পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক উৎসব
হীরেন পণ্ডিত
প্রকাশিত: ১১:০৭ পিএম, ১৬ এপ্রিল ২০২৩ রোববার
পহেলা বৈশাখ বা নবর্বষ মানে আমরা বুঝি নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া। এটা প্রাচীনকাল থেকে হয়ে আসছে। ঠিক তেমনি বাঙালি জাতিরও পহেলা বৈশাখ নববর্ষ। এটাই আমাদের নতুন বছর। এটা মিশে আছে আমাদের রক্তে, চেতনায় এবং অস্তিত্বে। কারণ আমাদের কাছে পহেলা জানুয়ারি মানেই নতুন বছর! আমরা আজ অন্যের সংস্কৃতিকে নিজের সংস্কৃতিতে নিয়ে এসেছি। আমাদের সন বাংলা, আমাদের মাস বাংলা কিন্তু আমরা চলি ইংরেজি অনুযায়ী। অনেককেই যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আজ বাংলা সনের কত তারিখ। তারিখ তো দূরের কথা বছরের নাম মনে থাকেনা। তাই সারা বছরের সব জীর্ণতা ক্লান্তি দূর করে পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের জন্য নিয়ে আসে আনন্দ আর ভালোবাসা। পহেলা বৈশাখ হচ্ছে লোকজের সঙ্গে নাগরিক জীবনের একটি সেতুবন্ধন। ব্যস্ত নগর কিংবা গ্রামীণ জীবন যেটাই বলা হোক না কেন, এই নববর্ষই বাঙালি জাতিকে একত্রিত করে জাতীয়তাবোধে। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান পরিণত হয় প্রতিটি বাঙালির কাছে শিকড়ের মিলন মেলায়। ধর্ম, বর্ণ সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়।
পহেলা বৈশাখ যেহেতু বাঙলা মাসের প্রথম দিন, তাই এই দিনটিকে কেন্দ্র করে চলে খাওয়া- দাওয়ার এক ধুম। শহর এবং গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে ভাল-মন্দ, কম-বেশী রান্না হয়, যা সবাই একটি পালা-পার্বণ কিংবা একটি উৎসবের দিন হিসেবে পালন করে থাকে। মিষ্টি বাঙালির যে কোনো উৎসবের প্রধান আর্কষণ হয়ে থাকে, আসলে মিষ্টি ছাড়া আমাদের বাঙালির যে কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয় না বা জমে না। আর সাথে থাকে মাছ, র্ভতা। পান্তা ইলিশ আরো অনেক কিছুই জায়গা নিয়েছে এই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের তালিকায়। নানা পদের র্ভতা এবং মাছ এই দিনে রান্না করা হয়ে থাকে।
মাছের মধ্যে প্রধান আকর্ষণ থাকে ইলিশ মাছ এবং বাজারে এই দিন টিকে কেন্দ্র করে সব রকম মাছের দাম বাড়িয়ে দেয় মাছ ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে ইলিশ মাছের দাম। পহেলা বৈশাখের কয়েক দিন আগেই এই মাছের দাম বাড়তি থাকে। তবে সাধ্য মতন সবাই কেনার চেষ্টা করে থাকে। আর সাথে থাকে দই মিষ্টি।
গ্রামীণ মেলাগুলো পরিণত হয় উৎসবে। এই উৎসবের রংই একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়তে বাঙালি জাতিকে এগিয়ে নিয়েছে বারবার। নতুন বছরকে বরণ কওে নেওয়ার জন্য এ দেশের মানুষ সব সময়ই আন্তরিক, অকৃত্রিম ও অগ্রগামী। দীর্ঘ প্রস্তুতির বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে অনেক আচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সব পেশার মানুষ। লোকজ ব্যবহারিক তৈজসপত্রের বিভিন্ন অংকন শিল্প আমরা খুঁজে পাই এই পটচিত্রের মাধ্যমে। শিল্পী তার রঙিন আল্পনায় স্বপ্ন দেখে আগামী দিনের। নিজ সংস্কৃতিতে গড়ে ওঠে বাঙালি জাতির প্রজন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে। ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া এই শোভাযাত্রা সব অপসংস্কৃতি, অনিয়মের বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো ২০১৬ সালে এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। বাঙালি সংস্কৃতির জন্য যা ছিল একটি বিশাল অর্জন। এছাড়া রমনার বটমূলসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয় সঙ্গীত, নৃত্যকলা কিংবা আবৃতি। এই শিল্পগুলোর প্রতিটিই স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের শিকড়কে। বরণ করে নেয় নিজ পরিচয়ের নববর্ষকে। নববর্ষের এই উৎসব নারী-পুরুষ সবার, সব শ্রেণি পেশার মানুষের, ধনী, গরিব সবার সর্বজনীন ও আম্প্রদায়িক চেতনার একটি প্রোগ্রাম। উৎসবে যোগ দেয়ার স্বাধীনতাও সবার সমান। একটি জাতি যখন তার নিজ সংস্কৃতিতে বলিষ্ঠ হয় তখন তাকে কোনো অপসংস্কৃতি, কু-সংস্কার গ্রাস করতে পারে না। তাই নিজ সংস্কৃতির সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা শিল্পগুলোর নিয়মিত চর্চার প্রয়োজন। নিজেদের সংস্কৃতির রক্ষায় এবং বিস্তারে আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির ছায়াতলে অবস্থান নিতে হবে। অন্যান্য সংস্কৃতির সঙ্গেও আমরা পরিচিত হব, তবে তার আড়ালে যেন ঢেকে না যায় আমাদের স্বকীয়তা। বাঙালি হিসেবে নিজ সংস্কৃতির প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থাকাও জরুরি।
পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন, সঠিক ইতিহাস, বাঙালির প্রাণের উৎসবের দিন, আমাদের শিকড়ের ঠিকানা। পহেলা বৈশাখ মানেই ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। চিরচেনা সেই সুমধুর গান দিয়ে প্রতিবছর ঘুরে আসে বাংলা বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর লেখা এই গান, বাংলা বছরের প্রথম দিনটিকে আরও সুন্দর করে তোলে। সকল গøানি মুছে দেয় এই পহেলা বৈশাখ। ঢাকায় বছরের প্রথম দিন শুরু হয় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে। সারা দেশের আনাচে-কানাচে নিজস্ব নিয়ম বা ঢংয়ে শুরু হয় এই বৈশাখ উদযাপন। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় প্রত্যক বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা। দিনভর সব জায়গায় থাকে উৎসব মুখর পরিবেশ, সাথে থাকে অনেক জায়গায় মেলা এবং ছোট ছোট উৎসব। এই উৎসব যে শুধু ঢাকাতে সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়, গ্রামগঞ্জেও পালা করে চলে নানা রকম মেলা, যাত্রা, গানের আয়োজন। বসে নানা রকম পসরা। হরেক রকম মিষ্টি, বাতাসা, মুড়কি, নিমকি, ইত্যাদি। বসে চরকি, নাগরদোলা, বায়োষ্কোপ আরও অনেক রকম মজার সব খেলা। গ্রামে সেই সাথে যুক্ত হয় বলী খেলা, নৌকা বাইচ। এই ধরনের বৈশাখী মেলা চলে পুরো মাসব্যাপী, সেই সাথে থাকে নানা রকম বৈশাখী আয়োজন।
গ্রাম বাংলার পালা পার্বণ থেকে শহরের পালা পার্বণ অনেকটা ভিন্ন। শহরের বৈশাখী আয়োজনগুলো আবার একটু ভিন্ন আঙ্গিকের হয়। ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের আগের দিন আয়োজন করা হয় চৈত্র সংক্রান্তি, যেখানে সন্ধার পর চারুকলার বটতলায় বসে নানা আয়োজন। চলে নাচ, গান, আবৃত্তিসহ আরও অনেক কিছু। এছাড়াও সংসদে ভবনের সামনে মানিক মিঞা এভিনিউতে রাতভর আঁকা হয় আলপনা। আলপনায় ফুটিয়ে তোলা হয় বৈশাখের পটভূমি। সেই আলপনা আঁকা দেখতে অনেকই ভীড় করেন সেখানে। অনেক সময় আয়োজন করা হয় সারা দেশব্যাপী। পুরো বাংলাদেশের সকল বিভাগ এক সংগে ও একই দিনে আঁকে। যা কিনা বাংলাদেশের জন্য এক গর্ব ও ভালোলাগার দিক।
বিশেষ এই দিনটি কেন্দ্র করে নতুন জামাকাপড় কেনার একটি আগ্রহ সবার মাঝে দেখা যায়। থাকে পোশাকে কিছু প্রধান রং, লাল-সাদা বা শুধু লাল বা শুধু সাদা থাকে প্রথম পছন্দ। আগেও এই প্রথা ছিল বটে তবে আজকাল এটি ফ্যাশন পরিণত হয়ে গেছে। এই দিন বেশির ভাগ ছেলে-মেয়ে, পুরুষ-মহিলা সকলেই যে পোষাক পরে না কেন, তারা লাল বা সাদা রং বেছে নেয়। ছেলেরা বেশির ভাগ পরে পাঞ্জাবী এবং বেশীর ভাগ মেয়েরা পরে শাড়ি। সেদিন সারাদিন দেখতে পাওয়া যায় রঙিন এক বৈচিত্র্যময় পোশাক। সবাই সুন্দও সেজে পরিপাটি হয়ে বের হয় এই দিনটি পালন করতে।
