গ্রন্থ পর্যালোচনা
পনেরো আগস্টের নেপথ্য কুশীলব
ড. ইসলাম শফিক
প্রকাশিত: ১২:৩২ এএম, ২৫ আগস্ট ২০২৩ শুক্রবার আপডেট: ১২:৫৮ এএম, ২৫ আগস্ট ২০২৩ শুক্রবার
গ্রন্থ পর্যালোচনা সাহিত্যের অন্যতম একটি শাখা। সাহিত্য সমালোচনা বা তুল্যমূল্য বিশ্লেষণ একটি গ্রন্থকে গভীরে তলিয়ে দেখার মনন তৈরি করে। বিশিষ্ট সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল রচিত ‘পনেরো আগস্টের নেপথ্য কুশীলব’ গ্রন্থটি সামসময়িক কালে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও আলোচিত একটি গবেষণামূলক কাজের ফসল। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শিলালিপি থেকে পহেলা আগস্ট বইটি প্রকাশিত হয়েছে। সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে মনজুরুল আহসান বুলবুল এর বিচরণ চার দশক ব্যাপ্তিকাল। খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সাংবাদিকনেতা হিসেবেই দেশ-বিদেশে তাঁর পরিচিতি। সংবাদ, সাংবাদিকতা, ও গণমাধ্যমের পেশাদারিত্ব নিয়ে তিনি বিস্তর লেখালেখি করেন। অসাধারণ যুক্তি-বাগ্মিতায় কথা বলেন টেলিভিশন টকশোতে। আশির দশকে ছড়া ও কবিতা লেখার মধ্যদিয়ে তিনি সাহিত্য দুনিয়ায় প্রবেশ করেন। প্রকাশিত হয়েছে ছড়া, কবিতা ও উপন্যাসের বই। সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল এবার গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন- ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধানের সমুদ্রমন্থনে।
গবেষণার ক্ষেত্রভূমি হিসেবে বেছে নেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট; জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যার প্রেক্ষাপট-পটভূমি। গ্রন্থটির নামকরণ করেন ‘পনেরো আগস্টের নেপথ্য কুশীলব’। বইটির অসাধারণ প্রচ্ছদটি করেছেন- আদনান অভি। প্রকাশক শিলালিপির কর্ণধার জাহিদুল ইসলাম। বইটির নামকরণ শিরোনামের মধ্যেই স্পষ্ট করে লুক্কায়িত আছে অস্পষ্ট কিছু চেহারা। যেসব কুশীলব মঞ্চের পেছনে থেকে পনেরো আগস্ট এর নির্মম হত্যাকাণ্ড সম্পাদন করেছেন। দীর্ঘদিনের কঠিন সাধনার শ্রমসাধ্য কাজি এটি। এতো এতো তথ্য-উপাত্ত, বিভিন্নজনের নাম, স্থান, তারিখ, সময়কাল, দেশী-বিদেশী সংস্থার ছবি, রেফারেন্স, স্টেটমেন্ট নিয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ নেপথ্য কুশীলবদের মুখোশ উন্মোচিত করে প্রকৃত নগ্ন খুনি-চেহারাগুলোকে পাদপ্রদীপের আলোয় এনেছেন। ‘পনেরো আগস্টের নেপথ্য কুশীলব’ গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা এই দুই সহোদরার নামে। লেখক মনজুরুল আহসান বুলবুল বইয়ের উৎসর্গ পৃষ্ঠায় কোনো পদ-পদবী ব্যবহার না করে শুধু তিনটি মাত্র শব্দ ‘দুঃখিনী দুই কন্যা’ বাক্যটি ব্যবহার করেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোটবোন শেখ রেহেনার নামের আগে কোনো বিশেষণের অবতারণা করেননি। উৎসর্গপত্রের সাদা পৃষ্ঠায় মুদ্রিত শুধুমাত্র ‘দুঃখিনী দুই কন্যা’ এই শব্দত্রয় গ্রন্থপাঠের প্রাক্কালে পাঠককে বেদনার মহাসমুদ্র নিয়ে যায়!
