দুর্ভাগা দেশে জন্মশতবর্ষে পুলিশ প্রহরায় জাতির পিতা
কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক
প্রকাশিত: ০৯:৪২ এএম, ৮ ডিসেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার আপডেট: ০৩:৫৯ পিএম, ৮ ডিসেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। একশ’ বছর আগের জন্ম নেওয়া খোকা থেকে মুজিব হয়ে বঙ্গবন্ধু আর সবশেষে বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষের আয়োজন চলছে জাতীয়ভাবে। সরকার এবছরের ১৭ মার্চ থেকে আগামী বছরের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়কে মুজিববর্ষ ঘোষণা দিয়ে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, অনেক কর্মসূচি চলমান রয়েছে। যদিও বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে অনেক কর্মসূচি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, কিছু কর্মসূচি স্থগিত ও বাতিল হয়েছে; তবু চলছে নানা আন্তরিক আয়োজন। মহান স্বাধীনতার স্থপতির প্রতি বাংলাদেশের এই শ্রদ্ধা প্রদর্শন যৌক্তিক এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশের স্মারক। আমাদের সৌভাগ্য আমরা এই প্রজন্ম কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী অংশের অংশ হয়ে ওঠেছি।
এই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আমাদের বিনয় কিংবা ঔদার্যের কিছু নয়, এটা আমাদের দায়িত্বের অংশ। আমাদের যে অংশ এই দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত, তারা স্বভাবত কৃতজ্ঞ ও গর্বিত। তবে এই অংশের বাইরেও আছে এক অংশ যারা জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে মানে না, তারা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের প্রতি অবদান ও তার আত্মত্যাগকে অস্বীকার করে। এই অংশের পুরোটাই বিশ্বাসঘাতক এবং বিশ্বাসঘাতকদের একটা অংশ কৃতঘ্নও বটে। বিশ্বাসঘাতকতার একটা কারণ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের দখলদারিত্ব থেকে বাঙালিকে মুক্তি দিয়েছিলেন, একটা স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখিয়ে সেটা বাস্তবায়ন করেছিলেন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামোর বাইরে সমতাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকাঠামো গড়তে যা কিছু করার তার সবটা করার চেষ্টা করেছিলেন। জীবনের সোনালী সময়টুকু কারা-প্রকোষ্ঠে সঁপে দিয়ে স্রেফ বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন এঁকেছিলেন। এই আত্মত্যাগ তাকে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তবু দুর্ভাগ্য তার নিজের হাতে গড়া দেশের কিছু কুচক্রি-দুর্বৃত্তের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে, কেবল দুই সন্তান ছাড়া সপরিবারে।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষের আয়োজন যখন চলছে দেশজুড়ে, দেশে-দেশে তখন এই আয়োজনের সময়ে গত সোমবার (৭ ডিসেম্বর) হাইকোর্ট বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সব ম্যুরালের নিরাপত্তা অবিলম্বে নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের ভার্চুয়াল হাই কোর্ট বেঞ্চ আগামী এক মাসের মধ্যে জেলা-উপজেলা সদরে জাতির পিতার ম্যুরাল স্থাপনের অগ্রগতির বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রতিবেদন দিতে বলেছেন। হাই কোর্টের এই নির্দেশনা আসার কারণ দেশের ধর্মভিত্তিক কিছু রাজনৈতিক ও কথিত অরাজনৈতিক সংগঠন ও নেতাদের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধী যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট। এরই মধ্যে শুক্রবার (৪ ডিসেম্বর) রাতের আঁধারে কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর করেছে কিছু দুর্বৃত্ত। পুলিশের বক্তব্য সূত্রে জানা যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে ধর্মীয় নেতাদের বক্তব্যে প্ররোচিত হয়ে জঘন্য এই ঘটনা ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে এরসঙ্গে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর আগে গত মাসে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি ফয়জুল করিম চরমোনাই পির, হেফাজতে ইসলামের আমির মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী, মাওলানা নূর হোসাইন নূরানিসহ একাধিক ধর্মীয় নেতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করার দাবি জানান। অন্যথায় সেটা ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হবে বলেও হুমকি দেন।
ধর্মীয় ওই নেতাদের বক্তব্যের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে ব্যাপক শোডাউন করে ধর্মভিত্তিক দলগুলো। শুক্রবার-শুক্রবারে বায়তুল মোকাররমসহ দেশের বিভিন্ন মসজিদকে কেন্দ্র করে ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার চালানো হয়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ধর্মভিত্তিক দল ও নেতাদের এমন অপপ্রচারের শুরুতে আওয়ামী লীগ প্রতিক্রিয়া না দেখালে প্রতিক্রিয়াশীলদের সাহস বেড়ে যায়। কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন ভাস্কর্য আক্রান্ত হয় তাদের দ্বারা। এরইমধ্যে ধর্মভিত্তিক নেতারা ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়ে এটা ইসলামবিরোধী বলেও ফতোয়া দেয়। এই ভাস্কর্যের নির্মাণকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে সারাদেশের আলেম-ওলামাদের বৈঠকও হয়। ফলে ধরে নেওয়াই যায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতায় তারা দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা জুনাইদ বাবুনগরী, মামুনুল হক ও ফয়জুল করিম চরমোনাই পীরকে নিয়ে ব্যাপক শোডাউনও করে জানায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে তারা ভেঙে ফেলবে।
তাদের এই যুদ্ধংদেহী হুমকির সময়ে কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার পর সরকারি দল কিছুটা হলেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। ভাঙচুরের অব্যবহিত পর নেতারা মুখ খুলতে শুরু করেছে। সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠন মাঠে নেমেছে। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠন ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনার পর মামুনুল হক, জুনাইদ বাবুনগরী ও ফয়জুল করিম চরমোনাই পিরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার আবেদন করেছে। আবেদনের পর এটাকে আমলে নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সত্যব্রত শিকদারের আদালত পিবিআইকে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে আগামী ৭ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
কথা হলো, এতসব কেন হবে? কেন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে আপত্তি জানানো হবে বঙ্গবন্ধুর দেশ বাংলাদেশে? এই কি তার প্রাপ্য ছিল? এই কি আমাদের কৃতজ্ঞতাপ্রকাশ? কেন রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে অবজ্ঞা করে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মিত হলে সেটা বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হবে? কেন টেনেহিঁচড়ে ভাস্কর্য ভাঙার প্রকাশ্য হুমকি শুনতে হবে আমাদের?