আমাদের এই বাংলাদেশে সব মানুষই প্রথা অনুযায়ী এই দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ও তাদের নতুন বছর যা কিনা ফুল বৈষাবী এই সময় পালন করে থাকে। তিন দিন তারা এই উৎসব পালন করে থাকে। আমাদের পহেলা বৈশাখের মতন এটিও তাদের একটি অন্যতম উৎসব। সকাল বেলা ভোরে নানা রঙের ফুল নদীতে ভাসিয়ে তারা এই দিন টি শুরু করে থাকে। তারপর দিনভর চলতে থাকে নানা আয়োজন। দিনটিতে আমরা সকল বাঙালিরা সব ভেদাভেদ ভুলে একসাথে দিনটি পালন করে থাকি, একসাথে সবাই আনন্দে মেতে উঠি, পুরোনো দিনগুলো ফেলে রেখে, নতুন দিনের পথচলা শুরু করি, তাই কবিগুরু বলেছিলেন
“মুছে যাক গøানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।” তাই নতুন বছর, নতুন দিন এবং নতুন একটি বছর সবাই শুরু করি মঙ্গলময়ভাবে।
পহেলা বৈশাখ বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে পালনের রেওয়াজ মোগল স¤্রাট আকবরের সময় থেকে। আরবি বা হিজরি চান্দ্রবর্ষের সৌরবর্ষ সংস্করণ হলো বাংলা সন। তারপর থেকে বছরের শেষ দিন অর্থাৎ ৩০ চৈত্রকে চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে পালন করা হয় সাড়ম্বরে। নববর্ষ পালন মানব সভ্যতারই অনুষঙ্গ। মানব সমাজে বর্ষবরণ উৎসবের শুরু সম্ভবত চার হাজার বছর আগে। মনে করা হয়, ব্যাবিলনে বর্ষবরণের সূত্রপাত ঘটে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা পাড়ের মানুষও হাজার হাজার বছর ধরে বর্ষবরণ পালন করে আসছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার দিনপঞ্জি হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে চালু হলেও গ্রামীণ সমাজে বাংলা বর্ষপঞ্জির গুরুত্ব এতটুকু কমেনি। কালের বিবর্তনে গ্রামীণ সমাজেও গ্রেগরীয় দিনপঞ্জির ব্যবহার বেড়েছে। তারপরও কৃষক সমাজ আজো বাংলা সনকে সামনে রেখে তাদের ফসলি কার্যক্রম চালায়। দেশের সবচেয়ে বড় উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে বিজড়িত বাংলা সনের সম্পর্ক। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও হালখাতার মাধ্যমে বাংলা নববর্ষকে চিরঞ্জীব করে রেখেছে। বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। নববর্ষের বৈশাখী মেলা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বাঙালির নববর্ষ আসে কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়ার মাতম তুলে। জরাজীর্ণ যা কিছু তাকে উড়িয়ে দিয়ে নববর্ষে নতুনের অভিষেক হয়। নববর্ষে বাঙালি অতীতের দুঃখ-বঞ্চনা-ব্যর্থতা ভুলে সামনে এগুনোর শপথ নেয়। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ- সবখানেই রয়েছে পহেলা বৈশাখের হার না মানা প্রত্যয়। নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন সংস্কৃতির বাহন বলে বিবেচিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। হালখাতা, বৈশাখী মেলা এবং শহুরে পান্তা-ইলিশের রমরমা- আধুনিকতার এই যুগেও নিজেদের বাঙালি হিসেবে ভাবার সুযোগ করে দেয়।
শুভ নববর্ষে বিদায়ী বছরের জীর্ণ পুরাতন, বিষাদঘন স্মৃতি ভেসে যাক। ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে প্রাণে প্রাণে লাগুক শুভ কল্যাণের দোলা, ‘নবআনন্দ বাজুক প্রাণে’। মঙ্গলকামনায় নববর্ষের প্রথম প্রভাতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজনীন আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠে মানুষ। দেশবাসী সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সুন্দর ও কল্যাণের জয়গানে স্বাগত জানায় নববর্ষকে।
