অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বাংলাদেশের আয় বৈষম্য ও আমাদের করণীয়

জিয়াউর রহমান, পিএমপি 

প্রকাশিত: ১২:০৫ পিএম, ৩১ জুলাই ২০২৩ সোমবার  

একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সে দেশের মোট আয়। কেননা আয়ের উপরেই নির্ভর করে দেশটির ব্যয়, উৎপাদন এবং সঞ্চয়। একটি দেশের মোট আয় বৃদ্ধি পাওয়া মানে হচ্ছে সে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হওয়া বুঝায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলে আয় যে বৃদ্ধি পায় সেটা কি গরীব,ধনী উভয়েরই বাড়ছে কিনা? অথবা ধনী-গরীবের আয় বৃদ্ধির অনুপাতটা সমান কিনা?। মূলতঃ এইযে একক আয় সমানভাবে বৃদ্ধি না পাওয়া বা আয় বৃদ্ধির অনুপাতের তারতম্য হওয়াকেই সাধারণত আয় বৈষম্য বলা হয়।

সাধারণত দুটি উৎস থেকে আমরা আয় করে থাকি। প্রথমটি হলো শ্রমলব্ধ আয় যা আসে সাধারণত মজুরি, বেতন, বোনাস ইত্যাদি থেকে। আর দ্বিতীয়টি হলো পুঁজিলব্ধ আয় বা মূলধনলব্ধ আয় যা আসে সাধারণত খাজনা, বাড়ি ভাড়া, সুদ, মুনাফা, মূলধনের মূল্যবৃদ্ধি, রয়ালটি, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমি, স্থাবর সম্পত্তি, আর্থিক সম্পদ, কারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি থেকে। যদি কোনো দেশের মূলধনলব্ধ বা পুঁজিলব্ধ আয়ের প্রবৃদ্ধির হার দেশের জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আয় বৈষম্য বাড়বে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে আয় বৈষম্য থাকবেই। তবে তা সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব রাষ্ট্রীয় পলিসির মাধ্যমে। একটি দেশের, টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন একটি বৈষম্যহীন সুষম অর্থনৈতিক সমাজ কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা।  কেননা একটি বৈষম্যহীন সুষম অর্থনৈতিক সমাজ কাঠামো প্রতিষ্ঠা ধনী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আয়বৈষম্য কমিয়ে এনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথ তৈরি করে। এ জন্য প্রত্যেক জাতির জন্য অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সব ধরনের অসমতা হ্রাস করা অত্যন্ত জরুরি। 

একটি দেশের আয়ের বৈষম্য পরিমাপ করার একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি হচ্ছে গিনি সহগ (Gini Coefficient) বা গিনি সূচক (Gini Index)। ১৯১২ সালে ইতালির সংখ্যাতত্ত্ববিদ কোরাদো গিনি এর উদ্ভাবক এবং তাঁর নাম অনুসারে এটা গিনি সহগ বা গিনি সূচক নামে পরিচিত লাভ করে। গিনি সহগ বা গিনি সূচক একটি অনুপাত যার মান ০ থেকে ১ এর মধ্যে হবে। সবার আয় সমান হলে গিনি সূচক এর মান হবে ০ (শূন্য) যার অর্থ হচ্ছে চরম সাম্য অবস্থা বিরাজ করছে অর্থ্যাৎ অর্থনীতিতে সকল সম্পদের বণ্টনে সম্পূর্ণ সমতা রয়েছে। আর সকল আয় যদি একজনের হাতে পুঞ্জীভূত হয় তাহলে গিনি সূচকটির মান হবে ১ (এক) যার অর্থ হচ্ছে দেশটিতে চরম অসাম্য অবস্থা বিরাজ করছে। বাস্তবে এ দুটি চরম অবস্থা কোনো দেশেই বর্তমানে বিদ্যমান নেই। গিনি সহগের মান ০ (শূন্য) থেকে যতই ১ (এক) এর দিকে এগোবে, বুঝতে হবে বৈষম্য বাড়ছে। গিনি সহগের মান পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশে গিনি সহগের মান দিন দিন বাড়ছে; যার মানে হচ্ছে বাংলাদেশে আয় বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। 

বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক খানা আয় ও ব্যয় জরিপ করা হয়। ১৯৭৩ সালের জরিপের ফল অনুযায়ী বাংলাদেশের গিনি সহগের মান ছিল মাত্র ০.৩৬ এবং দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ ওই সময়ে দেশের মোট আয়ের ২৮.৪ শতাংশ আয় করত।  ১৯৮৮ সালে বিবিএস কর্তৃক প্রচারিত ৪র্থ খানা আয় ও ব্যয় জরিপের ফল অনুযায়ী বাংলাদেশে গিনি সহগ কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ০.৩৭ এবং দেশের সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ ওই সময়ে দেশের মোট আয়ের ৩১ শতাংশ আয় করত। এর অর্থ হচ্ছে  ওই সময় বাংলাদেশে দারিদ্র্য বেশি  হলেও আয়বৈষম্য ছিল তুলনামূলকভাবে সহনীয় পর্যায়ে। মুলতঃ গত দেড় যুগে জিডিপির প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বাংলাদেশের আয় বৈষম্য। ২০১০ সালে বিবিএস এর  খানা আয় ও ব্যয় জরিপ এর ফল অনুযায়ী এই গিনি সহগের মান ছিল ০.৪৫৮ এবং দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে জমা ছিল মোট আয়ের ৩৫ শতাংশ। ২০১৬ সালে বিবিএস এর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ এর ফল অনুযায়ী গিনি সহগ বেড়ে দাঁড়ায় ০.৪৮৩ এবং দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে জমা ছিল মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ। 

গবেষকরা মনে করেন, গিনি সহগের মান বৃদ্ধি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের আয়-বৈষম্যে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কেননা সর্বশেষ বিবিএস কর্তৃক প্রচারিত হাউসহোল্ড ইনকাম এন্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে( HIES)-২০২২  মোতাবেক আয় বৈষম্য পরিমাপক গিনি সহগ বাংলাদেশে ০.৪৯৯ এ পৌঁছে গেছে এবং দেশের ১০ শতাংশ শীর্ষ ধনীর কাছে জমা বেড়ে হয়েছে মোট আয়ের ৪০.৯২ শতাংশ। এমনকি দেশের সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের আয় এখন দেশের মোট আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ। অর্থ্যাৎ দেশের তিন ভাগের দুই ভাগ আয় যাচ্ছে দেশের ধনী ৩০ শতাংশ মানুষের হাতে এবং বাকি ৭০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের অবশিষ্ট এক ভাগ।  প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশ এখন উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে কেননা গিনি সহগের মান ০.৫০ পয়েন্ট পেরোলেই একটি দেশকে উচ্চ বৈষম্যের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেখানে বাংলাদেশে গিনি সহগের মান ০.৪৯৯।  গবেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের আয়-বৈষম্যে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং  দেশের আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য হ্রাসে এখনো সাফল্য অর্জিত হয়নি। 

তবে আশার কথা হচ্ছে, দেশে ভোগ গিনি সহগের মান আয় গিনির চেয়ে অনেক কম। ভোগ সহগ বৈষম্য পরিমাপক গিনি সহগ বাংলাদেশে ০.৩৩৪ এ পৌঁছে গেছে যা ২০১৬ সালে ছিল ০.৩২৪ এবং ২০১০ সালে ছিল ০.৩২১। ভোগ গিনি সহগ থেকে বোঝা যায় যে, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভোগ ব্যয় বেড়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমান সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আয়বর্ধনমূলক নানামুখী উদ্যোগ ও কার্যক্রম নিয়েছে, যার ফলে ভোগব্যয় বাড়ছে । ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান বৈষম্য মোকাবেলায় এটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে অনেকে মনে করেন। আমরা  বিবিএস এর প্রতিবেদন থেকে দেখতে পারি, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং করোনাভাইরাস মহামারির বৈরী প্রভাব থাকা সত্ত্বেও দেশের দারিদ্র্যের হার গত ছয় বছরে ৫.৬ শতাংশ কমেছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ১৮.৭ শতাংশ। আর অতি দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ।