এই অবস্থা একদিনে গড়ে ওঠেনি। এই অবস্থা তৈরি হয়েছে ধীরে ধীরে। স্রেফ ক্ষমতার জন্যে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট কিংবা সমঝোতার নামে নতি স্বীকার করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে। নামে অরাজনৈতিক ওই সংগঠনের নেতাদের আস্থায় রাখতে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত জাস্টিসিয়া ভাস্কর্য সরানো হয়েছে। ধর্মভিত্তিক এই দলগুলো ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাজধানীর বিমানবন্দর মোড়ে লালনের ভাস্কর্য ভাঙার পর সেটা নির্মাণ থেকে সরে যাওয়া হয়েছে। পিছু হটার এমন নজির নানা ক্ষেত্রে আরও অনেক আছে। এ ঘটনাগুলো সাময়িক রাজনৈতিক স্বস্তির পালে হাওয়া জোগালেও আমাদের ক্ষতি করেছে অনেক। ফলে মুজিব জন্ম শতবর্ষে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার শাসনামলেও জাতির পিতার প্রতি এমন অশ্রদ্ধা, ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে।
ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন ভাস্কর্য মূর্তি। মূর্তি ইসলামবিরুদ্ধ। তাদের দাবিমতে বাংলাদেশে ইসলামবিরোধী কোনোকিছু করতে তারা দেবেন না। তাদের দাবি নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে ভাস্কর্য থাকতে পারে না। বহু-কথিত এই নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে তারা এবং সম-আদর্শের সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনে অংশ নিলেও তাদের প্রাপ্তিযোগ মাত্র দুই শতাংশ কিংবা তার সামান্য বেশি জনসমর্থন। এই নগণ্য সমর্থন নিয়ে তারা যেভাবে দেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ে হুমকির সুরে কথা বলে তাতে ভ্রান্তি জাগে রাষ্ট্রচরিত্র নিয়ে; দেশ ইসলামি প্রজাতন্ত্রী দেশ হয়ে গেল নাকি? যদিও তা নয় তবু এই দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ রাষ্ট্রধর্মের বিষয়টি যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে তাতে করে তাদের আস্ফালন বাড়বে বৈ কমবে না! ধর্মনিরপেক্ষতাকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করে যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল, বায়াত্তরে সংবিধান প্রণয়ন করেছিল তারাও এই রাষ্ট্রধর্মকে মেনে নিয়েছে। আদর্শিক এই অধোগতির ফল যে কত ভয়াবহ সেটা টের পাওয়া যাচ্ছে এখন, দুঃখজনক বাস্তবতা টের পাওয়া যাবেও হয়ত আগামীতে।
চিন্তক আহমদ ছফা লিখেছিলেন, “ঘোষণা দিলেই একটি রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে যায় না। একটি দরিদ্র কৃষিপ্রধান দেশ কিছুতেই এক সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করতে পারে না। সে একটা সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের এই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আমি, ‘শুরু করতে হবে’- এই বাক্যটি জোর দিয়ে উচ্চারণ করছি।” দুই দশকেরও বেশি আগে ছফা যা বলেছিলেন সেটা এখনও প্রাসঙ্গিক। এখনও আমাদেরকে বলতে হবে- ‘শুরু করতে হবে’। এই শুরুর প্রক্রিয়া নিয়ে এখনও আমরা উদাসীন। এই সময়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও নীতিনির্ধারক হতে চাওয়াদের মধ্যকার আলোচনার উপলক্ষ যখন কে কত ধার্মিক তখন এই ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার প্রতিষ্ঠা অনেক দূরের বিষয় হয়ে যায়। এর জন্যে আমাদের দরকার সাংস্কৃতিক গণজাগরণ, কিন্তু এই জাগরণে নেতৃত্ব দেবে কারা? মানুষ খুঁজে পাওয়াও ত দুষ্কর!
দুর্ভাগ্য দেশে আজ জাতির পিতার জন্ম শতবর্ষে আদালতকে বলতে হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য পাহারা দিয়ে রাখতে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রতিক্রিয়াশীলদের অবমাননাকর আচরণ, হুমকি, ভুল ব্যাখ্যা, সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মানুষের বিস্তার, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া, মুজিববিরোধিতা-দেশবিরোধিতা, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রগতির বন্ধ্যত্ব দেখে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঙক্তি- ‘‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!’’ পুলিশের পাহারায় কী হবে? কোনো কাজ হবে না যদি রাষ্ট্রের নীতি না বদলায়, কোনো কাজ হবে না যদি না আমরা প্রগতির দিকে ধাবিত হই!
কবির য়াহমদ, প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে