অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ফাখরিজাদেহ’র মৃত্যু ইরানের জন্য কতটা ক্ষতির?

আনোয়ার কানন

প্রকাশিত: ০৪:৪৫ পিএম, ৭ ডিসেম্বর ২০২০ সোমবার   আপডেট: ০১:২২ পিএম, ৮ ডিসেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার

এ বছরের একদম শুরুর দিকে ইরানি কুদস বাহিনীর কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে ইরাকের বাগদাদে হত্যা করা হয়। নভেম্বরে এসে ইরানের রাজধানী তেহরানে হত্যা করা হয় শীর্ষ বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে।  

বেশ লম্বা সময় ধরে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে গেলেও, নিজেকে সবসময় লাইমলাইটের বাইরে রাখতে চেয়েছেন মোহসেন ফাখরিজাদেহ। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমও সবসময় আলোচনার বাইরে রাখতে চেয়েছিলো তাকে। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ অধ্যাপক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে শুধু। 

কিন্তু ২০০৩ সালে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি বাতিলের কিছুদিনের মধ্যেই পশ্চিমা বিশ্বের কাছে আর অপরিচিত থাকলেন না তিনি। ২০১৮ সালের এক বক্তৃতায় ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু মোহসেনের নাম উচ্চারণ করে বলেন, “স্মরণ রাখবেন নামটি হচ্ছে ফাখরিজাদেহ।”

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ফাখরিজাদেহকে বেশি বেশি জনসম্মুখে আসতে দেখা যাচ্ছিল। ইরানের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে রাষ্ট্রপ্রধান আয়াতুল্লাহ খামেনির সাথেও বেশ কয়েকটি ছবিতে দেখা গেছে তাকে। এবং এ কারণেই হয়তো তার এমন পরিণতি।

আরও পড়ুন- স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয় ইরানের বিজ্ঞানীকে

২৭ নভেম্বর তেহরানের বাইরে বন্দুক হামলায় নিহত হওয়ার পরপরই বিশ্বজুড়েই আলোচনার বিষয়বস্তুতে ফাখরিজাদেহ এর হত্যাকাণ্ড। প্রায় পুরোটা জীবন রহস্য হয়ে কাটিয়ে দিলেও, তার মৃত্যু জন্ম দিয়েছে আরো একটি রহস্যের, ইরানের উপর তার মৃত্যুর প্রভাব কতটা, তা নিয়ে। 

তার মৃত্যুপরবর্তী প্রভাবের কথা বিবেচনায় অনেক বিশ্লেষক ফাখরিজাদেহকে আরেক আলোচিত-সমালোচিত ইরানি ব্যক্তিত্ব কাসেম সোলেমানির সাথে তুলনা করেছেন। 

‘ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি’-র মধ্য প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ সাইমন হেন্ডারসন বলেন, “যদিও দুজনের কাজ সম্পূর্ণ আলাদা ছিলো, তবুও ইরানের উচ্চ মহলে সিনিয়রিটি এবং সম্মানের দিক দিয়ে তারা প্রায় সমাবাস্থানে ছিলেন।“

উল্লেখ্য, ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের ফলে শাহ মোহাম্মদ রেযা পাহলভিকে ১৯৭৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তখন সোলেমানি ও মোহসেন দুজনেই বয়সে তরুণ। 

বিপ্লবের পরপরই নতুন প্রজাতন্ত্র ও তার আদর্শিক লক্ষ্যগুলো রক্ষার্থে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক রেভোল্যুশনারি গার্ড কর্পস-এ যোগ দেন মোহসেন। 

জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের মতে মোহসেন ধীরে ধীরে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির একজন প্রধান ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। ইরানের মিলিটারি পরিচালিত ফিজিক্স রিসার্চ সেন্টারের একজন সাবেক কর্তাব্যক্তি হিসেবে, দেশের প্রথম ইউরেনিয়াম এনরিচম্যান্ট প্লান্টের সাথেও প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত হন তিনি। 

পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের মুখে ২০০৩ সালে অবশ্য ‘আমাদ প্ল্যান’ নামক এই গোপন পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে বাধ্য হয় ইরান সরকার। এর আগে কখনো আন্তর্জাতিক এটমিক এনার্জি এজেন্সি ফাখরিজাদেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য না ডাকলেও, এর পর থেকেই মোটামুটি পরিচিত হতে থাকেন তিনি। 

জাতিসংঘের রেকর্ড ঘেঁটে দেখা যায়, ‘নিউক্লিয়ার বা ব্যালিস্টিক মিসাইলের’ সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে যে আট ইরানি নাগরিকের ওপর আন্তর্জাতিক ট্রাভেল ও ফাইনান্সিয়াল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মোহসেন ফাখরিজাদে। 

২০১৮ সালে ইরান থেকে পাচার হয় বিশাল সংখ্যক সরকারি নথি। সেসব নথি থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় যে, ১৯৯৮ সাল থেকে পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছিলেন মোহসেন। 

ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ২০১৮ সালে এক অনুষ্ঠানে এসব নথিপত্র প্রদর্শনকালে সর্বপ্রথম মোহসেনের ছবি সবার সামনে প্রকাশ করেন এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ‘ছায়া মানব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। 

ফাখরিজাদের মৃত্যুর খবর ইরানি গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে কাভারেজ পেতে থাকে। সেখানে তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের গবেষণা এবং ইনোভেশন সংস্থার প্রধান হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় অবশ্য তাকে ইরান মিলিটারির করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবেলায় সংযুক্ত থাকার কথা বলা হয়েছে। 

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ এরিক ব্রুয়ার বলেন, “ইরান বরাবরই তাদের পারমাণবিক কর্মসূচির কথা অস্বীকার করে এসেছে। এখন মোহসেনের মৃত্যুর বিষয়টি তারা কতটা দক্ষতার সাথে সামাল দেয় তাই এখন দেখার বিষয়।“

বহির্বিশ্বের পারমাণবিক অস্ত্রের তথ্যাবলী আমেরিকার কাছে প্রকাশ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞানী রবার্ট অপেনহাইমারকে যথেষ্ট সম্মানের সাথে দেখা হয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে মোহসেন ফাখরিজাদেহ ইরানের জন্য রবার্ট অপেনহাইমারের মতো।

আবার অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ইরানের মাটিতে মোহসেনের মতো প্রথম সারির এক বিজ্ঞানী, যিনি কিনা সরকারি সুরক্ষা বলয়ে থাকেন, এমন একজন ব্যক্তিত্বকে হত্যা করা ইরানের জন্য বিশাল এক ধাক্কা।