অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

নাট্য-পর্যালোচনা

শিল্পের আড়ালে শকুন: ‘পারাপার’ নাট্যে মুখোশ উন্মোচন

ড. ইসলাম শফিক

প্রকাশিত: ০৮:০৩ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০২৩ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ০৮:০৫ পিএম, ৩১ আগস্ট ২০২৩ বৃহস্পতিবার

শিল্প সৃষ্টির প্রেরণা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে দেশ নাটকের পথপরিক্রমা। ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই নাট্যদল। মহারাজার গুনকেত্তন (১৯৮৭) ছিল দেশ নাটক-এর প্রথম প্রযোজনা। পরবর্তীতে বিগত ৩৫ বছরে ২৪টি নাট্যপ্রযোজনা এই দলটি মঞ্চে এনেছে। তন্মধ্যে দর্শক সমাদৃত উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলো হলো— মহারাজার গুনকেত্তন (১৯৮৭), বিরসাকাব্য (১৯৯০), দর্পণে শরৎশশী (১৯৯২), লোহা (১৯৯৯), নিত্যপুরাণ (২০০১), অরক্ষিতা (২০১২), সুরগাঁও (২০১৭)। দেশ নাটক-এর ২৪ তম প্রযোজনা হিসেবে  মঞ্চের আলোয় এনেছে খ্যাতিমান নাট্যকার মাসুম রেজা রচিত নাটক ‘পারাপার’। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন ফাহিম মালেক ইভান। 

ঢাকার নাট্যমঞ্চে ফাহিম মালেক ইভান একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা। প্রায় দুই যুগ সময়কাল যাবত তিনি মঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের মন জয় করেছেন। ‘পারাপার’ নাটক নির্দেশনার মাধ্যমে ফাহিম মালেক ইভান-এর ঢাকার নাট্যমঞ্চে নির্দেশক হিসেবে অভিষেক হয়েছে। পেশাগত ভাবেও তিনি থিয়েটার শিল্পের সাথে বসবাস করেন।  বর্তমানে ফাহিম মালেক ইভান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।  নাট্যকার মাসুম রেজা ও নির্দেশক  ফাহিম মালেক ইভান-এর জুটিবদ্ধ প্রযোজনা ‘পারাপার’ নিয়ে বক্ষ্যমাণ বিশ্লেষণ।

মানুষই দেশ নাটকের সমস্ত প্রযোজনার কেন্দ্রবিন্দু। নাটক দেখে মানুষ মানুষকে নিয়ে ভাবুক। মানুষ হয়ে উঠুক মানুষের সংগ্রামশীলতা ও সমাজ বিনির্মাণ প্রচেষ্টায় সহানুভূতিশীল; নাটক হয়ে উঠুক চিন্তাশীল মানুষের বিশ্ব দেখার চোখ। এই ব্রত নিয়ে দেশ নাটক ২৪তম প্রযোজনার জন্য পাণ্ডুলিপি নির্বাচন করলেন মাসুম রেজা রচিত নাটক ‘পারাপার’। নাট্যকার এই নাটকের পটভূমি হিসেবে নিয়েছেন চিরচেনা গ্রাম-বাংলার মানুষের প্রতারিত হবার বেদনার আখ্যান। 

নাট্যখ্যানের প্রারম্ভে দেখা মেলে- ভাবোখালী গ্রামের সাধারণ সহজ সরল মানুষের জীবনাচরণ। গ্রামের সাধারণ মানুষ নিত্য জীবনসংগ্রামের পাশাপাশি জীবনকে তারা উদযাপনও করেন-  কবিগান, পালাগান, লোকগান,  লোকজ খেলা, ঘুড়ির নাড়াই এসব নানা আয়োজনে আনন্দে অতিবাহিত হয় গ্রামীণ জনপদের মানুষের জীবন। গ্রামের মহাজন ড্যাডম মালিথার বাড়িতে প্রতিবছর আয়োজিত হয় পালাগান। এবারের আয়োজনে পালা করবে কলকাতা থেকে আসা ড্যাডম মালিথার পুত্র ডালিম মালিথার বন্ধু চিনু গায়েন। পালাগান পরিবেশন করে চিনু গায়েন ভাবোখালী গ্রামের মানুষের মন জয় করে নেয়। চিনু গায়েনের  গান ও অভিনয়ে মুগ্ধ হয় জোসনা। নিজের অজান্তেই চিনুর ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে সে।  অন্যদিকে, চিনুর গ্রাম ছোট ঝলমলিয়ায় চিনুরই অপেক্ষায় থাকে মাঞ্জেলা। চিনু ভালোবাসে মাঞ্জেলাকে। কাজের সন্ধানে শহরের উদ্দেশ্যে গ্রাম ছাড়ে চিনু। নাগরিক জীবনের ছোঁয়ায় গ্রামের চিনুর বদলে ঘটে। জীবিকার তাগিদে নাগরিক কুটিলতার পৃথিবীতে প্রবেশ করে।  চার বছর ধরে মাঞ্জেলা ভালোবাসার মানুষ চিনুর সাথে বিয়ের প্রতীক্ষায় রয়েছে। ভালবাসার মানুষের প্রতীক্ষার প্রহর যখন শেষ হয়না তখন মাঝে মাঝেই গ্রামে ফেরী করতে আসা চুড়িবুড়ির কাছে তার ভালবাসার মানুষের খবর জানায়। প্রতারক চুড়িবুড়ি সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মাঞ্জেলাকে কলকাতার নিয়ে যাবার স্বপ্নে বিভোর করে তোলে। এদিকে ভাবোখালী গ্রামে ঘটে অন্য ঘটনা- চিনু গায়েন-এর সাথে বিয়ে হয় জোসনার এবং সঙ্গে কলকাতায় পাড়ি দেয়ার উদ্দেশে এসে পৌঁছায় বেনাপোলের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। 