রমনার ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা, পুরান ঢাকায় হালখাতা, শেরেবাংলা নগর, ধানমÐির রবীন্দ্র সরোবর, বনানী ও গুলশানসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বৈশাখী মেলায় ঢাকা পরিণত হয় উৎসবের নগরীতে। দিনভর অনুষ্ঠিত হয় গান-বাজনা, খেলাধুলা, শোভাযাত্রা, প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাগরদোলা-লাঠিখেলা কোনো কিছুই বাদ যায় না।
বর্ষবরণের উৎসবে মেতে উঠে বাংলাদেশের মানুষ। পদ্মা মেঘনা যমুনাপাড়ের এ দেশে বর্ষবরণের ঐতিহ্য বেশ পুরনো। বছরের শেষ দিন অর্থাৎ ৩০ চৈত্রকে চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে পালন করা হয় সাড়ম্বরে। বাংলা নববর্ষের অন্যতম অনুষঙ্গ বৈশাখী মেলা। বৈশাখ মাসকে বলা হয় মেলার মাস। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে যে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয় তা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বাঙালির নববর্ষ আসে কালবৈশাখীর ঝড়ো হাওয়ার মাতম তুলে। জরাজীর্ণ যা কিছু পুরান তাকে উড়িয়ে দিয়ে নববর্ষে নতুনের অভিষেক হয়। নববর্ষে বাঙালি শপথ নেয় অতীতের দুঃখ-বঞ্চনা-ব্যর্থতা ভুলে সামনে এগুনোর। নববর্ষ বাঙালির সর্বজনীন সংস্কৃতির বাহন বলে বিবেচিত হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। হালখাতার অনুষ্ঠান, বৈশাখী মেলা এবং শহুরে পান্তা-ইলিশের রমরমা আধুনিকতার এই যুগেও নিজেদের বাঙালি হিসেবে ভাবার সুযোগ করে দেয়।
পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। আবহমানকাল ধরে বাংলার গ্রাম-গঞ্জে, আনাচে-কানাচে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। গ্রামীণ মেলা, হালখাতা, বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার আয়োজন ছিল বর্ষবরণের মূল অনুসঙ্গ। ব্যবসায়ীরা আগের বছরের দেনা-পাওনা আদায়ের জন্য আয়োজন করতেন হালখাতা উৎসবের। গ্রামীণ পরিবারগুলো মেলা থেকে সারা বছরের জন্য প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র কিনে রাখতেন। গ্রহস্থ বাড়িতে রান্না হতো সাধ্যমত উন্নতমানের খাবারের। ঢাকা শহরের বিভিন্নস্থানে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের চল ছিল। আজিমপুর, ওয়ারি, ওয়াইজঘাট ও মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে হালখাতা উৎসব হতো, মেলা বসতো, মেলায় পণ্য বেচাকেনা, গান-বাজনা, যাত্রা-সার্কাস ইত্যাদির আয়োজন হতো। ষাটের দশকে রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের বর্ষবরণ সঙ্গীত পরিবশেন শুরু হয়।
সকল সঙ্কীর্ণতা ও কুপমণ্ডুকতা পরিহার করে উদারনৈতিক জীবন-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পহেলা বৈশাখ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। মনের ভিতরের সকল ক্লেদ, জীর্ণতা দূর করে আমাদের নতুন উদ্যোমে বাঁচার শক্তি যোগায়, স্বপ্ন দেখায়। আমরা যে বাঙালি, বিশ্বের বুকে এক গর্বিত জাতি, পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে এই স্বজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। আজ শুধু দেশে নয়, বিশ্বেও যে প্রান্তেই বাঙালি তাঁর বসবাস গড়ে তুলেছেন, সেখানেই বাঙালি’র হাজার বছরের লোক-সংস্কৃতিকে বয়ে নিয়ে গেছেন এবং যাচ্ছেন। বর্ষবরণসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাঁরা জানান দেন তাঁরা বাঙালি। আর এর মাধ্যমেই পৃথিবী জুড়ে তৈরি হচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির সেতুবন্ধ।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক।