যে কারণে বাড়ছে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য
অপরাজেয় বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৪৬ পিএম, ২৪ মে ২০২৩ বুধবার আপডেট: ০৩:৪৭ পিএম, ২৪ মে ২০২৩ বুধবার
যুক্তরাজ্যে এক বছরের মধ্যে খাবারের দাম বেড়েছে ১৯ শতাংশ। দেশটিতে নিত্যপণ্যের বাজার করতে যেখানে আগে ৫০ পাউন্ড লাগতো, এখন সেখানে লাগছে ৬০ পাউন্ডের মতো। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা যায়। শুধু যুক্তরাজ্য নয়, খাবার খরচ বেড়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল স্থানে। প্রশ্ন হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামলেই কী খাবারের দাম কমবে বিশ্বজুড়ে?
যুক্তরাজ্যের খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি এবং এই সমস্যা সমাধানে জরুরি বৈঠকে বসেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। তবে এখনও কোনো সমাধানে আসতে পারেনি দেশটি। এই দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে পাঁচটি বিশ্লেষণ হাজির করা হয়েছে। যার প্রভাব আসলে রয়েছে বিশ্বজুড়ে।
দাম বৃদ্ধিতে দুই রকম প্রভাব
ইউক্রেনের রুশ আগ্রাসনের পর শস্য, সূর্যমুখী তেল ও সারের দাম বেড়ে গেছে। সরবরাহ শঙ্কায় দাম বেড়েছে খাদ্যদ্রব্যেরও। জাতিসংঘের খাদ্যবিষয়ক সংস্থা জানিয়েছে আগ্রাসানের পর মাংস, দুগ্ধজাত পণ্য, গম, তেল ও চিনির দাম ২০ শতাংশ বেড়ে যায়। এখন আবার দাম কিছুটা কমেছে। কিন্তু সেটি আগের মূল্যের ধারে কাছেও নেই।
সরকারের সহায়তায় না থাকায় দেশটিতে কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের খরচ বেড়ে গেছে তিনগুণ। জীবনযাত্রার খরচ এক বছরে বেড়েছে ৯ শতাংশ।
করোনা মহামারি এবং তারপরই ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতই এর প্রভাব মারাত্মকভাবে পড়েছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে টিসিবি ও অন্যান্য বেশ কিছু পেশার ক্ষেত্রে কিছুটা ভর্তুকি ও সহায়তা প্রদান করলেও বেসরকারি খাতের বড় একটি অংশ রয়ে গেছে সেই সহায়তার বাহিরে। যার বাজে প্রভাব রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাহী ব্যয়ে। ফলে ব্যয় কমে যাওয়ার সম্ভবনা কম রয়েছে যুক্তরাজ্যের মতো বাংলাদেশেও।
খাবারের ব্যবসায় লাভ কমে গেছে অনেক
খাদ্যশৃঙ্খলের সবগুলো শাখাতেই খরচ বেড়েছে। কিন্তু এই বোঝা কি সমানভাবে ভাগ হয়েছে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লভ্যাংশের পরিমাণ খুবই কম যুক্তরাজ্যে। বিবিসি প্রতিবেদন অনুসারে, এক পিস পনিরের দাম আড়াই পাউন্ড। ফুড অ্যালায়েন্স, সাস্টেইন ও ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথের করা গবেষণা অনুযায়ী, এতটুকু পনির উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় দেড় পাউন্ড। রিটেইলাররা ফুড শপে পৌঁছানো পর্যন্ত লাভ রাখতে পারেন ৩ দশমিক ৫ পেনি। সুপারমার্কেট পায় আড়াই পেনি আর কৃষক এক পেনিরও কম। যুক্তরাজ্যের ডেইরি ফারমারদের সমিতি আরলা জানায়, গত বছর থেকে এখন খরচ বেড়ে গেছে ৮০ শতাংশ। এখন লাভ করা খুবই কঠিন।
প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয়তে লাভের পরিমাণ কিছুটা বেশি। ম্যাগনাম আইসক্রিম তৈরি করা ইউনিলিভার কিংবা কিপলিং কেক তৈরি করা প্রিমিয়ার ফুডস জানায় তারা প্রতি ১ পাউন্ডে ১৫ পেনি লাভ রাখতে পারেন।
ইউনাইট ইউননিয়নের অভিযোগ বড় সুপারমার্কেটগুলো অনেক লাভ করছে। তবে বিবিসি জানিয়েছে ২০২১ সালে তা সম্ভব ছিল। বর্তমানে সুপারমর্কেটগুলো প্রতি এক পাউন্ডে সর্বোচ্চ পাঁচ পেনি লাভ রাখতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ডিম ও মুরগির মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হচ্ছে করপোরেট সেক্টরকে। সেই সঙ্গে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকের লাভের পরিমাণ খুবই সামান্য হওয়ায় অনেকেই বন্ধ করে দেন খামার। একই ভাবে ধার উৎপাদনে কৃষকের লাভের পরিমাণ কম, বরং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের লাভের পরিমাণ বেশি বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