নাটকের প্রধান চরিত্র চিনু গায়েন। যে কিনা আসলে গায়েন রূপে নারী পাচারকারী। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে এমন অনেকে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা  শিল্পকে মুখোশ হিসেবে ব্যবহার করে আড়ালে অপকর্ম করেন।  শিল্পের আড়ালে শকুন, শিল্পকে ভাঙ্গিয়ে বাণিজ্য করে। এই নাটকের গল্পে এই বিষয়টি দারুণভাবে চিত্রিত করেছেন নাট্যকার। ‘পারাপার’ নাটকে শিল্পের আড়ালে বাণিজ্যের পণ্য হলো নারী। চিনু গায়েন শিল্পের আড়ালে গ্রাম্যবালিকা জোসনাকে পণ্য হিসেবে বিক্রির মতো ঘৃণ্য কর্মে লিপ্ত হয়। অবরোধে সীমান্ত বন্ধ  থাকার কারণে আশ্রয় নেয় এলাকার প্রভাবশালী সংস্কৃতি অনুরাগী, যাত্রাদলের পৃষ্ঠপোষক রশিদ কোম্পানীর হোটেলে। সেখানে এসে চিনুর নতুন পরিচয় উন্মোচিত হয়। প্রকাশিত হয় এক অজানা তথ্য। হঠাৎ করেই চিনুর মুখোমুখী এসে দাঁড়ায় তার ভালোবাসার মাঞ্জেলা। মাঞ্জেলাও চুড়িবুড়ির সঙ্গে কলকাতায় যাবার আশায় এক অভেদ্য জটিল জালে আটকে গেছে।  চুড়িবুড়িও মাঞ্জেলাকে কলকাতায়  বিক্রি করে দেয়ার জন্য এখানে এনেছে। চুড়িবুড়ি, যাত্রাদলের পৃষ্ঠপোষক রশিদ ও চিনু গায়েন ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের অভিন্ন সত্তা।  দীর্ঘদিন পর রশিদ কোম্পানীর হোটেলে চিনু গায়েন বিবাহ প্রতীক্ষারত   মাঞ্জেলাকে দেখতে পেয়ে গভীর এক সঙ্কটে নিমজ্জিত হন। জোসনাকে বিক্রির পেশাগত যন্ত্রণা ও মাঞ্জেলার প্রতি তার সত্যিকার প্রেম মুক্তিহীন দ্বৈত সঙ্কটজালে নিজেই আটকা পড়েন। এমনই এক ট্র্যাজিক আখ্যান দেশ নাটক-এর ‘পারাপার’। 

নৃত্য, গীত, বাদ্য কোরিওগ্রাফ, অভিনয় ও বর্ণনার অপূর্ব মেলবন্ধনে সৃজিত হয়েছে এই দৃশ্যকাব্য। দশটি মতো গান ব্যবহার করেছেন নির্দেশক এই প্রযোজনায়। পুরো মিলনায়তনকে তিনি অভিনয়ভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। নাড়াই ধরেছে ঘুড়ি ও এইবা নাকি রাস্তা দিয়া এই দুটি গানে সুরারোপ করেছেন ইউসুফ হাসান অর্ক; কি চমৎকার দেখা গেল, তুমি জলে নিলে বাস, মানুষ ভাসে, চক্ষে কত জল রে বন্ধু  এই গানে সুরারোপ করেছেন ফাহিম মালেক ইভান; মানুষ ভাসে এই গানে সুরারোপ করেছেন অসীম কুমার নট্ট;ঝলমল ঝলমল এই গানে সুরারোপ করেছেন ইমামুর রশীদ;  ভুলি কেমনে এই গানে সুরারোপ করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম ও পবন দাস বাউল এর  চঞ্চল মন  গানটি নির্দেশক এই প্রযোজনায় অসাধারণ নাট্যিকভাবে ব্যবহার করেছেন। মঞ্চ পরিকল্পনায় দ্বি-তল অভিনয়ভূমি গল্পকে নাট্যিক উপস্থাপানায় রূপান্তর করণের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে সহযোগিতা করেছে। সাইক্লোরামায় কিঞ্চিৎ পরিবরর্তন করে নদী পারাপার ও খেয়াঘাটের আবহ নির্মাণ বেশ নান্দনিক, এই দৃশ্য ও আলোক পরিকল্পনা দর্শককে  গল্পের গহীনে নিয়ে যায়। 

