অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

স্থানীয় সমাধান প্রয়োগে জলবায়ুসহিষ্ণু, অভিবাসীবান্ধব শহর নির্মাণ: জাতীয় পর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ০৬:৩৫ পিএম, ৯ আগস্ট ২০২৩ বুধবার  

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রশ্নে সমস্যা ও সমাধান উভয় ক্ষেত্রেই স্থানীয় মানুষের ভাবনা ও সিদ্ধান্তকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। দেশের শহরগুলোকে জলবায়ুসহিষ্ণু ও অভিবাসীবান্ধব করে গড়ে তোলার ওপর জাতীয় পর্যায়ের এক আলোচনায় এই মত প্রকাশ করেন বক্তারা।

ব্র্যাক এবং গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশন (জিসিএ) সোমবার বিকেলে (৭ই আগস্ট) রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপমন্ত্রী সাংসদ হাবিবুন নাহার, মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, পটুয়াখালি ও কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়রদ্বয়, মোংলা পৌরসভার জনপ্রতিনিধিরা এবং জাতীয় পর্যায়ের ৬০টিরও বেশি অংশীদারের প্রতিনিধিরা। দেশে জলবায়ুসহিষ্ণু ও অভিবাসীবান্ধব শহর নির্মাণকে কেন্দ্র করে আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হয়।  

বক্তারা বলেন, দেশের নগর এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের ৫০ শতাংশেরও বেশি বাস করছেন বস্তিগুলোতে। এই বিরাট জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনের ঝুঁকির জায়গাগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দিতে হবে। একইসঙ্গে ছোট শহরগুলোকে যদি সুপরিকল্পিতভাবে জলবায়ুসহিষ্ণু করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে অপরিকল্পিত বাসস্থানের সংখ্যা যেমন কমে আসবে, তেমনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ বাড়বে। এর মধ্য দিয়ে শহরগুলোর জন্য বোঝা হয়ে ওঠা অতিরিক্ত জনসংখ্যা সম্পদে পরিণত হবে। এসব উদ্যোগ বাংলাদেশের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (National Adaptation Plan) কর্তৃক গৃহীত জলবায়ু-স্মার্ট নগর নির্মাণ বিষয়ক তৃতীয় লক্ষ্যটি অর্জনে সহায়ক হবে।

সরকারের এই লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালনে যুক্তরাজ্য সরকারের সহায়তায় ব্র্যাক ও জিসিএ দেশে জলবায়ুসহিষ্ণু ও অভিবাসীবান্ধব নগর গড়ে তুলতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এ লক্ষ্যে সংস্থা দুটি গত বছর (২০২২) দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর মোংলায় বস্তি এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের সঙ্গে সেখানকার বস্তি চিহ্নিতকরণ ও সামাজিক মানচিত্র তৈরি, প্রধান জলবায়ুজনিত ঝুঁকিগুলোকে চিহ্নিতকরণ এবং জনগণ কর্তৃক জলবায়ুসহিষ্ণু পরিকল্পনা প্রণয়নে কাজ করেছে।
পরিকল্পনা প্রণয়নের এই কার্যক্রমে স্থানীয় মানুষকে সংগঠিত করা ও সহায়তা করার ক্ষেত্রে ব্র্যাক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা স্লাম ডোয়েলার্স ইন্টারন্যাশনালের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্পার্ক (SPARC)-এর পূর্ব অভিজ্ঞতা নিবিড়ভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। মোংলা পৌরসভার মেয়র শেখ আব্দুর রহমান স্থানীয় মানুষকে প্রক্রিয়াটি সম্পাদনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তারা ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা ও সুপেয় পানির অভাবসহ গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবগুলোকে চিহ্নিত করেছেন এবং সম্ভাব্য সমাধানগুলোকে নিয়েও কাজ করেছেন। এলাকার লবণাক্ততা বাড়লেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে বিদ্যমান বিভিন্ন বাস্তবতার কারণে মোংলায় বাইরে থেকে আসা মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

এক্ষেত্রে যেসব কারণে মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরিশাল, খুলনা, নোয়াখালি ও সাতক্ষীরার মতো জেলাগুলোয় সৃষ্ট জলবায়ুজনিত বিপন্নতা এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভাব। অন্যদিকে বন্দরে কাজের সুযোগ, পদ্মাসেতুর ফলে সৃষ্ট যোগাযোগ সুবিধা ও মোংলাকে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা হিসেবে ঘোষণায় জীবিকার সন্ধানে মানুষ ছুটে আসছেন এখানে।

স্থানীয় নেতৃত্বে সমাধান প্রয়োগ (Locally-Led Adaptation - LLA)-এর এই মডেল এরপর পটুয়াখালি, কুয়াকাটা ও ভোলা -- উপকূলীয় এই তিন পৌরসভায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে উপকূলীয় নগর জলবায়ুসহিষ্ণু প্রকল্প (Coastal Towns Climate Resilience Project -CTCRP)-এর আওতায়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে সরকারের স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।

উপমন্ত্রী সাংসদ হাবিবুন নাহার অনুষ্ঠানে তার নির্বাচনী এলাকা মোংলায় বাস্তবায়িত এই কার্যক্রমে সন্তোষ ও বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন।

মোংলা থেকে উপস্থিত প্রতিনিধিরা বলেন, এই কাজটির মাধ্যমে নিজেদের এলাকার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের ফলে সৃষ্ট সমস্যা ও তার জন্য কী ধরনের সমাধান গ্রহণ করতে হবে সে বিষয়ে তাদের ধারণা অনেক পরিষ্কার হয়েছে। “এসব সমাধান বাস্তবায়নে আমরা আমাদের পৌরসভা ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের কাছে সহায়তার দাবি জানাচ্ছি,” বলেন পৌরসভার নারিকেলতলা গুচ্ছগ্রামের বাসিন্দা চম্পা বেগম।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ স্থানীয় সরকারের বিদ্যমান কাঠামো ব্যবহার করে অর্থায়ন প্রদান করা উচিত বলে মত প্রকাশ করেন। তিনি এক্ষেত্রে দেশের ভেতরে বাস্তুচ্যূত জনগোষ্ঠীর সুষ্ঠ পুনর্বাসনে গৃহীত ‘অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় কৌশলপত্রে’ উল্লেখিত নির্দেশনার কথাও বলেন।

জিসিএ’র অধীন লোকালি লেড অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রামের গ্লোবাল লিড অন্জু শর্মা মোংলার স্থানীয় মানুষ কর্তৃক চিহ্নিত সমাধানগুলোকে বাস্তবায়নে সরকার ও অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে একযোগে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

অনুষ্ঠানে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক অধ্যাপক ড. সালিমুল হকের সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচনা আয়োজিত হয়। এতে অংশ নিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার ভৌমিক টেকসই অভিযোজনমূলক সমাধান উদ্ভাবনে স্থানীয় জ্ঞানের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন। আলোচনায় অংশগ্রহণকারী মেয়ররা এলাকার সমস্যার সুষ্ঠ সমাধানে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় সম্পৃক্ততার ওপর জোর দেন।
এলজিইডির পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ, মূল্যায়ন ও পরিদর্শন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ডা. মো. সারোয়ার বারী স্থানীয় নেতৃত্বে সমাধান কৌশলের সুষ্ঠ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশে এই কৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিখনগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।

ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা অ্যানা ব্যালান্স স্থানীয় নেতৃত্বে সমাধান কৌশলে বাস্তবায়িত কার্যক্রমের বিস্তারে জিসিএ’র সহায়ক ভূমিকার প্রশংসা করেন।

এডিবির নগর বিশেষজ্ঞ এস এ আবদুল্লাহ আল মামুন সিটিসিআরপি প্রকল্পের আওতায় বস্তি উন্নয়ন কার্যক্রমে জিসিএ’র ভূমিকার প্রশংসা করেন।

এলজিইডির অধীনে সিটিসিআরপি প্রকল্পটির পরিচালক মোখলেসুর রহমান বলেন, বস্তি উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে গড়ে তোলা জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলা পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।