‘পনেরো আগস্টের নেপথ্য কুশীলব’ গ্রন্থটি একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ। তাই এই গ্রন্থের বিন্যাস অন্যান্য গ্রন্থের মতো সজ্জিত নয়। ২৮১ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি তিনটি ভাগে বিন্যস্ত— সূচনা কথা, অনুসন্ধানী সারগর্ভ ও পরিশিষ্ট। গ্রন্থের অনুসন্ধানী সারগর্ভ অংশে ষোলটি ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে পর্দার অন্তরালে থাকা কুশীলবদের কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান করেছেন— অতীত কখনও অতীত হয় না শিরোনামে দুই পৃষ্ঠার নিবন্ধটি ইতিহাসের সত্য উচ্চারণের প্রবেশদ্বার বলা যায়। তিনি অন্ধকার কর্ষণ করে সত্যকে আলোয় এনেছেন। এই সত্য উদঘাটনের দায়িত্বটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বর্তমান এই দায় এড়িয়ে গেলে ভবিষ্যৎ বর্তমানকেও দায় মুক্তি দেবে না। গ্রন্থটি অনুসন্ধানী সারগর্ভ মূলত পঁচাশি পৃষ্ঠার নিবন্ধ নিম্নোক্ত বিভাজনে বিভক্ত— খুনের বিচার হয়েছে, ষড়যন্ত্রের বিচার কবে হবে; মোশতাকের ৮৩ দিনের সরকারে সহযোগী যারা, ভাষণটি তাহলে কবে লেখা, কার লেখা; কে এই ‘বস’ যিনি সব ব্যবস্থা নিচ্ছেন; শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সেনানিবাসে সমান্তরাল কার্যক্রম; প্রেক্ষাপট তৈরি : জাসদ ও তাহেরের ভূমিকা; সেনাপ্রধান জে. সফিউল্লাহর ব্যর্থতা; হঠাৎ মঞ্জুর বঙ্গভবনে, উল্লসিত ওসমানী; খন্দকার রশিদের স্ত্রী অন্যতম পরিকল্পনাকারী; ডালিমের ভাষ্য : জড়িত ছিল অনেকেই; হত্যা মামলার আইনি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-যুক্তিতে নেপথ্য কুশীলব; গোয়েন্দা ব্যর্থতা; চাচা আপন প্রাণ বাঁচা; আরো যত সুবিধাভোগী; বিদেশি কুশীলব এবং নানা দেশের সঙ্গে ঘাতকদের যোগাযোগ প্রভৃতি শিরোনামে তথ্য-উপাত্ত সহযোগে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণী উপস্থাপনায় অন্ধকারে ছড়ানো ছিটানো ইতিহাসকে মলাটবন্দি করেছেন।
গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশ পনেরোটি ধাপে বিভাজিত— পরিশিষ্ট এক : ১৫ই আগস্ট নিহত যাঁরা, পরিশিষ্ট দুই : ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পরিস্থিতি প্রতিবেদন, পরিশিষ্ট তিন : বঙ্গবন্ধুর দাফন হয়ে যেভাবে, পরিশিষ্ট চার : ১৫ই আগস্ট ঘাতকদের তালিকা, পরিশিষ্ট পাঁচ: ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের পরিস্থিতি প্রতিবেদন, পরিশিষ্ট ছয় : ইনডেমনিটি আইন (অধ্যাদেশ) ও বিচার, পরিশিষ্ট সাত: বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ মন্ত্রিসভা, পরিশিষ্ট আট: মোশতাকের মন্ত্রিসভা, পরিশিষ্ট নয়: তাহাদের যাওয়া-আসা, পরিশিষ্ট দশ: ক্ষমতার পালাবদল : ১৯৭৫-৯১, পরিশিষ্ট এগারো: বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ মন্ত্রিসভা, শেখ মুজিবুর রহমানের নাম সংবাদমাধ্যম থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা, পরিশিষ্ট বারো : সংবাদপত্র: এক দিনেই পালটে যায় সব, পরিশিষ্ট তেরো: স্বজন হারানো শেখ হাসিনার বিদেশে প্রথম ভাষণ, পরিশিষ্ট চৌদ্দ: স্বজন হারানো শেখ হাসিনার বিদেশে প্রথম ভাষণ সংশ্লিষ্ট স্মৃতিচারণ, পরিশিষ্ট পনেরো: বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পেপার বুক থেকে জবানবন্দি; বাদি-সাক্ষী-স্বীকারোক্তি। গ্রন্থের এই অংশে সংযুক্ত করা হয়েছে— বাদি এ. এফ. এম মহিতুল ইসলাম-এর জবানবন্দি, সাক্ষী কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল-এর জবানবন্দি, সাক্ষী মে. জে. (অব.) সফিউল্লাহ-এর জবানবন্দি, সাক্ষী মে. জে. (অব.) খলিলুর রহমান-এর জবানবন্দি।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সংযুক্ত করা হয়েছে লে. জে. (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান- এর, লে কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, লে কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদ, মিসেস জোবায়দা রশীদ। ইতিহাসের প্রমাণিত সত্যকে গবেষক অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তুলে ধরেছেন। গ্রন্থটি লেখায় তিনি সর্বমোট তেত্রিশটি বিভিন্ন গ্রন্থ ও তথ্যসূত্রের সহায়তা নিয়েছেন- যা বইয়ের শেষে সেসব দুর্লভ গ্রন্থ ও তথ্যসূত্রের তালিকা সন্নিবেশ করেছেন।
বইটিতে মনজুরুল আহসান বুলবুল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে ‘সিআই’য়ের ভূমিকা, পূর্ব ইউরোপের ভূমিকা কেমনতর ছিল, ভারত তখন কী অবস্থান নিয়েছিল; বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর মন্ত্রিসভায় যারা ছিলেন তাদের কার কী ভূমিকা ছিল; বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন মন্ত্রিসভার সদস্যরা কে কোথায় অবস্থান নিয়েছিলেন; মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার বিয়ষ, খুনি খন্দকার মোশতাকের ক্যাবিনেটে কারা অংশ নিয়েছিলেন এসব বিষয় তথ্য-উপাত্ত সহযোগে তুলে ধরেছেন। দালিলিক তথ্য-প্রমাণসহ দলমত নিরপেক্ষ সত্য উচ্চারিত হয়েছে এই গবেষণামূলক গ্রন্থে। মনজুরুল আহসান বুলবুল আন্তর্জাতিক ও জাতীয় রাজনীতি, সমসাময়িক রাষ্ট্র ও সামাজভাবনা, গণমাধ্যম, দেশ-কাল-ভূগোল, বাঙলা ও বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা, জঙ্গিবাদ বিরোধী দর্শন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পোর্টালে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। ২০২১ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অনন্যা পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে- ‘দুইশ ছড়ার ঝিলিক’ ও মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে- ‘একজন ধনী মানুষ ও লুপ্তপ্রায় উত্তম’। সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল সংবাদপত্রে প্রবন্ধ, কলাম, গদ্য, পদ্য সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় স্বদর্প বিচরণ করছেন। ২০২৩ সালে শিলালিপি থেকে প্রকাশিত ‘পনেরো আগস্টের নেপথ্য কুশীলব’ গ্রন্থে তিনি নিজেকে শেকড় সন্ধানী রাজনৈতিক ইতিহাসের গবেষক ও লেখক হিসেবে অসাধারণ একটি কাজ সমাপ্ত করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই গ্রন্থটি আকর গ্রন্থ হিসেবে সমাদৃত হবে।
ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক, গবেষক ও গণমাধ্যম কর্মী।