দাম প্রতিনিয়ত পাল্টাচ্ছে
পাস্তা, দুগ্ধজাত দ্রব্য ও তেলের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে সুপারমার্কেটগুলো বড় ছাড় দিয়ে থাকে। কিন্তু তারপরও সবমিলে খরচ কমছে না। অভিযোগ রয়েছে রিটেইলার শপগুলো অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে ফেলছে যুক্তরাজ্যে। কিন্তু ছাড়ের বিজ্ঞাপন বড় করে দিচ্ছে।
বিবিসি জানায়, বেশির ভাগ প্যাকেটজাত পণ্যের দাম অনেকদিন স্থায়ী হয়। ফলে গত বছর যা দাম ছিল, খুব শিগগিরই তার চেয়ে বাড়ছে না। ছোট ছোট পণ্যের দাম খুব অল্প হারে বাড়ছে। তবে তার প্রভাব পড়তেও ছয় মাস লেগে যাবে।
বাংলাদেশেও বিগত ১ বছরে পণ্যের দাম বেড়েছে অসংখ্যবার। কমেছেও কিছূ পণ্যের দাম। কিন্তু দামবৃদ্ধি ও হ্রাসের মধ্যে পার্থক্য অনেক। ফলে কিছুতেই আগের মূল্যে ফেরত যাচ্ছে না কোন পণ্যের দাম। এ ক্ষেত্রে সবচাইতে বাজে প্রভাব রয়েছে ভোজ্যতেল ও শিশুখাদ্যে।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে যুক্তরাজ্যে দাম কম
ব্রেক্সিটের ধাক্কা এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি যুক্তরাজ্য। অর্থনীতিবিদ মসাইকেল সন্ডার্স এর গবেষণায় দেখা যায়, ইউরোপের অন্যান্য দেশের সাপেক্ষে যুক্তরাজ্যে খাবারের দামে খুব একটা পার্থক্য নেই। বরং রুটি, মাংস এবং মাছ যুক্তরাজ্যে সস্তা। দেশটির প্রতিযোগিতামূলক সুপারমার্কেট সেক্টরের কারণে দাম কম থাকছে। ২০১৫ সালে ইইউয়ের মধ্যে যুক্তরাজ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেশি ছিল। তবে এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে।
কম খরচের সমাধান নেই
২০২০ সালের সাপেক্ষে চলতি বছর গ্রীষ্মে খাবারের বিল ১ হাজার পাউন্ড বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে রেজুলেশ্যন থিংক ট্যাংক। কিছু পণ্য হয়তো সস্তা হবে। কিন্তু সবমিলে হয়তো খরচ কমবে না। যুক্তরাজ্যে সম্প্রতি কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমেছে। তবে তাও ২০২০ সালের তুলনায় অনেক বেশি।
বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেও একই ধারণা পোষণ করেছে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাদের ভাষ্যমতে, বিভিন্ন সময় পেয়াজ, আদা থেকে শুরু করে চাল, ডাল ও নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পণ্যের দাম হ্রাস বৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু এই ধারা সারা বিশ্বের মতই ঊর্ধ্বমুখী থাকার সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে, বিগত বছরগুলোতে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তনের ছোঁয়া বাংলাদেশের বাজারেও থাকবে। যার ফলে খাদ্য পণ্যের দাম এখনই হ্রাস হবার সম্ভাবনা কম বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় যুক্তরাজ্য ও ইইউ ভুক্ত দেশগুলোর মতই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সমস্যা ভুগতে হবে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে।
অবশ্য আশার বিষয় হলো ওয়ার্ল্ড ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (এফএও) ফুড প্রাইস ইনডেক্স অনুসারে এপ্রিলে খুবই সামান্য পরিমাণে খাদ্য দ্রব্যের মূল্য বিশ্বজুড়ে হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু ইউরোপে শীত নামার পূর্বে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের মীমাংসা না হলে তা আরও বাড়বে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।