প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের ২০২২ সালের বৈশ্বিক অসমতা প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে গত বছরেও মোট জাতীয় আয়ের ৪৪ শতাংশই ছিল ১০ শতাংশ ধনীর দখলে এবং এর মধ্যে শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর হাতে ছিল মোট জাতীয় আয়ের ১৬.৩ শতাংশ। বিপরীতভাবে পিছিয়ে থাকা ৫০ শতাংশ মানুষের জাতীয় আয়ে অবদান ছিল মাত্র ১৭ শতাংশ। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা যেখানে দেশটির গিনি সহগ সূচক এর মান ০.৬৫। আর বিশ্বের  সবচেয়ে কম বৈষম্যের দেশগুলোর মধ্যে ওপরের দিকে আছে সুইডেন, ডেনমার্কসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো যেখানে গিনি সহগ সূচক এর মান ০.৩০ আশপাশে। এ ছাড়া ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর গিনি সূচক ০.৪০ থেকে ০.৪৫ এর মধ্যে আছে।

অর্থনীতিবিদ এর মতে বাংলাদেশের আয় বৈষম্য রোধকল্পে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে কেননা মানুষের আয় ও মজুরি বাড়লে বৈষম্য কমে আসবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যথাঃ সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও ডেনমার্ক জিডিপি’র প্রায় ৩৫ শতাংশ আয়কর এবং প্রোপার্টি ট্যাক্সের মাধ্যমে সংগ্রহ করে তা ব্যয় করছে সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বেকার ভাতা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং আয়-পুনর্বণ্টনমূলক অন্যান্য খাতে। মূলতঃ এসকল দেশে, ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধি’ অর্জনের কৌশল অবলম্বন করছে। আমাদের দেশের উন্নয়নের মূল দর্শন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে ‘বৈষম্য নিরসনকারী প্রবৃদ্ধিকেই’ এবং প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় এবং বাজেটে সুস্পষ্ট নীতি ও কর্ম-কৌশল ঘোষণা করতে হবে প্রতি বছর গিনি সহগকে কতখানি কমিয়ে আনা হবে। ফরাসী অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি তাঁর বিখ্যাত 'ক্যাপিটাল ইন দ্য টুয়েনটি ফার্স্ট সেঞ্চুরি' বইটিতে তথ্য উপাত্ত দিয়ে উপস্থাপন করেছেন, রাষ্ট্র যদি অত্যন্ত কঠোরভাবে আয় ও সম্পদ পুনর্বণ্টনকারীর ভূমিকা পালন না করে তাহলে উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে বিশ্বের সকল দেশে আয় ও সম্পদ বণ্টনের বৈষম্য বাড়তে বাড়তে অতি দ্রুত বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যাবেই। এছাড়া, সাইমন কুজনেৎস প্রদত্ত ‘ট্রিকল ডাউন তত্ত্ব' অর্থ্যাৎ এক পর্যায়ে উন্নত দেশগুলোতে বৈষম্য আর বাড়বে না বলে যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন পিকেটির বইটি সেটি পুরোপুরি বাতিল করেছেন। পিকেটি মনে করেন, অত্যন্ত প্রগতিশীল আয়কর ব্যবস্থা, সম্পত্তি কর ব্যবস্থা এবং বিশ্বব্যাপী পুঁজির উপর ‘গ্লোবাল ট্যাক্স’ বসানোর মাধ্যমে এই আসন্ন মহাবিপদকে ঠেকানোর প্রয়োজনকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে, পিকেটি ইউরোপীয় কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোকে এ ব্যাপারে তাঁর আদর্শ মনে করেন।  আয় বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হতে পারে থাইল্যান্ড কিংবা মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার সরকার আশির দশকের শুরুতে প্রান্তিক মালে গোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে থাইল্যান্ডে আয়বৈষম্য যখন ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তখন তারা নীতি কাঠামো সংস্কারের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং নিশ্চিত করা হয় যেন সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে সুবিধাগুলো পৌঁছায়। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে তালিকা করে কর্মসূচির প্রতিটি ধাপে নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়। এভাবেই দেশটি আয় বৈষম্য হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাফল্যকে অনুসরণ করে বাংলাদেশের বিদ্যমান আয় বৈষম্য কমাতে যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম উদ্যোগ হচ্ছেঃ ব্যক্তিগত আয়কর বৃদ্ধি করা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, পল্লী অবকাঠামো সংরক্ষণ ও গ্রামে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা।

