আর্মি পিরোজপুর দখল করে নেয়। আমরা চলে যাই সুন্দরবনের কাছাকাছি। খবর পাই আব্দুর রাজ্জাক, ফয়েজুর রহমান ও সাঈফ মিজানুর রহমানকে আর্মিরা খুঁজে বের করে বালেশ্বর নদীতীরে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। ফয়েজুর রহমান ছিলেন আমার পিতার বন্ধু। মনে আছে তিনি আমাকে তাঁর সংগ্রহ থেকে গ্রামোফোনে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের স্বকন্ঠে রেকর্ডকৃত গান ও কবিতা শুনিয়েছিলেন।
১৯৯৬, নতুন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী কার্য়ালয়ের সিদ্ধান্ত - সেনাবাহিনীর সকল সেক্টর, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশ বাহিনী আলাদা আলাদা ভাবে মুক্তিযুদ্ধে নিজ নিজ বাহিনীর অবদানের উপর ডকুমেন্টারি তৈরী করবে। এই প্রকল্প তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল হারুন, প্রধানমন্ত্রীর পিএসও (পরবর্তিতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল, সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রদূত)।
ঐ সময় একদিন আমাকে ফোন করেন পুলিশের অতিরিক্ত আইজি বোরহান সিদ্দিকী (পরবর্তিতে পুলিশের আইজি, সচিব ও রাষ্ট্রদূত)। বোরহান ভাই নিজেও ছিলেন একজন শিল্পী। ভালো গায়ক ও উপস্থাপক। তিনি আমার প্রযোজনায় ‘একই বৃন্তে’ নামে একটি সঙ্গীত ম্যাগাজিন দীর্ঘসময় বিটিভিতে উপস্থাপনা করেছিলেন। যে অনুষ্ঠানে একই পরিবারের দু’জন শিল্পী তাদের পছন্দমতো গান পরিবেশন করতেন। প্রথম অনুষ্ঠানটি করেছিলেন আমাদের সঙ্গীত ভূবনের দুই কিংবদন্তি ভাইবোন মহম্মদ আসাফউদ্দৌলাহ এবং ফিরোজা বেগম।
বোরহান ভাই এর অফিসে যাবার পর তিনি আমাকে একটি চিঠি ধরিয়ে দিলেন। বিষয়- পুলিশ বাহিনীর উপর আমাকে একটি ডকুমেন্টারি তৈরী করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ পুলিশ। চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করলাম। টিম তৈরি করলাম সর্বপ্রথমে। পুলিশ বাহিনী থেকে এএসপি মেজবাহ আহমেদ আমার সাথে যুক্ত হলেন এই ডকুমেন্টারি নির্মাণে আমাকে সহযোগিতা করার জন্য। সৎ ও দক্ষ একজন পুলিশ কর্মকর্তা মেজবাহ এখন আর আমাদের মাঝে নেই।
চলচ্চিত্রটি তৈরি করতে গিয়ে কতো যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি তা বলে শেষ করা যাবে না। কতো স্মৃতিকথা। এক এক জনের কথা শুনি আর শিহরিত হই। প্রথমেই শুটিং করলাম রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের দৃশ্য। সেনারা কামান ও মেশিনগান নিয়ে পুলিশ লাইনে আক্রমণ চালায়, নিরস্ত্র পুলিশদের হত্যা করে আর ব্যারাকে আগুন ধরিয়ে দেয়। অস্ত্র হাতে পুলিশ বাহিনী সাহসী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সে এক মর্মান্তিক ঘটনার সফল চিত্রায়ন। পুরো ব্যারাকে আবার নতুন করে আগুন ধরানো হয়। গোলাগুলির দৃশ্যও সরাসরি ধারন করা হয়। ক্যামেরায় অসাধারন কাজ করেছিলে বন্ধু সালাহউদ্দিন লাভলু।
পরদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী পুলিশ সদস্যদের কথা ধারণ করলাম আর সেই সাথে শহীদ কর্মকর্তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের স্মৃতিচারণ। কতোজনের সাথে যে পরিচিত হলাম। যা এখনও মনের মণিকোঠায় জ্বল জ্বল করে।
চলচ্চিত্রটি বিটিভিতে সম্প্রচারিত হয় ১৯৯৬ সালের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে। সেনা সদর এবং পুলিশ অডিটরিয়ামেও প্রদর্শিত হয়েছিলো। এখনো অনেক পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানেরা ফোন করে ডকুমেন্টারিটার কপি সংগ্রহের জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। জানিনা বাংলাদেশ টেলিভিশন আর্কাইভ, সেনা সদর বা পুলিশ হেড কোয়াটার কোথাও এটির কপি আছে কি না।
বিটিভিতে অনেক পুলিশ অফিসারের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। নাট্যকার মনসুরুল আজিজ ও শিল্পী বোরহান সিদ্দিকী ভাই এর সাথে রয়েছে অনেক অনেক স্মৃতি। এছাড়াও আবু নওশাদ নামে একজন অফিসার ছিলেন, মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। তাছাড়া তিনি ছিলেন একজন দক্ষ অভিনেতা ও নাট্যকার। তার লেখা একটি নাটক আমি পরিচালনা করেছিলাম, নামটাও সুন্দর - দূরের বলাকা ভেসে যায়। তৌকীর আহমেদ ও বিপাশা হায়াত ছিলো মূল চরিত্রে। আবু নওশাদ অকালে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। মনসুরুল আজিজ ও চলে গেছেন। তার লেখা দুটি ধারাবাহিক ‘ফিরিয়ে দাও অরণ্য’ ও ‘শঙ্কিত পদযাত্রা’ এখনো অনেকের স্মৃতিতে ভাস্বর।
[চলবে...]
আগের পর্ব পড়ুন
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৯
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৮
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৬
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৫
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৪
ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