অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

গৌরী প্রসন্নের স্মৃতি সংগ্রহশালা গড়ার দাবি

পাবনা প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১১:৫৭ এএম, ৫ ডিসেম্বর ২০২০ শনিবার   আপডেট: ১২:৪৮ পিএম, ৫ ডিসেম্বর ২০২০ শনিবার

‘‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি’’ কিংবা “মাগো ভাবনা কেন আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি” বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই দুটিসহ অসংখ্য কালজয়ী গানের রচয়িতা গৌরী প্রসন্ন মজুমদার। বিখ্যাত এই গীতিকবির ৯৫তম জন্মদিন আজ শনিবার (৫ ডিসেম্বর)। 

বাংলা আধুনিক গানের অন্যতম এই সুরস্রষ্টার জন্ম পাবনার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগরে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা সর্বাধিক জনপ্রিয় গানটির গীতিকার তিনি। পৈতৃক ভিটায় কালের প্রবাহে ধ্বংস হয়েছে তার সব স্মৃতিচিহ্ন। মুজিববর্ষে এই গীতিকবির স্মৃতি ধরে রাখতে সংগ্রহশালা গড়ে তোলার দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা। 

কেবল মুক্তিযুদ্ধের গানই নয়, “কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই” প্রয়াত মান্না দে’র কণ্ঠে বাঙালি হৃদয়কে তোলপাড় করে। বিবিসি জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আধুনিক বাংলা গানের তালিকায় ঠাঁয় পাওয়া এই গানসহ অসংখ্য মনজয়ী গানের রচয়িতা গৌরী প্রসন্ন। বাণী আর ছন্দের অভাবনীয় মেলবন্ধনে কখনো উত্তম-সুচিত্রার ঠোঁটে, কখনো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, শচীন দেব বর্মন কিংবা আশা ভোঁসলের কন্ঠে তার লেখা গান সহস্র বাঙালিকেিএখনো নিয়ে যায় স্বপ্নের দেশে।

১৯২৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পাবনার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগরে প্রখ্যাত জমিদার পরিবারে জন্ম নেন গৌরী প্রসন্ন। বাবা কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক উদ্ভিদবিদ গিরিজা প্রসন্ন মজুমদার। সেই সূত্রে শৈশবে কলকাতায় চলে যান তিনি। তবে আবার ফিরে আসেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। ১৯৫১ সালে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশ বিভাগের পর ১৯৬৫ সালে সপরিবারে চলে যান ওপার বাংলায়। 

জন্মভূমি ছেড়ে সেখানে থিতু হলেও মাতৃভূমির প্রতি গৌরী প্রসন্নের ভালোবাসা কমেনি একটুও। মহান মুক্তিযুদ্ধে হাজারো মুক্তিযোদ্ধাকে উজ্জীবিত করা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত “মাগো ভাবনা কেন শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি” কিংবা “শোন একটি মুজিবের থেকে লক্ষ মুজিবের কন্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি, আকাশে বাতাসে ওঠে রণ” গানগুলো সেটারই প্রমাণ।

সরেজমিনে দেখা যায়, গৌরী প্রসন্নের পৈতৃক বাড়িটি এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। স্মৃতিচিহ্ন বলতে রয়েছে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি তালগাছ আর একটি ঘাট বাঁধানো পুকুর। মূল বাড়ির ধ্বংসাবশেষে এখন জঙ্গল আর ময়লার স্তুপ।

ফরিদপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ১৯৭৪-৭৫ সালে গোপালনগর মৌজায় মজুমদার এস্টেটের ৩৩ একর জমি সরকার অধিগ্রহন করে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে সেখানে ৫০ শয্যার হাসপাতালের কার্যক্রম চলছে।

গোপালনগর গ্রামের বাসিন্দা ও গৌরী প্রসন্নের প্রতিবেশী বাবলু লাহিড়ী জানান, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফরে এসে শেষবারের মতো পৈতৃক ভিটায় আসেন গৌরী প্রসন্ন। ভারতে চলে যাওয়ার সময় গোপালনগরে তাদের বিশাল উঠোনসহ তিনতলা বিশিষ্ট বাড়ি ছিল। ১৯৮০’র দশকে কিছু স্মৃতিচিন্থ থাকলেও সেগুলোর কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

গৌরী প্রসন্নের ভ্রাতুষ্পুত্র চন্দন মজুমদার বলেন, এই পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি গর্ব অনুভব করি। তবে দুর্ভাগ্য তার কোনও স্মৃতিই আমরা ধরে রাখতে পারিনি। গোপালনগরে উপজেলা হাসপাতাল উনার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেখানে ওর কোনও স্মৃতিফলক পর্যন্ত নেই। হাসপাতালের পেছনেও অনেক জায়গা পরিত্যাক্ত পড়ে আছে। সরকার চাইলে সেখানে এই মহান কবির স্মৃতি ধরে রাখতে পাঠাগার ও সংগ্রহশালা গড়ে তুলতে পারে।

পাবনা সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি সাংবাদিক আব্দুল মতীন খান বলেন, জাতির জনকের প্রতি সম্মান জানিয়ে লেখা সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকা গানের রচয়িতা গৌরী প্রসন্ন আমাদের এখানকার সন্তান। এটি যেমন আমাদের গর্বিত করে, ঠিক তেমনি এই কালজয়ী গীতিকবির অবদান তুলে ধরতে পাবনায় কোনও উদ্যোগ না থাকাটা লজ্জাজনক। তিনি যে এদেশের সন্তান তাও অনেকের অজনা। মুজিববর্ষেই তার স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানাই।

পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শাহেদ পারভেজ বলেন, ২০১২ সালে গৌরী প্রসন্নকে সরকার মরণোত্তর মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা প্রদান করেছে। তবে তার নিজ জেলায় কোনও স্মৃতিস্মারক না থাকাটা দুর্ভাগ্যজনক। মুজিববর্ষেই কিংবদন্তি এই সঙ্গীতযোদ্ধার স্মৃতি ধরে রাখার উদ্যোগ নেয়া হবে।

১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট প্রখ্যা এই গীতিকার দূরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। জীবনের ৪০ বছর গানের জগতে কথা সাজানো আর মিল জুড়িয়ে গৌরী প্রসন্ন নিজ গানেই আকুতি রেখেছেন “যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কি আমি বলেছি মনে রেখো না”। তবে বাঙালি তাকে ভোলেনি, স্মৃতির মণিকোঠায় আপন কর্মে স্থায়ী আসন গেড়েছেন তিনি।

উল্লেখ্য, গৌরী প্রসন্নের ৯৫তম জন্মদিনে সন্ধ্যায় পাবনা প্রেসক্লাব আলোচনা সভা ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।