বাংলাদেশে আয় বৈষম্য হ্রাস ও অসমতা দূরীকরণে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারেঃ  
মানবসম্পদ উন্নয়ন : বৈষম্য রোধের জন্য সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, বিশেষ করে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। কেননা এর মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য চক্র ভেঙে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে, তাদের জন্য নতুন  ও শোভন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, আয়বণ্টন উন্নত হবে, সর্বোপরি বৃদ্ধি পাবে প্রবৃদ্ধির হার। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে যথাক্রমে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে হবে।

গ্রামীণ অবকাঠামো ও কৃষি উন্নয়ন : গ্রামীণ অবকাঠামো ও কৃষি উন্নয়নে, বিশেষ করে গ্রামের রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, সেচব্যবস্থা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং পানির লবণাক্ততা নিরোধ প্রকল্পে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করতে হবে। উচ্চফলনশীল জাতের ফসলের চাষাবাদ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন সহনীয় বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে কেননা এর মাধ্যমে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে, শ্রমিকদের গড় উৎপাদনশীলতা ও গ্রামীণ মজুরি বাড়বে এবং গ্রামীণ মানুষের নগরকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের প্রবণতা হ্রাস পাবে।

 ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ঋণ (এসএমই) : স্বল্পসুদে ক্ষুদ্র ঋণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যবিমোচনে সহায়তা করে। এছাড়া, ক্ষুদ্র বিনিয়োগ ঋণ (এসএমই) গ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মূলধন সংকট সমাধানে সহায়তার পাশাপাশি স্বল্প দক্ষ শ্রমিকদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি ও সংস্কার : সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধির পাশাপাশি এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে। বাংলাদেশে বৈষম্য কমাতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ব্যাপক বাড়ানো দরকার এবং অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও জোরদার করা জরুরি। শহরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জন্য নতুন নতুন কর্মসূচি ও অভিনব কায়দায় জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির দ্রুত বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

শ্রমিকের দক্ষতার মানোন্নয়ন : দেশের শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়নে প্রোগ্রাম নিতে হবে এবং বৈশ্বিক চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে দক্ষ শ্রমিক গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবে। আবার দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে উৎপাদনশীল শ্রমশক্তির সঙ্গে সংযোগ ঘটবে যার মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন করা সম্ভব হবে।

প্রগতিশীল করারোপ পদ্ধতি : আয় বৈষম্য রোধের অন্যতম উপায় হচ্ছে প্রগতিশীল (প্রগ্রেসিভ)করারোপ পদ্ধতি যার মূল সুবিধাভোগী হবে দরিদ্র শ্রেণি-পেশার প্রান্তিক মানুষ। প্রগতিশীল (প্রগ্রেসিভ)করারোপ পদ্ধতি বাংলাদেশের বিদ্যমান আয় বৈষম্য মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।  প্রতক্ষ্য কর ও পরোক্ষ কর এর মাধ্যমে প্রাপ্ত রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করে সরকার বিভিন্ন অগ্রাধিকার খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে সক্ষম হবে। 

সুশাসন ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান : অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি ও সরকারি সম্পদ ব্যবহারে দুর্নীতি ও সরকারি ভূমি দখলদারিত্ব মোকাবেলায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কেননা সুশাসন ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান আয়বণ্টন সুষম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

 গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আনয়নঃ গ্রামীন নারীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আনয়নের জন্য সরকারের  বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। 

বাংলাদেশের আয় বৈষম্য হ্রাসে উপরোক্ত পদক্ষেপ গ্রহনের পাশাপাশি জরুরি হচ্ছে বৈষম্য কমাতে টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। আয় বৈষম্য বিলোপ সম্ভব হলেই কেবলমাত্র মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি বা  জিডিপির প্রবৃদ্ধির সুফল প্রান্তিক জনগণের কাছে পৌঁছাবে যাবে তাহলে নিশ্চিত হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। 

জিয়াউর রহমান, পিএমপি: উপসচিব ও কনসালটেন্ট, এটুআই প্রোগ্রাম।