নাটকের পোষাক পরিকল্পনা করেছেন— সাজিয়া আফরিন, মঞ্চ পরিকল্পনা- কাজী কোয়েল, আলোক পরিকল্পনা— গোলাম ফারুক টিটু, অসীম কুমার নট্ট, লরেন্স গমেজ, ইমামুর রশীদ, ফাহিম মালেক ইভান। কোরিওগ্রাফি- ফেরদৌস হাসান, মৃন্ময়ী ও পূজা; প্রপস- রফিকুল ইসলাম রাসেল; রূপসজ্জা- শুভাশিস তন্ময়;  পোস্টার- চারু পিন্টু, নির্দেশনা সহকারী- আশরাফুল আশীষ, প্রযোজনা অধিকর্তা- কাজী লায়লা বিলকিস। 

‘পারাপার’ নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন— আশরাফুল আশীষ, ইব্রাহীম হোসাইন, গোলাম মাহমুদ, আরিফ হক,  অসীম কুমার নট্ট, কামাল আহমেদ, লেতুনজেরা, ইসমত জেরিন বিনতে নিজাম, মাঈন হাসান, তাওহীদা ইসলাম তানহা, সোমা ফেরদৌস, কাজী লায়লা বিলকিস, সজীব বিশ্বাস, কাজী রাজু, লিমন আলম লিমন, মাসুদ রানা সবুজ,  বাদশা আলমগীর কবির, সালাম শামীম, ব্রততি বিথু, মায়াবী, দিনা চৌধুরী, মো. নাঈম হাসান, শেখ নাইমুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসাইন, গোলাম রাসুল নাবিদ, মো. শুভ খান, শাহেদ নাজির হেডিস, লরেন্স গমেজ, ফাহিম মালেক ইভান।

‘শিল্পের আড়ালে শকুন’— জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নানা রকমের ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠানের এক শ্রেণির কু-চক্র মহল শিল্পমাধ্যমকে ব্যবহার করে মানবপাচার, নারীপাচার, মাদকের চালান, চোরাকারবারী এমন নানাবিধ অপকর্ম হরহামেশা পরিচালনা করছে। চিরায়ত কিন্তু অনুচ্চারিত এমন একটি বিষয় নিয়ে নাট্যকার মাসুম রেজা বাংলাদেশের গ্রামীণ পটভূমিতে নাট্যাখ্যানটি বুনন করেছেন। শিল্পকলার কোমলবৃত্তির পবিত্রতা কলুষিত করছে এক শ্রেণির অসাধু মুখোশধারী শিল্পসাধকেরা। এরা বর্ণচোরা, এদের খুব সহজে চেনা কঠিন। এরা রঙ-বেরঙের মুখোশ পরে রেড়ায়। আমাদের আশেপাশেই অতি চেনা শৈল্পিক মানুষগুলোর মাঝেই রয়েছে সেসব মুখোশধারী শকুনের বাস ও চাষ; ভিন্ন ভিন্ন রূপে, ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে বা পদ-পদবীতে। নির্দেশক ফাহিম মালেক ইভান ‘পারাপার’ পাণ্ডুলিপিকে অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে দৃশ্যকাব্যে রূপান্তর করেছেন।  সংবাদ মাধ্যমে প্রায়শ শিল্পের আড়ালে বিদেশে মাদক পাচার, মানবপাচার, নারী ও শিশু পাচারের খবর দেখা যায়। এমন একটি বিষয়ের ট্র্যাজিক গল্পকে মঞ্চভাষায় অনুবাদ করেছেন দেশ নাটকের ‘পারপার’ প্রযোজনার কলাকুশলীবৃন্দ। দেশ নাটক-এর  শিল্প সৃজনের প্রেরণা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নাট্যচর্চার যে পথপরিক্রমা; তা প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করে চলেছে বাংলা নাটকের ভাণ্ডারকে। থিয়েটার শিল্পও শকুনমুক্ত থাকুক। শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমও মুখোশধারী শকুনদের থাবা থেকে থাকুক মুক্ত । শিল্পভূমিতে বিচরণ করুক সত্য, সুন্দর ও মহৎপ্রাণ মানুষেরা। 

ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক, গবেষক ও নির্মাতা।
[email protected]