অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

থিয়েটার পর্যালোচনা

প্রশ্ন ও চিন্তা বিনিময়ের নাটক: নাজুক মানুষের সংলাপ

ড. ইসলাম শফিক

প্রকাশিত: ০৩:২২ পিএম, ৫ জুন ২০২৩ সোমবার   আপডেট: ০৩:২৫ পিএম, ৫ জুন ২০২৩ সোমবার

সম্প্রতি ঢাকার নাট্যমঞ্চে বিশেষভাবে আলোড়ন তৈরি করেছে ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ নাট্যপ্রযোজনাটি। থিয়েটারওয়ালা রেপার্টরি’র তৃতীয় প্রযোজনা এটি। ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ প্রযোজনাটি কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান এর রচনা; নির্দেশনা দিয়েছেন সাইফ সুমন। গত ১৯ থেকে ২৭ মে ২০২৩ টানা ৯ দিন, সর্বমোট ১২টি প্রদর্শনী হয়েছে মহিলা সমিতি মঞ্চে। সমাপনী দিনে আলোচিত এই প্রযোজনা দেখতে হাজির হয়েছিলাম বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মঞ্চে।

প্রশ্ন ও চিন্তা বিনিময়ের নাটক এটি। একজন তরুণের ও একজন প্রাজ্ঞ প্রবীণের আলাপচারিতার গল্প। গান ও কথোপকথনের মধ্যদিয়ে জীবনের জটিল জিজ্ঞাসা উচ্চারিত হয় সংলাপের যুক্তি, তর্ক, প্রতর্ক ও বিতর্কের শিল্পবুননে। তরুণের বুদ্ধিদীপ্ত জিজ্ঞাসার বিপরীতে দাঁড়িয়ে একজন আধুনিক চিন্তার প্রবীণের গল্পকথনের ভেতর দিয়ে জীবন ও জগৎ সংসারের নানান দার্শনিক বোধের অন্বেষণে মঞ্চভ্রমণ করে নাট্যকাহিনী। গল্প আর কথোপকথনের ভেতর দিয়ে জীবনের নানা দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজে প্রবীণের কাছে। প্রবীণ তরুণকে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পরিবর্তে প্রশ্নগুলোকেই উল্টেপাল্টে দেখতে উদ্বুদ্ধ করেন। নাট্যগল্পে তরুণ মুখোমুখি হয় কিছু সত্য, আর কিছু আপাত সত্যের আলো-অন্ধকারের বাস্তবতায়। আপাত সত্য, প্রকৃত সত্য, অর্ধ সত্য বা মিথ্যা কি সত্যের বিপরীতে কী না, এসব সত্য-মিথ্যার মুখোমুখি হয় প্রাজ্ঞ এবং তরুণ।

নাটকটিতে অভিনয় করছেন অধ্যাপক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক ও রুদ্র সাওজাল। মাত্র দু’জন অভিনেতা প্রায় সোয়া ঘণ্টা মিলনায়তনের দর্শকদের মুগ্ধতায় বেঁধে রাখেন। ইউসুফ হাসান অর্ক সমকালের দুই বাংলায় অন্যতম সেরা নাট্যনির্দেশক হিসেবে সমাদৃত। এবার এই নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনেতা হিসেবে তিনি নিজের জাত চিনিয়েছেন। তরুণ অভিনেতা রুদ্র সাওজালের সাবলীল অভিনয় সবাইকে মুদ্ধ করেছে। গানের কথা ও সুর ইউসুফ হাসান অর্ক, সুমন মজুমদার, মাহফুজ সুমন। আলোক পরিকল্পনায় অম্লান বিশ্বাস, পোশাক পরিকল্পনায় আইরিন পারভীন লোপা, সংগীত পরিকল্পনা করেছেন ইউসুফ হাসান অর্ক। মঞ্চ পরিকল্পক, পোস্টার, প্রকাশনা, প্রচার ও মঞ্চ ব্যবস্থাপক সাকিল সিদ্ধার্থ। আবহ নিয়ন্ত্রক ও সহকারী মঞ্চ ব্যবস্থাপক আবির সায়েম। প্রযোজনা অধিকর্তা হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন হাসান শাহরিয়ার। প্রযোজনা সংশ্লিষ্ট সকলকে সাধুবাদ জানাই।

নির্দেশক খুব সাধারণভাবে অসাধারণ বেশ কিছু থিয়েট্রিক্যাল মুভমেন্ট ও কম্পোজিশন নির্মাণ করছেন। ঘূর্ণায়মান মঞ্চের ব্যবহারে অভিনেতাদ্বয়ের সংলাপে দারুণ নাট্যমুহূর্ত তৈরি হয়েছে। শুরুতে দোতলা মঞ্চের ব্যবহার এবং শেষে মিররের ব্যবহার নাট্যঘটনাকে গতিশীল করেছে। পোশাক পরিকল্পনা ভালো, তবে প্রবীণ অভিনেতার পোশাক অতি মাত্রায় গ্রেকো-রোমান ঘরানার শিটন নির্ভর হওয়াতে তরুণ অভিনেতার পোশাকের সঙ্গে সংঘাত তৈরি করেছে। প্রবীণ অভিনেতার বয়সের কারণে চাশমার বিষয়টি ভাবা যেতে পারে।প্রবীণ অভিনেতার স্মোকিং পাইপের ব্যবহার চরিত্রকে ভিন্নমাত্রায় দাঁড় করিয়েছে। প্রপসের ব্যবহার চমৎকার। আলোক পরিকল্পনা ও প্রক্ষেপণে সর্বদাই সমালোচনা করা হয়। এটা যেন প্রচলিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে! তবে বিশেষ করে এই প্রযোজনায় আলো নিয়ে বেশ ভাবনার জায়গা রয়েছে। আলো অন্যতম চরিত্র হিসেবে প্রযোজনাকে সাহায্য করে নি বরং কোনো কোনো সময় বৈরিতা করেছে। নাট্যকাহিনীর বিষয়বুননে সংলাপে বেশ পুনঃপুনিকতা রয়েছে! প্রশ্ন-জিজ্ঞাসার বারংবার পুনঃপুনিকতায় নাট্যচলন মন্থর হয়ে যায়, এই গল্প চল্লিশ মিনেটের প্রযোজনায় ব্যপ্তিতে সীমাবদ্ধ রাখলে দর্শক পূর্ণসময় সতেজ উত্তেজনা নিয়ে শেষ পর্যন্ত নাট্যরস গ্রহণ করবেন। সর্বোপরি প্রযোজনা দারুন। ঢাকার মঞ্চের এধরনের প্রযোজনা  আরও প্রযোজন। দর্শক রুচি তৈরি করা যেমন দায়িত্ব, তেমনি রুচিশীল দর্শকদের কথা চিন্তা করে মানসম্মত প্রযোজনা নির্মাণ করাও থিয়েটার দলগুলোর দ্বায় রয়েছে। মঞ্চে দর্শক ফিরে আসুক। মঞ্চনাটকের জয় হোক।

ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক, নির্মাতা ও গণমাধ্যম কর্মী।